রাজধানীর পল্লবী থেকে নিখোঁজ তিন কলেজ শিক্ষার্থীকে মিরপুর বেড়িবাঁধ থেকে উদ্ধার করেছে র্যাব।
বুধবার (৬ অক্টোবর) বিকেলে র্যাব-৪ এর অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি মোজাম্মেল হক রাইজিংবিডিকে এ তথ্য নিশ্চিত করেন।
তিনি বলেন, ‘বুধবার ভোরে মিরপুর বেড়িবাঁধ এলাকা থেকে ওই তিন শিক্ষার্থীকে উদ্ধার করা হয়।’
এর আগে ৩০ সেপ্টেম্বর (বৃহস্পতিবার) সকালে পল্লবী এলাকার নিজ নিজ বাসা হতে স্নেহা আক্তার (১৬), কাজী দিলখুশ জান্নাত নিশা (১৫) এবং কানিজ ফাতেমা (১৬) নামের কলেজ শিক্ষার্থী নিখোঁজ হয়।
তাদের উদ্ধারের পর বুধবার বিকেলে র্যাব-৪ এর পক্ষ থেকে একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। তাতে জানানো হয়— পল্লবীর বহুল আলোচিত টাকা, স্বর্ণালংকার ও সার্টিফিকেট নিয়ে নিখোঁজ হওয়া তিন ছাত্রীকে মিরপুর বেড়িবাঁধের শেষ প্রান্ত আবদুল্লাহপুর এলাকা হতে উদ্ধার করা হয়েছে।
তিন শিক্ষার্থী নিখোঁজ হওয়ার পর কাজী দিলখুশ জান্নাত নিশার বড় বোন অ্যাডভোকেট কাজী রওশন দিল আফরোজ বাদী হয়ে সন্দেহভাজন চার জনসহ অজ্ঞাতনামা চার-পাঁচজনকে আসামি করে পল্লবী থানায় অপহরণ মামলা করেন। এ ঘটনায় পুলিশের পাশাপাশি র্যাব-৪ এর একটি গোয়েন্দা দল ছায়া তদন্ত শুরু করে।
র্যাব-৪ এর গোয়েন্দা দল, গোপন তথ্য এবং কক্সবাজারে থাকা র্যাব-৪ এর টিমের মাধ্যমে জানা গেছে- নিখোঁজ তিন শিক্ষার্থী ৫ অক্টোবর রাত ৯টার দিকে ছদ্মবেশে কক্সবাজার থেকে বাসে করে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হয়।
প্রাপ্ত গোপন তথ্যের ভিত্তিতে র্যাব-৪ এর একটি আভিযানিক দল ৬ অক্টোবর ভোরে বেড়িবাঁধ এলাকা থেকে তাদের উদ্ধার করে।
ঘটনার অনুসন্ধান ও ভিকটিমদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, তারা তিন জন বান্ধবী। মিরপুরের স্থানীয় বিভিন্ন কলেজে তারা লেখাপড়া করেন। করোনার কারণে দীর্ঘদিন ঘরে বন্দি থাকার সময় তারা বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন অপসংস্কৃতিতে আসক্ত হয়ে পড়ে। লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহও হারিয়ে ফেলে।
এ কারণে তাদের পরিবার পড়াশোনা ও ধর্মীয় বিধি বিধান মেনে চলার জন্য চাপ দিত। পারিবারিক নানা বিধি-নিষেধের কারণে তারা নিজ নিজ পরিবারের প্রতি বিরক্ত হয়ে পড়ে।
জিজ্ঞাসাবাদে আরও জানা যায়, তাদের নিজেদের পরিবারের নিয়ম-কানুন ভালো লাগত না। এসব সামাজিক ও ধর্মীয় নিয়ম কানুন তাদের কাছে অত্যাচার মনে হতো। তারা মূলত উচ্চাভিলাসী জীবন-যাপন পছন্দ করত। দীর্ঘদিন বাসায় আবদ্ধ থাকার সময় তারা পশ্চিমা সংস্কৃতি বিশেষ করে জাপানী সংস্কৃতির প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে।
বেশি বেশি জাপানী সিনেমা-সিরিয়াল ও সাংস্কৃতিক প্রোগাম দেখে দেখে জাপানী ভাষা কিছুটা আয়ত্ব করে। তারা দেশ ছেড়ে স্বাধীন জীবন-যাপন ও উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে জাপান যাওয়ারও পরিকল্পনা করে। জাপানী সংস্কৃতিতে নারী পুরুষের সম-অধিকার, স্বাধীনতা ও দত্তক হওয়ার সুযোগ রয়েছে। তাছাড়া অন্যান্য ধর্মীয় ও সামাজিক বিধি-নিষেধ তেমন নেই। এ কারণে তারা জাপান যাওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়।
