শাহ মো. জিয়াউদ্দিন : ‘ডাইবদার’ শব্দটি জাতীয়ভাবে প্রচলিত কোন শব্দ নয়। তবে এক সময় ময়মনসিংহের দক্ষিণাংশে এই শব্দটি বহুল প্রচলিত ছিল এখনো প্রচলন দেখা যায়।
ডাইবদার হলো একটি বিশেষ্যণ পদীয় শব্দ। আগেকার দিনে চোর ,ডাকাত, ছিনতাইকারীরা সাধারণ মানুষের কাছ থেকে যে সমস্ত মালামাল চুরি , ডাকাতি ছিনতাই করতো , ঐ সমস্ত মালামাল নিজেরা বিক্রি করতে পারতো না। ভয় ছিল নিজেরা বিক্রি করতে গেলে যার মালামাল খোয়া গেছে তার হাতে ধরা পড়ার। কারণ চোর এবং বাড়ির মালিক একই এলাকার মানুষ হওয়ার কারণে মালমাল চিনে ফেলবেন । তাই সমাজের কোন প্রভাবশালী ব্যক্তির কাছে চোর, ডাকাত , ছিনতাইকারীরা মালামাল গুলো রেখে দিতেন, সুবিধাজনক সময়ে মালামাল গুলো বিক্রি করার জন্য ।
যিনি চোর, ডাকাত, ছিনতাইকারীর মালামাল গচ্ছিত রেখে বিক্রি করার ব্যবস্থা করেন তাকেই ডাইবদার বলা হয়। চোর, ডাকাত, বা ছিনতাইকারী ধরা পড়লে গণপিটুনির শিকার হয়, কিন্তু ডাইবদারদের কিছুই হয় না। কারণ ডাইবদার যারা হন তারা সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তি। ডাইবদারদের বৈশিষ্ট্য হলো তারা সমাজসেবী রুপ ধারণ করে সমাজের গুরুত্বপুর্ণ স্থানে অবস্থান করেন। ধর্মীয় ও সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন এ ধরনের ডাইবদারা। তাই তাদেরকে সমাজ সম্মানের চেখেই দেখে। শক্তির নিত্যতা সূত্রে বলা হয়, ‘শক্তি অবিণাশী তার ক্ষয় ভাবে বিনাশ নাই তবে এক রুপ থেকে অন্য রুপে রুপান্তর হয় মাত্র।’
ঠিক এই নিত্যতার সূত্রানুসারে বিশ্ব পরিমণ্ডলেও এই ডাইবদারদের উপস্থিতি দেখা যায়। তারাও গ্লোবাল ভিলেজ নামক সমাজ ব্যবস্থায় প্রভাশালীর ভূমিকায় আছেন। পৃথিবীর যে সমস্ত দেশ কথিত তৃতীয় বিশ্ব থেকে পাচার হওয়া টাকা গচ্ছিত রাখে তারাই গ্লোবাল ভিলেজের ডাইবদার। ঐ সমস্ত দেশের আইন ব্যবস্থা, নিয়মকানুন এবং নৈতিকতা কত সুন্দর এ কথা বলতে বলতে অনেকেই মুখে ফেনা তুলে ফেলেন। কিন্তু বাংলাদেশের মত দেশ গুলি থেকে পাচার হওয়া অর্থ ঐ দেশ গুলিতে গচ্ছিত রাখা হয়। ঐ ডাইবদার দেশগুলির গণতন্ত্র, নাগরিক ব্যবস্থা অনুকরণের জন্য বাংলাদেশের সুশীলরা উপদেশ দেন।
বাংলাদেশের অবৈধ ভাবে উপার্জিনকারীরা কালো টাকা গুলো পাচার করে ঐ দেশ গুলিতে। ২৬ জুন, ২০২০ সালের প্রথম আলোতে প্রকাশিত তথ্যর ভিত্তিতে জানা যায় , সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমাকৃত টাকার পরিমান ৫ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকা। সুইজারল্যান্ড সরকার বাংলাদেশ থেকে যারা এই বিপুল পরিমান অর্থ পাচার করেছে, এই তথ্য গোপন রাখে। ফলে বাংলাদেশের দুর্বৃত্তরা অবৈধ ভাবে উপার্জিত টাকাগুলো সুইস ব্যাংকে জমা রাখতে কোন সমস্যা হয় না। সুইজারল্যান্ডের এই ডাইবদারীত্বের কারণে বাংলাদেশের দুর্নীতি বাড়ছে দিন দিন। গত দশ বছরে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে ৫ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ যে সমস্ত দেশে জমা হয় তাদের মধ্যে অন্যতম দেশ হলো, সুইজারল্যাণ্ড, যুক্তরাষ্ট্র , যুক্তরাজ্য, কানাডা, নিউজিল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ডেনমার্ক, নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম , সংযুক্ত আরবসহ কথিত সভ্য ধনি দেশ গুলোতে।
