দেলওয়ার এলাহী
চিত্র ও পদ্যভাষ্য : আজ থেকে প্রায় বিশ বছর আগে টরন্টোয় একটি কাজে আমার সহকর্মী ছিলেন একজন ফলিত পদার্থবিদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত পদার্থে তিনি প্রথম শ্রেণিতে দ্বিতীয় হয়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে শিক্ষকতার চাকুরী দিতে চাইলেও তিনি বিসিএস পাস করে ম্যাজিস্ট্রেট হয়েছিলেন। কিছুদিন চাকুরী করতে গিয়ে স্থানীয় রাজনৈতিক ক্ষমতাদরদের ক্রমাগত দুর্নীতি ও তাদের সুবিধা আদায়ের চাপ তাকে অতিষ্ঠ করে তুলে। তিনি ছিলেন সততার অনন্য উদাহরণ। কিন্তু ক্ষমতাশালীরা নিজেদের সুবিধা আদায়ের জন্য তাকেও দুর্নীতিতে জড়িয়ে ফেলার নানান ফন্দিফিকির করতে থাকে। তিনি বুঝতে পেরেছেন অন্তত তার দ্বারা সৎ থেকে এদের সঙ্গে পেরে উঠবেন না। শেষ পর্যন্ত তিনি কানাডার প্রবাস জীবন বেছে নিয়েছেন। কাজের ফাঁকে ফাঁকে তার এইসব গল্প শুনতাম। দেখতাম সময় পেলেই তিনি কাগজে ছবি আঁকছেন। ছড়া লিখছেন৷ ফলিত পদার্থের ছাত্র হয়েও তার মনপ্রাণ জুড়ে ছিল শিল্প সাহিত্য। সুন্দর ছবি আঁকতেন, চমৎকার ছড়া লিখতেন। আমি তাকে মুরাদ ভাই ঢাকতাম।
একবার টরন্টোয় আমাদের এলাকার স্থানীয় একটি সংগঠনের আয়োজনে পিকনিকে তাকে নিমন্ত্রণ করি৷ সেই নিমন্ত্রণে বিশেষ অতিথি ছিলেন একজন প্রখ্যাত কবি৷ পিকনিকের আয়োজনের ফাঁকে কবিকে নিয়ে আমি পানির কাছে বিশাল বিশাল পাথরের উপরে বসলাম। মুরাদ ভাইয়ের ছবি আঁকার জন্য আমি একটি খাতা ও অনেক ধরনের রঙিন কালির কলম নিয়ে গিয়েছিলাম। পাথরে বসা কবিকে দেখিয়ে মুরাদ ভাইকে অনুরোধ করেছিলাম – কবির স্কেচ করে এঁকে দিতে। কলম দিয়ে খাতায় কবির স্কেচ শুরু করতেই খাবাবের জন্য আমাদের ডাক পড়ে। কবি যেহেতু বিশেষ অতিথি, তাই অন্যান্য অতিথিরাও খাবার নিয়ে আমাদের অপেক্ষা করছিলেন। অগত্যা তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে আমাদেরকে খাবারের জন্য যেতেই হলো। মুরাদ ভাই খুব দ্রুত কলম চালিয়ে কবির এই স্কেচটি সম্পন্ন করার আগেই আমাদের উঠতে হয়েছিল।
বিশ বছর আগে হলেও কবির স্বাস্থ্য ও শারিরীক কাঠামো ঠিক আগের মতোই আছে৷ কিন্তু এক মর্মান্তিক সড়ক আমার প্রিয় মুরাদ ভাইয়ের জীবন পুরোপুরি বদলে যায়। দুর্ঘটনায় তার স্ত্রী ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান। একমাত্র কন্যার হাড় ভেঙ্গে যায়। মুরাদ ভাই পুরোপুরি পঙ্গু হয়ে যান। কন্যাটি এখন পুরোপুরিভাবে সুস্থ৷ তিনিও ক্রাচের মাধ্যমে চলাফেরা করতে পারেন নিরুদ্বিগ্ন। মুরাদ ভাইয়ের স্ত্রী অর্থাৎ ভাবি ছিলেন অসাধারণ একজন ভালো মানুষ। মিশুক। হাসিখুশি। আমাদের বাসায় আসতেন। আমার রান্না পছন্দ করতেন। আর মুরাদ ভাই জগতের নিরুপদ্রব একজন মানুষ। অজাতশত্রু। পৃথিবীর যে কোন সমস্যাকে সহজভাবে নেওয়ার এক অতিমানবীয় গুণের অধিকারী।
গতকাল বইয়ের ভাঁজ থেকে এই খাতাটি বের করেছিলাম কবি মন্দাক্রান্তা সেনকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাবো বলে৷ মন্দাক্রান্তা সেনকে নিয়ে আমার ছোট্ট একটি কবিতা আছে। বিশ বছর আগের লেখা। আরো বেশ কিছু লেখার সঙ্গে মন্দাক্রান্তাকে নিয়ে লেখা কবিতাটিও সেই খাতাতেই। খাতার পৃষ্ঠা উল্টানোর সময় মুরাদ ভাইয়ের আঁকা কবির এই স্কেচটা চোখে পড়লো। আর কি আশ্চর্য, কবি কিন্তু ছবিতে আঁকা স্কেচের মতোই আছেন : নির্মেদ। একহারা। প্রাণবন্ত। প্রেমিক। শুধু বদলে গেলো মুরাদ ভাইয়ের জীবন! মুহূর্তেই মুরাদ ভাইয়ের মুখটি আমার চোখের সামনে ভেসে উঠলো। আহা, জীবনের চক্র মানুষের জীবনকে কত কিছুর সম্মুখীন করতে পারে মুহূর্তেই! কত অজানা আশংকার কারণ আমাদের চারিদিকে ঘিরে আছে সারাক্ষণ! মুহূর্তেই আমাদের সাজানো জীবনের ছবিটায় দাগ পড়ে যেতে পারে! প্রতিদিনের জীবন যাপনের পাশের মানুষটিও এক লহলায় স্থির হয়ে যেতে পারেন, শুধুমাত্র দেয়ালে টাঙানো ফ্রেমের ভেতরের ছবিতে! তা হয়ে যাবার আগেই আমরা জীবনের সোনালি মুহূর্তগুলোকে ভালোবাসার সোনালি কবজে ভরে মূল্যবান করে তুলতে পারি না!
মুরাদ ভাই ও কবির কথা মনে করেই ছবিটি ফেইসবুকে রাখতে চাইলাম। ভাবলাম, শুধু কি আর এই উদোম স্কেচটি দেওয়া যায়! তাই, কাঁচা হাতে কয়েক লাইন পদ্যও জুড়ে দিতে চাইলাম। পদ্যের ভেতরের গল্পটি কিন্তু শুধুই আমার উদ্ভট কল্পনা।শিল্পীর আঁকা এই অসমাপ্ত ছবির মডেল : কবি ইকবাল হাসান