হিমাদ্রী রয় সঞ্জীব
আমাদের জশোয়া (জশ) তার অটিজম যুদ্ধ জয়ের ৯ বছর পার করেছে, গেলো ডিসেম্বরের ২৭ তারিখে। এই নয় বছরে সে অনেক কিছু জয় করেছে শুধু বহির্জগতের পারিপার্শ্বিকতা ছাড়া। তাই ডিসেম্বরের খ্রিষ্টমাস ট্রির জিঙ্গল বেল, স্নো ম্যানের ঝিলিক, ফ্রুট কেকের ওপর মোমবাতি ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে উইশ করা কোন কিছু এখনো মাইনে রাখে না তার জীবনে।এই নয় সংখ্যাটির ওপর আমার একটি আস্থা আছে। ৯ মাস যুদ্ধ করে আমাদের অগ্রজরা বাংলাদেশটা স্বাধীন করেছিলেন। না কোন দৈব ঘটনা নয়, তাদেরকে যুদ্ধ করতে হয়েছিল তবেই একটা স্বাধীন দেশে আমরা জন্মেছি। জশের ও নিজের একটা যুদ্ধ আছে, অটিজমের সঙ্গে যা এখনো চলমান। প্রতিনিয়ত সে যুদ্ধ করে চলেছে তার নিজের সঙ্গে, স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার।
একটি স্বাভাবিক শিশু যেমন বহির্জগত আর মনোজগতের মধ্যে সামঞ্জস্য রেখে চলে, সেখানে একটি অটিজম শিশু, শুধু মনোজগতেই তার বিচরণ। জশের ব্যতিক্রম এখনো ঘটাতে পারেনি। ধরি তার শিশুকাল টা যদি একেবারে স্বাভাবিক হতো, জশ কি জানতো রামায়ণের হনুমান কেন শিশুদের প্রিয়? মহাভারতের পরাক্রমশালী ভীমকে কেন বাচ্চারা ভয় পায় না? কিংবা মোহাম্মদের মুখে, চিনি ছড়ানোর গল্প? না শিশুরা এখন আর তা জানে না; আমরা জানাতে ও চাই না। এখন শিশুদের বিজ্ঞানমনস্ক করে তোলার সমস্থ উপাদান চারপাশে। তাই বহির্জগতে নিজেকে অনুসন্ধিৎসু করার অক্ষমতায় যেমন একজন অটিজম শিশু তার শিশুকাল থেকে বঞ্চিত তেমনি মাথা ঘামানোর সমস্ত উপাদান দিয়ে মাথা ধরিয়ে স্বাভাবিক শিশুদের ও করা হচ্ছে শিশুকাল থেকে বঞ্চিত। সেই দিক থেকে এখন কারোরই শিশুকাল নেই। সুতরাং মা-বাবারা একটু ভাবুন যারা স্বাভাবিক শিশু বড় করছেন আর আমরা যারা অটিজম শিশুদের বড় করছি, চেষ্টা করি তাদের যেটুকু সক্ষমতা আছে সেটুকুকেই ভালবাসতে।
অটিজম শিশুদের এখন আর ডিসঅর্ডার বলা হয় না বলা হয় কন্ডিশন। সেদিন গ্রোসারি ষ্টোরে ঘুরছি হঠাৎ আমার সামনে একটা ছেলে এমন ভাবে দুই হাত তুলে হাই তুললো, বেশ বিরক্ত হলাম এবং কমেন্ট ও করে ফেললাম; ভুল ভাঙলো বউয়ের কথায়। পেছন থেকে যখন সে বললে ‘ডোন্ট ইউ সি, হি হেস এ কন্ডিশন’ খেয়াল করার পর অপরাধ বোধ হলো। তাই একটু খেয়াল দরকার এই বাচ্চাদের খামখেয়ালিতে আর এদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি হতে হবে আনকন্ডিশনাল ভালবাসা যা তারা পেতে চায়।