দুই মাস আগে তাদের বন্ধু তরিকুলের সঙ্গে দিয়াবাড়ী এলাকায় ঘুরতে যায় তিন বান্ধবী। সেখানে জনৈক হাফসা চৌধুরী (২৪/২৫) নামে এক নারীর সঙ্গে তাদের পরিচয় হয়। তার সঙ্গে আলোচনার এক পর্যায়ে তারা জাপানে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে। হাফসা চৌধুরী তাদেরকে ফেসবুকের মাধ্যমে যোগাযোগ রাখার কথা বলে।
হাফসার সঙ্গে পরিকল্পনা করে তিন বান্ধবী কক্সবাজার রুট দিয়ে নৌপথে জাপান যাবে বলে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়। সেই উদ্দেশ্যে তারা ৩০ সেপ্টেম্বর সকালে রিকশায় করে প্রথমে গাবতলী যায়। হাফসার পরামর্শে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী যেন তাদের অবস্থান চিহ্নিত না করতে পারে- সেজন্য তারা নিজেদের ই-মেইল, ফেসবুক আইডি এবং ব্যবহৃত মোবাইল গাবতলী এলাকায় ধ্বংস করে।
পরবর্তীতে তারা নৌকায় করে নদী পার হয়ে আমিন বাজার এলাকায় পৌঁছায়। সেখানে হাফসার দুজন লোক একটি কালো রঙের নোয়া কারে করে তাদের অজ্ঞাত স্থানে নামিয়ে দেয়। সেখান থেকে সিএনজি অটোরিকশায় করে তাদের কমলাপুর রেলস্টেশনে নেওয়া হয়। ট্রেনে করে তাদের চট্টগ্রামে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।
তিন বান্ধবী ওই লোকগুলোর কথামতো কমলাপুর রেলস্টেশনে যায়। তবে সেসময় চট্টগ্রামগামী কোনো ট্রেন ছিল না। পরে বাসে করে কুমিল্লার ময়নামতি যায় তারা। সেখানে নিজেদের পরিচয় গোপনের উদ্দেশ্যে ও পশ্চিমা সংস্কৃতির আদলে নিজেদের চুল কেটে ফেলে তিন বান্ধবী। পশ্চিমা ধাচের পোশাকও পরে।
কুমিল্লার ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট এলাকা থেকে তারা কেডস, পোশাক এবং একটি মোবাইল কেনে। সেখান থেকে তারা আবার বাসে চড়ে। চট্টগ্রাম সিনেমা প্লেস বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে সেখান থেকে আরও দুটি মোবাইল কেনে। আবারও বাসে চড়ে এবং কক্সবাজারে পৌঁছায়। তবে আত্মগোপনে থাকার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় কোনো সিম কেনেনি।
কক্সবাজার পৌঁছে তারা ১ অক্টোবর থেকে ৫ অক্টোবর পর্যন্ত কক্সবাজারের কলাতলিতে একটি হোটেলে অবস্থান করে। সিমের পরিবর্তে তারা ওয়াইফাই সংযোগ ব্যবহার করে। ২ অক্টোবর তারা কক্সবাজার বিচ এলাকায় বেড়াতে যায়। সেখানে হাফসার লোক বলে পরিচয় দিয়ে আসিফ ও শফিক নামের ৩০/৩২ বছরের দুই লোক তাদের কাছে থাকা স্বর্ণালংকার ও কিছু নগদ টাকা নিয়ে নেয়। এ ঘটনার পর তারা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে এবং হোটেলে অবস্থান নেয়।
এদিকে হোটেলের আশেপাশে র্যাবের উপস্থিতি টের পেয়ে ৫ অক্টোবর রাতে ঢাকায় ফিরতে বাসে চড়ে। ৬ অক্টোবর ভোরের দিকে তাদেরকে মিরপুর বেড়িবাঁধ এলাকা থেকে উদ্ধার করে র্যাব-৪। পরে তাদের র্যাব কার্যালয়ে নেওয়া হয়।
হাফসা নামের ওই নারী, নোয়া কারে থাকা দুই ব্যক্তি এবং কক্সবাজারের সৈকত এলাকায় স্বর্ণালংকার ছিনিয়ে নেওয়া দুই ব্যক্তিসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে গ্রেপ্তারের অভিযান অব্যাহত রয়েছে বলে জানায় র্যাব।