২৪-১১-২০২০ তারিখের দৈনিক প্রথম আলোয় প্রকাশিত নিবন্ধের তথ্য থেকে জানা যায়, বাংলাদেশের ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ গ্রহণ করে ,ঐ ঋণের টাকা ফেরত না দিয়ে কানাডায় আয়েশী জীবন যাপন করছে বহু বাংলাদেশি। কানাডায় বাংলাদেশের সরকারি কর্মকর্তাদের কেউ কেউ আড়াই মিলিয়ন ডলার বা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ২২ কোটি টাকা দিয়ে বাড়ি কিনছেন, তাছাড়া রাজনৈতিকের মেয়ের জামাই, মেয়র, রাজনীতিবিদরা দৃষ্টি নন্দন বাড়ি তৈরি করছেন এখন কানাডায়। বিবিসির একটি সূত্র থেকে জানা যায়, বাংলাদেশ প্রতি বছর যে পরিমান অর্থ বৈদেশিক সাহায্য পায় তার প্রায় তিন গুণ টাকা বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পাচার হয়ে যায়।
২০ জুলাই ২০২০-এর প্রথম আলো এক তথ্য থেকে জানা যায়, শুধু মাত্র সুইজারল্যাণ্ডের সুইস ব্যাংকে জমা পড়েছে, ২০০৪ সালে ৩৬৫ কোটি টাকা ২০০৫ সালে ৮৬৩ কোটি ২০০৬ সালে ১১০৬১ কোটি ২০০৭ সালে ২১৮৭ কোটি ২০০৮ সালে ৯৫২, ২০০৯ সালে ১৩২৬ কোটি ,২০১০ সালে ২১০০ কোটি, ২০১১ সালে ১৩৫৫ কোটি, ২০১২ সালে ২০১৩ সালে ২০৩৮ কোটি ২০১৪ সালে ৩৩১১ কোটি ২০১৫ সালে ৪৫৩৯ কোটি , ২০১৬ সালে ৪৯৭৭ কোটি ২০১৬ সালে ৫৮৮৩ কোটি , ২০১৭ সালে ৪২৮৮ কোটি ২০১৮ সালে ৫৪৯৮ কোটি ২০১৯ সালে ৫৩৬৮ কোটি টাকা। সুইস ব্যাংকে যারা বাংলাদেশে থেকে এই বিপুল অংকের টাকা জমা রাখছেন তাদের আয়ের উৎস কি-তা কখনো সুইজারল্যাণ্ডের সরকার জানতে চান না বা সুইস ব্যাংকও জমাকারীর কাছে থেকে তার আয়ের উৎস কি কি তার বিবরনীও নেয় না। ফলে অসৎ পথে দুর্নীতি, হিরোইন, মাদকের ব্যবসা করে যারা কোটি কোটি কালো টাকা উপার্জন করছে তারাই এই টাকা গুলো জমা রাখতে পারছে সুইস ব্যাংক গুলোতে।
বাংলাদেশ থেকে বিপুল অংকের টাকা পাচার হয়ে কানাডায় চলে গেছে, সেই কালো টাকায় কানাডায় পাচারকারীরা স্ত্রীদের নামে বাড়ি, গাড়ি-জমি জায়গা কিনছেন, ফলে সেখানকার কথিত অভিজাত অনেক এলাকার নাম এখন বেগম পাড়া। বিশ্বের প্রায় ১৯৫ টি উন্নয়নশীল দেশ থেকে টাকা পাচার হয়ে জমা হয়, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অষ্ট্রেলিয়া, সুইজারল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ভুক্ত দেশ সমুহ, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মত দেশ গুলোতে।
সারা বিশ্বের চোর ডাকাত, লুটপাটকারীদের ডাইবদার হলো উল্লেখিত দেশ সমুহ। এদেশের আশ্রয় ও তত্ত্বধায়নে উন্নয়নশীল বিশ্বের প্রায় ২০০ টি দেশে দুবৃর্ত্তায়ন, দুনীর্তি, মাদক ব্যবসা করে কালো টাকা উর্পাজন করে দুনীর্তিবাজরা। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অষ্ট্রেলিয়া, সুইজারল্যান্ড , নিউজিল্যান্ড, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ভুক্ত দেশ সমুহ, সিঙ্গাপুর , মালয়েশিয়া এই দেশ গুলোর অভ্যন্তরীণ নিয়ম শৃংখলা কথা শুনে আমরা বিস্মিত হই, এই দেশগুলোরর আইন কত সুন্দর এবং সুশৃংখল। এই দেশ গুলির মানুষের শৃংখলাবোধ, আইনের প্রতি শ্রদ্ধা নাকি অনুকরণীয়। ঐ দিন এক টক শোতে একজন নীশিকথক বলছেন , কথিত সভ্য দেশ সমুহের আইন শৃংখলার কথা। দেশ গুলির রাস্তায় কোন ট্রাফিক পুলিশ নেই সিগন্যাল বাতি দিয়েই ট্রাফিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রিত হয়, রাস্তাঘাটে কোন জিনিপত্র পড়ে থাকলে কেউ নেয় না, ময়লা আবর্জনা কোন নাগরিকরা যত্রতত্র ফেলে না । স্বর্গের ন্যায় সেখানকার রাস্তাঘাট ও জীবন যাপন প্রণালী । ঐ দেশ গুলোর আইনের শাসনের কথা তুলতে তুলতে এই নিশীকথক মুখে ফেনা তুলে ফেললেন। সুশৃংখল আইনের কথা গুলো শুনে আমার থুতু ফেলতে ইচ্ছা করলো। কারণ এশিয়া, লাতিন আমেরিকার ,আফ্রিকার নিরন্ন,অনাহারী ক্ষুধার্ত, অর্ধ নগ্ন, কংকালসার মানুষগুলোর অর্থ আৎসাতকারীরা এই কথিত আইনের শাসনের দেশ গুলোতে জমা রাখে। এই নিকৃষ্ট দুবৃত্তদের আহরিত অর্থ যারা জমা নিতে পারে তারা প্রকৃতার্থে কতটুকু সভ্য বা সেই দেশের আইনী ব্যবস্থাটা কতটা জনহিতকর বা জনকল্যাকর?
যে দেশগুলিতে টাকা জমা রাখার সময় আয়ের উৎসের কথা বলতে হয় না তাদের আবার আইনের শাসন। বাংলাদেশের মানুষকে ওদের সভ্যতা অনুশীলন করে যারা জ্ঞান দিতে চান তাদেরই বা জ্ঞান কতটুকু আছে? সারা বিশ্বের দরিদ্র মানুষের অর্থ, সম্পদ ও শ্রম লুটপাট করার মুল ডাইবদার হলো কথিত সভ্য যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অষ্ট্রেলিয়া, সুইজারল্যান্ড , নিউজিল্যান্ড, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ভুক্ত দেশ সমুহ, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়ারমত দেশ গুলো এই দেশ গুলোর ছত্রছায়ায় সারা বিশ্বের কথিত স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলির অর্থনীতি চলছে অবাধ লুটপাট। পৃথিবীতে এই কথিত উন্নত বিশ্ব হিসাবে পরিচিত আট থেকে দশটি যদি দেশ না থাকতো তাহলে বাকী বিশ্বের প্রায় ২০৬টি দেশে কোন প্রকার ঘুষ, দুনীর্তি, লুটপাট ও অনায্যতা থাকত না। কারণ লুটপাট করা ও দুনীর্তির কালো টাকা জমা রাখার কোন জায়গা না থাকলে অপরাধও অনেক কমে যাবে। ময়মনসিংহ অঞ্চলেও বলা হয় , ডাইবদার না থাকলে চুরি, ডাকাতি বন্ধ হয়ে যেতো। চুরি করা মাল যদি রাখার জায়গা না পায় চোর তাহলে সে ধরা পড়ার ভয়ে চুরি আর কখনো করবে না। গ্রামের সাধারন মানুষ যেমন প্রভাশালী ডাইবদারদের উৎখাত করতে পারছে না, ঠিক তেমনি বিশ্ব অর্থনীতির লুটপাটকারীদের ডাইবদেরকেও দমন করতে পারছে না বিশ্ব। এই কথিত উন্নত দেশগুলিই বিশ্ব নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায়। বিশ্ব ডাইবদারাই আবার দুনীর্তিগ্রস্থ দেশের তালিকা তৈরি করে।
নিবিঢ় পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, দুনীর্তির মুল উৎসটিই হলো কথিত উন্নত বিশ্ব। তৃতীয় বিশ্বের অবৈধ পথে উপার্জন করা কালো টাকা যদি সুইজারল্যান্ড , কানাডা ,অষ্ট্রেলিযা, যুক্তরাষ্ট্রসহ কথিত উন্নত দেশগুলো জমা না রাখে তাহলে তৃতীয় বিশ্বের দুনীর্তি জিরোতে নেমে আসবে।
দেশের বুদ্ধিজীবিদের উচিত টক শো গুলোতে এসে কথিত উন্নত দেশের জয়গান না করে সেই দেশ গুলো যেন অবৈধ ভাবে পাচার হওয়া কালো টাকা জমা না নেয় সেই সম্পর্কে বিশ্ব জনমত গড়ে তোলা।
লেখক: কলামিস্ট
বাড়ী নং :৩২৫ কাদিরগঞ্জ দরিখোরবোনা, রাজশাহী।
মোবাইল:-০১৭১২০৫৮৬৬৫