ভালবাসা আনকন্ডিশনাল? মানে যে যেরকম অবস্থায় আছে তাকে সেই অবস্থায় ভালবাসা। শুধু বললে হবে, দেখলে হবে? ভাবুন তো আপনি যাকে ভালবাসেন তাকে কেন ভালবাসেন? কারণ তার সব কিছুই ভাল। আবার একজনের অনেক কিছু ভালো তাই আমি তাকে ভালবাসি। ভালবাসায় প্রত্যাশা থাকবেই। আপনার বাচ্চার প্রতি ভালবাসা, সেখানেও উচ্চাকাঙ্খা লুকিয়ে থাকে। বড় হয়ে ডাক্তার হবে ইঞ্জিনিয়ার হবে। যখন আপনি জানেন এই উচ্চাকাঙ্খা তো দূর তাকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে যেয়েই যুদ্ধ করতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত এবং এটাকে মেনে নিয়ে ভালবাসার যে জীবন তাই প্রত্যাশাহীন। একজন অটিজম শিশু পারে সেই ভালবাসা শেখাতে। তাদের কল্পনার রাজ্যে প্রবেশ করে দেখুন, কোন বিশেষ বিষয়ে তার মনোযোগ। কোন উচ্চাকাঙ্খার প্রত্যাশা নয়, নয় কোন দাবি দাওয়া, তার যা আছে শুধু তাই কাছে পাওয়া, তবেই হবে অটিজম শিশুর প্রতি হাত বাড়িয়ে দেওয়া।
অটিজমের ক্ষেত্রে প্রাথমিক লক্ষণ যেমন শিশু কথা বলতে পারে না, অন্যদের সঙ্গে মেশে না, প্রচণ্ড জেদি, চট করে রেগে যায়, ঘুমাতে চায় না, মা-বাবার কাছে আসতে চায় না, চোখে ঝাপসা দেখে। এই কেতাবি কথা অনেকাংশে হয়তো ঠিক তবে আপনার অটিজিম শিশুটিকে আপনার জীবনের অভিজ্ঞতায় দেখুন তাহলে শিশুর বিকাশের ক্ষেত্রে সহায়ক হবে। কারণ প্রতিটি শিশুর সিন্ড্রম ভিন্ন। যেমন জশকে আমরা স্পিচ থেরাপিতে নিয়ে যাই প্রতি সপ্তাহে কিন্তু তার মধ্যে প্রচণ্ড জেদ কাজ করে না। ঠিক সময় ঘুমায় আবার ঠিক সময় উঠে। সে প্রতিনিয়ত ছুটা-ছুটি করে কিন্ত বললে থেমে যায়। আবার করে তাই বার-বার করেই বলতে হবে এ জায়গাটিতেই ধৈর্যের পরীক্ষা। মায়েরা তাদের প্রতিদিনের গৃহস্থালি কাজ করতে পারেন তাদের সঙ্গে নিয়ে। জশকে প্রতিদিন কোন না কোন কাজ দেওয়া হয় যেমন ধোয়ার পর কাটলারি গুলো অর্গানাইজারে রাখা, গ্রোসারির পর তার নিজের ক্যান ফুড নিজেকে সেলভে তুলে রাখা, স্কুল থেকে এসে ব্যাগ ঠিক জায়গায় রাখা, ড্রেস নিজে নিজে চেঞ্জ করা আজকাল বললে পরে সে নিজে পেস্ট এবং ব্রাস এগিয়ে নিয়ে আসে, পেস্ট লাগিয়ে দিলে নিজেই ব্রাস করে; ঠিক হয় না তবু করাতে হবে। এইটুকু ও রাতারাতি হয়নি তার জন্যে পেরুতে হয়েছে দীর্ঘ পথ পরিক্রমা। দুই বছর বয়সে যখন সে ডায়গ্নোজড হয় তখন শত ডাকাডাকি, কোন হট্ট্রগোলই তার ভ্রুক্ষেপ ছিলো না। সেই থেকে আজকের জায়গায় আসতে তার আটটি বছরের সংগ্রাম করতে হয়েছে। এই সংগ্রামের অন্তঃস্থলে আশিন কোন ঈশ্বর নয়, নয় কোন দৈববাণী না কারো রহমত। ছিলো অক্যুপেশনাল থেরাপি, জেনেভা সেন্টারের আই,বি,এ প্রোগ্রাম এটেন্ড করা আর বিশেষ করে তার মায়ের ক্লান্তিহীন আন্তরিক চেষ্টা।
