সোনা-রুপার আংটি দিয়ে মোড়ানো লাল কাপড় বেঁধে দেওয়া হয় গরুর গলায়। পরে সেই গরু ছেড়ে দেওয়া হয় গ্রামবাসীর উদ্দেশ্যে। গরুটি যিনি প্রথমে পাবেন বা কারও বাড়িতে উঠলে সেটি তার হবে। তবে, কোনও আত্মীয়স্বজনের ক্ষেত্রে এ নিয়ম প্রযোজ্য হবে না। এছাড়া, তিনদিন ধরে চলে মাদারের (আঞ্চলিক ভাষা) পালা গান। একইসঙ্গে চলে খাওয়া-দাওয়া। এরপর পালকিতে চড়ে পুরো গ্রাম ঘুরে কনের বাড়িতে যান বর।
শুক্রবার (২০ অক্টোবর) এভাবেই পাবনার চাটমোহর উপজেলার ছাইকোলা ইউনিয়নের কাটেঙ্গা নদীপাড়া গ্রামের সাইফুল ইসলামের (৩২) ব্যতিক্রমী বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়েছে।
জানা যায়, সাইফুল ইসলাম ক্ষুদ্র কৃষক উন্নয়ন ফাউন্ডেশনে (এসএফডিএফ) চাকরি করেন। তিনি যখন পালকিতে চড়ে কনের বাড়িতে যান, শতাধিক উৎসুক জনতা তখন সাইফুলকে একনজর দেখতে ভিড় করেন।
সাইফুল ইসলাম ও তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সাইফুল ইসলামের বাবা ছিলেন ব্যবসায়ী। মা খোদেজা বেওয়া গৃহিণী। খোদেজা বেওয়া বিয়ের পর একে একে জন্ম দেন ৮ সন্তান। তবে, অজানা রোগে সব সন্তানই মারা যায়। একটা সন্তানের আশায় পাগলপ্রায় হয়ে পড়েন খোদেজা বেওয়া। মানসিকভাবে ভেঙে পরে পুরো পরিবার।
এরপর খোদেজা বেওয়ার শাশুড়ি ময়না খাতুন নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলায় মেয়ের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে জানতে পারেন, সেখানকার শীতলী চরলালি মসজিদে ভেজা কাপড়ে গিয়ে আল্লাহর কাছে মানত করলে মনোবাসনা পূরণ হয়।
লোকমুখে শুনে ময়না খাতুন ওই মসজিদে গিয়ে ভেজা কাপড়ে দুই হাত তুলে আল্লাহর কাছে বলেন, যদি ছেলের বউয়ের কোনো সন্তান হয় এবং বেঁচে থাকে তবে সেই সন্তানের বিয়ের সময় সোনা-রুপার আংটি দিয়ে মোড়ানো লাল কাপড় গরুর গলায় বেঁধে গ্রামবাসীর উদ্দেশ্যে ছেড়ে দেওয়া হবে। সেই সঙ্গে হবে মাদারের গান এবং পালকিতে চড়িয়ে পুরো গ্রাম ঘুরিয়ে বিয়ে করানো হবে সেই সন্তানকে। আর বরযাত্রীদের খাসি জবাই করে খাওয়ানো হবে।
মানতের কিছুদিনের পর সাইফুল ইসলামের জন্ম হয়। এরপর খোদেজা বেওয়ার কোল আলো করে আসে আরও তিন সন্তান। এর মধ্যে, কেটে যায় ৩২ বছর।
পৃথিবীর ছেড়ে চলে যান সাইফুলের দাদি ময়না খাতুন ও বাবা খাদেমুল ইসলাম। অবশেষে দাদির সেই মানত রাখতে নানা আয়োজনের মধ্যে বিয়ের পিঁড়িতে বসেন সাইফুল ইসলাম। কনে একই উপজেলার বরদানগর মরশিন্দা গ্রামের বাচ্চু মিয়ার মেয়ে মায়া খাতুন।
সাইফুল ইসলাম বলেন, দাদির মানত রাখতে এভাবে বিয়ের আয়োজন করতে হয়েছে। সব মিলিয়ে প্রায় দুই লাখ টাকা খরচ হয়েছে। আত্মীয়স্বজন সবাইকে নিয়ে খুব আনন্দ হয়েছে। আর পালকিতে চড়ে বিয়ে করা শুধু শুনেছি, এবার নিজে সেই আনন্দ উপভোগ করলাম।
সাইফুলের মা খোদেজা বেওয়া বলেন, আমার শাশুড়ি বেঁচে থাকতে এই মানত করেছিলেন। তিনি মৃত্যুর আগে বলে গেছেন, যেভাবে মানত করেছি সব ঠিকমতো পালন করবা। তার সেই মানত পূরণ করলাম। আল্লাহ আমাদের ভালো রেখেছেন, সন্তানদের সুস্থ রেখেছেন।
কনে মায়া খাতুন বলেন, আমি শুনেছি, দাদির মানত রাখতে এভাবে বিয়ের আয়োজন করেছেন তারা। আমাদের বাড়িতেও আনন্দ উৎসব হয়েছে। আমরা খুশি। সবাই দোয়া করবেন, যেন আমরা সুখী হতে পারি। শ্বশুরবাড়ির সবাইকে নিয়ে ভালো থাকতে পারি।
সাইফুল ইসলামের শ্বশুর বাচ্চু মিয়া বলেন, আনন্দ উৎসবে মেয়ের বিয়ে হওয়ায় সবাই খুশি। পালকিতে বিয়ে করতে আসায় গ্রামের মানুষজন দেখতে আসেন। বাবা হিসেবে সবার দোয়া চাই, যেন মেয়েটা সুখী হয়।
ছাইকোলা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নুরুজ্জামান নুরু বলেন, ব্যতিক্রমী এই বিয়ে অন্যমাত্রা এনে দিয়েছে। পুরো গ্রামবাসী উপভোগ করেছেন সাইফুল ইসলামের বিয়ে।