স্বপ্নরাজ্য ইউরোপে যেতে গিয়ে তিউনিসিয়া উপকূলে ঝড়ে যায় ৩৭ বাংলাদেশিসহ প্রায় ৭৫ তাজা প্রাণ। সেখান থেকে মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে এসেছেন হবিগঞ্জের লোকড়া গ্রামের আব্দুল হাইয়ের ছেলে মামুন মিয়া। যদিও তিনি বন্ধুকে হারিয়েছেন ভূমধ্যসাগরে। গত ১০ জুন জাতিসংঘের সহায়তায় মায়ের কোলে ফিরতে পেরেছেন তিনি।
বাংলানিউজের সঙ্গে আলাপকালে মামুন বলেন নৌকাডুবির সেই ভয়াল রাতের গল্প। যাতে রয়েছে সমুদ্রের নোনাজলে ভেসে যাওয়া স্বপ্নগাঁথা আর বন্ধুকে বাঁচানোর চেষ্টায় জীবনের ঝুঁকি নেয়াসহ লোমহর্ষক লাশের মিছিলের বর্ণনা।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে মামুন বলেন, দুইদিন মরুভূমিতে থাকার পর প্রায় ৫ কিলোমিটার দৌড়ের পর তাদের নেয়া হয় লিবিয়ার সমুদ্র পাড়ে। তারাসহ অন্তত দুই শতাধিক মানুষ ছিলেন সে যাত্রায়। ৯ মে রাতে নৌকায় করে তিউনিসিয়া উপকূলে। সেখানে মজুদ ছিল দুইটি মাছ ধরা ট্রলার। যেগুলো ইতালীর উদ্দেশে ছেড়ে যায় ১৫ মিনিট অন্তর অন্তর। প্রথমটিতেই উঠেছিলেন মামুন। কিন্তু তার বন্ধু একই গ্রামের মোক্তাদির শারীরিকভাবে দুর্বল থাকায় অনুরোধ করে বলেন, ‘দোস্ত নেমে যা, পরের নৌকা দিয়ে আমরা এক সাথে যাইমুনে।’ বন্ধুর অসুস্থতার কারণে নেমে পড়েন তিনি। এক সঙ্গে জড়ো হন মামুন, মোক্তাদিরসহ একই গ্রামের আব্দুল কাইয়ুম ও নুরুল আমিন। কিছুক্ষণের মধ্যেই নুরুল আমিন বাকি তিন বন্ধুকে রেখে প্রথম নৌকায় উঠে যাওয়ায় তিনি পৌঁছে গেছেন ইতালীতে।
পরবর্তী নৌকায় উঠেন মামুন আর মোক্তাদির। তবে নৌকায় উঠার সময় কাইয়ুমকে দেখতে না পেলেও তাদের অনুমান সেও একই নৌকায় উঠেছিল। একপর্যায়ে গভীর রাতে প্রায় ৭৫ জনকে নিয়ে সমুদ্র পথে চলতে থাকে নৌকাটি। ১৫ মিনিট চলার পরই অতিরিক্ত বোঝাই হওয়ায় উল্টে যায় সেটি। সমুদ্রে পড়ে হাতে হাত ধরে সাঁতার কাটতে শুরু করেন মুক্তাদির আর মামুন। প্রায় দুই ঘণ্টা সাঁতার কাটার পর শারীরিকভাবে একেবারেই দুর্বল হয়ে যান মুক্তাদির। তখন থেকে আরো এক ঘণ্টা বন্ধুকে আগলে রেখে সাঁতার কাটেন মামুন। এসব বলতে বলতে টল টল করে জল চলে আসে মামুনের চোখে।
চোখ মুছতে মুছতে তিনি বলেন, দীর্ঘক্ষণ ধরে তাকে আগলে রেখে আমিও দম নিতে পারছিলাম না। কয়েকবার চেষ্টা করি বন্ধুটাকে কথা বলানোর জন্য। কিন্তু কিছুতেই সে সাড়া দিচ্ছিল না। একপর্যায়ে বুঝতে পারি তার ওজন আগের চেয়ে অন্তত দিগুণ হয়ে গেছে। কোনও উপায় না পেয়ে সমুদ্রেই ছেড়ে দেই বন্ধুর হাত। কয়েক মুহূর্ত পড়েই তাকে আর খুঁজে পাইনি। প্রায় ১১ ঘণ্টা সাঁতার কাটার পর আমিসহ আরো কয়েকজনকে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়া অবস্থায় উদ্ধার করে একটি মাছ ধরা ট্রলার। সাঁতার কাটার সময় সমুদ্রজলে তলিয়ে যাওয়া অনেক লাশের সঙ্গে ধাক্কা লাগার কথাও জানান তিনি।