তবে এগুলো সবই রুটিন কাজ। রুটিনের বাইরে যেয়ে চিন্তার স্তরে সে এখনো উন্নিত করতে পারেনি এবং এটাই অটিজম শিশুদের সবচেয়ে বড় চ্যেলেঞ্জ।
আশার কথা নিউরোলজিক্যাল ডেভেলপমেন্ট নিয়ে এখন কাজ হচ্ছে প্রচুর। বেঙ্গালুরুর ‘ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োলজিক্যাল সায়েন্স এর অধ্যাপক এবং অধিকর্তা সুমন্ত্র চট্রোপাধ্যায়র (সোনা) আর্টিকেল পড়ে জানলাম। আমাদের মস্তিস্ক ও মেরুদণ্ডে নিউরন ছাড়াও রয়েছে ‘গ্লায়াল কোষ’। সংখ্যায় সাড়ে ৮ হাজার কোটি। একই সংখ্যায় নিউরন রয়েছে আমাদের মস্তিস্ক ও মেরুদণ্ডে। গ্লায়াল কোষগুলো ঘিরে থাকে নিউরনগুলোকে। এদেরকেই বলা হয় আদার ব্রেন সেল। আমাদের নিউরনগুলোকে সুস্থ, সবল, সক্রিয় রাখতে বড় ভূমিকা নেয় এই গ্লায়াল কোষগুলো। এরাই নিউরনগুলোকে সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকার রসদ জোগায়। একটি নিউরন থেকে অন্য নিউরনে বার্তা (সিগন্যাল বা অ্যাকশন পোটেনশিয়াল), যার মাধ্যমে শরীরের বিভিন্ন অনুভূতি ও কাজকর্ম হয়) পাঠানোর সহায়ক হয় এই গ্লায়াল কোষ। চামড়া থেকে ব্রেনসেল (কোষ) বানিয়ে অটিজম সারানোর হদিশ দিয়ে এর ওপর আলো ফেলেছেন বঙ্গসন্তান সুমন্ত্র। তবে যা এখনো সমুদ্রে নুড়ি খোঁজার মত।
মানুষের অগ্রযাত্রা বন্ধ করে সাধ্য কি কারো আছে? একদিন অটিজম ও পরাজিত হবে মানুষের কাছে। আজকের ৯ বছরের জশের জন্য যে জীবন যুদ্ধের, ভবিষ্যতের অটিজম পথ পরিক্রমা হবে মসৃণ। দিনে দিনে কষ্ট করে যারা সভ্যতা তৈরি করেছে যে অতীত, আমরা বর্তমান তারই সুবিধাভোগী।
তাই অটিজম আক্রান্ত শিশুদের পাশে দাঁড়ান দোয়া দিয়ে,দাওয়া নিয়ে নয়। পাশে দাঁড়ান সহমর্মিতা নিয়ে, একটু বোঝতে চেষ্টা করুন maybe he or she has conditions.আর অটিজম শিশুর মা-বাবা। শিশুটিকে ভালবাসুন কোন প্রত্যাশা থেকে নয়, যেমন আছে তেমনটি গ্রহন করুন দেখবেন সব থেকে সুন্দর দিন আপনার অপেক্ষায় আছে, সব থেকে সুন্দর শিশু আপনার ঘরেই বেড়ে উঠছে।
আশা নয় এ আমার বিশ্বাস অটিজম নামের অন্ধকারের কিনারা ভেদ করে ওরা একদিন আলোর মুখ দেখবে আর যদি তা নাও হয়, যখন সে হাসে যেন পৃথিবী থেমে থাকে ক্ষণকালের তরে, নেই কোন অভিযোগ, চাইনা কোন দয়ার ঈশ্বর শুধু যেন পাই তারে ভালবাসিবার অবসর।
তথ্য- আনন্দ বাজার পত্রিকা।