উন্নত দেশে গিয়ে ভাগ্য বদলের জন্য টগবগে যুবকদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ইউরোপ পাড়ি দেওয়ার নেপথ্য কাহিনী তুলে ধরেন মামুন।
দালালের মাধ্যমে ঝুঁকিপূর্ণ পথে রওনা:
মামুনসহ হবিগঞ্জ সদর উপজেলার লোকড়া গ্রামের হাজী আলাউদ্দিনের ছেলে আব্দুল কাইয়ুম (২২) ও আব্দুল জলিলের ছেলে আব্দুল মোক্তাদির (২২) এবং একই গ্রামের নুরুল আমীন স্মরণাপন্ন হন জেলার বানিয়াচং উপজেলার হিয়াল গ্রামের আদম ব্যবসায়ী গ্রীস প্রবাসী জাহাঙ্গীরের কাছে। প্রায় ৫ মাস আগে মাথাপিছু ৮ লাখ টাকার বিনিময়ে তাদের বিমানে করে ইতালী পৌঁছে দেয়া হবে চুক্তি হয়। শুরুতে দুই লাখ করে টাকা জমা নিয়ে ভারত, শ্রীলঙ্কা ও তুর্কি হয়ে লিবিয়ায় নেয়া হয় মোক্তাদির, কাইয়ুম আর নূরুল আমীনকে। এর প্রায় ১৫ দিন পর একইভাবে ঝূঁকিপূর্ণ এই পথে নেমে যান মামুনও। লিবিয়ায় গিয়ে দেখা হয় ওই তিনজনের সঙ্গে। সেখানে যেতে যেতে সবার কাছ থেকেই প্রায় ১০ লাখ করে টাকা হাতিয়ে নেয় জাহাঙ্গীরসহ দালাল চক্রটি।
অনাহারে অর্ধাহারে কাটানো তিনটি মাস:
কান্নাজড়িত কণ্ঠে মামুন বলতে থাকেন, আমাদের বিমানে করে ইতালী নেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় আদম ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর। কিন্তু লিবিয়া পর্যন্ত বিমানে নিলেও সেখান থেকে হেঁটে এবং নৌকায় করে গন্তব্যে পৌঁছানোর চেষ্টা চালানো হয়। লিবিয়া যাওয়ার পরপরই ৪ তলা একটি ভবনের গ্রাউন্ড ফ্লোরে তাদের তালাবদ্ধ করে রাখা হয় দুই মাস। সেখানে একটি পাউরুটি এবং এক গ্লাস পানি খেয়ে কাটাতে হতো ২৪ ঘণ্টা। তার ওপর দালালদের কথামতো কিস্তির টাকা বাড়ি থেকে নিতে দেরি হলে অমানুষিক নির্যাতন তো রয়েছেই। এক সময় তাদের নেয়া হয় তিউনিসিয়া উপকূলে। সেখানে গিয়ে নৌকায় উঠার কথা বললে তারা প্রশ্ন করেন- আমরা নৌকায় কেন যাব? এরপরই শুরু হয় মারধর। মারধরের ভয়েই সবাইকে উঠতে হয় ইতালীর উদ্দেশে যাওয়া নৌকায়।
মামুন আরো জানান, হবিগঞ্জ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে এইচএসসি পাস করার পর বৃন্দাবন সরকারি কলেজে অনার্স ভর্তি হয়েছিলেন তিনি। ফাইনাল পরীক্ষা রেখেই ইতালী যেতে চেয়েছিলেন। এতকিছুর পরে তিনি ফিরে এসেছেন তার নিজেরই যেন বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। পুনরায় লেখাপড়া করে সরকারি চাকরির চেষ্টা করবেন বলে জানিয়েছেন মামুন।
গত ৯ মে গভীর রাতে লিবিয়া উপকূল থেকে ৭৫ জন অভিবাসীবাহী একটি নৌকা ইতালী পাড়ি জমায়। নৌকাটি তিউনিসিয়া উপকূলে ডুবে গেলে বেশির ভাগ যাত্রী নিহত হন। এর অধিকাংশই বাংলাদেশি।