আগামী জানুয়ারির শুরুতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ইতোমধ্যে নির্বাচনি কার্যক্রম ধাপে ধাপে সম্পন্ন করে এগুচ্ছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এরইমধ্যে গত ২১ আগস্ট ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) পক্ষ থেকে বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষণে পূর্ণাঙ্গ পর্যবেক্ষক দল না পাঠানোর ঘোষণা দেওয়ায় নতুন ‘টেনশনে’ পড়েছে ইসি। পাশাপাশি পর্যবেক্ষক হিসেবে দেশি-বিদেশি নিবন্ধনকৃত সংস্থাগুলো আসন্ন নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করবে কি না, তা নিয়েও চিন্তিত ইসি।
এদিকে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) পর্যবেক্ষক দলের বিকল্প খুঁজতে এবং পর্যবেক্ষক বাড়াতে বিভিন্ন দেশের সাথে যোগাযোগ শুরু করেছে ইসি। আসন্ন সংসদ নির্বাচনে পর্যবেক্ষক বাড়াতে ফের বিজ্ঞপ্তি শিগগিরই প্রকাশ করবে ইসি।
নির্বাচন কমিশন সূত্র জানায়, কোনও দেশি সংস্থা নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করতে চাইলে তাদের পর্যবেক্ষক সংস্থা হিসেবে নির্বাচন কমিশন থেকে নিবন্ধন নিতে হয়। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে পর্যবেক্ষক সংস্থার নিবন্ধনের জন্য ইসি এর আগে আবেদন আহ্বান করেছিল। গত ২ ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্ধারিত সময়ে ২১০টি আবেদনের মধ্যে যাচাই-বাছাই শেষে দেশি-বিদেশি ৬৮টি সংস্থাকে নিবন্ধনযোগ্য হিসেবে নির্বাচিত করে ইসি।
প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত ৬৮টি সংস্থার বিরুদ্ধে কোনও আপত্তি থাকলে তা লিখিতভাবে জানাতে বলেছিল কমিশন। নির্ধারিত সময়ে দুটি সংস্থার বিষয়ে আপত্তি আসে। এই আপত্তি নিয়ে শুনানি করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে ইসি। বাকি ৬৬টি সংস্থা নিবন্ধন চূড়ান্ত।
বিগত নির্বাচনের চেয়ে এবার পর্যবেক্ষক সংস্থার সংখ্যা অনেক কম। তাই এই সংখ্যা বাড়াতে আবার আবেদন আহ্বান করতে এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনাররা আলোচনা করেছেন। চলতি সপ্তাহে পর্যবেক্ষক বাড়াতে গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হবে।
নির্বাচন কমিশনার মো. আহসান হাবীব খান বলেন, বর্তমান কমিশন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যাপারে সবসময়ই আন্তরিক। এ কারণে নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষক দিয়ে নির্বাচন পর্যবেক্ষণের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। কমিশন চায়, উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পর্যবেক্ষক আগামী জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষণে থাকুক। স্বচ্ছতা ও জনগণের আস্থা অর্জনের জন্য এটি প্রয়োজন। কিন্তু এবার এখন পর্যন্ত নিবন্ধনযোগ্য স্থানীয় পর্যবেক্ষক সংস্থার সংখ্যা আগের তুলনায় কম। তাই এই সংখ্যা আরও বাড়ানো দরকার বলে মনে করে কমিশন।
ইসি সূত্র জানায়, ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যবেক্ষণে ছিলেন ৮১টি দেশীয় সংস্থার ২৫ হাজার ৯০০ জন প্রতিনিধি। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ২০০৮ সালে স্থানীয় পর্যবেক্ষক সংস্থার নিবন্ধনের পদ্ধতি চালু করা হয়। বিষয়টি জাতীয় নির্বাচনসংক্রান্ত আইন গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশে সংযোজন করা হয়। ইসি একটি স্থানীয় পর্যবেক্ষক নীতিমালাও তৈরি করে। ২০০৮ সালে প্রথমবারের মতো ১৩৮টি সংস্থাকে পর্যবেক্ষক হিসেবে নিবন্ধন দিয়েছিল ইসি। এর মধ্যে ৭৫টি সংস্থার ১ লাখ ৫৯ হাজার ১১৩ জন পর্যবেক্ষক নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেছিলেন।
এর আগেও দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষকেরা নির্বাচন পর্যবেক্ষণের সুযোগ পেতেন। অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্থানীয় ৬৯টি সংস্থার ২ লাখ ১৮ হাজার পর্যবেক্ষক নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেছিলেন।
নির্বাচন কমিশনের এক কর্মকর্তা বলেন, পর্যবেক্ষক সংস্থা নিবন্ধন দেওয়ার নিতে হলে সংস্থাটির নিবন্ধন থাকতে হবে। সংস্থাকে নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ হতে হবে। নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন, আছেন বা কোনও নির্বাচনে প্রার্থী হতে ইচ্ছুক- এমন কোনও ব্যক্তি সংস্থার প্রধান নির্বাহী বা পরিচালনা পর্ষদে বা ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য হয়ে থাকলে সে সংস্থাকে নিবন্ধন দেওয়া হবে না।
নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিব মো. জাহাংগীর আলম বলেন, আগামী জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষণে ইইউ পূর্ণাঙ্গ পর্যবেক্ষক দল না পাঠাবে না। ইইউ জানিয়েছে, তারা নির্বাচন পর্যবেক্ষণে পূর্ণাঙ্গ দল পাঠাবে না। তবে তারা যোগাযোগ অব্যাহত রাখবে। ইইউর চিঠিতে সহিংসতা বা নির্বাচন নিয়ে শঙ্কার কথা উল্লেখ করা হয়নি।
নির্বাচন কমিশনের এক কর্মকর্তা বলেন, আগামী জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষণে পূর্ণাঙ্গ পর্যবেক্ষক দল না পাঠানোর সিদ্ধান্ত জানিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) চিঠি প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল পেয়েছেন। বৃহস্পতিবার (২২ সেপ্টেম্বর) নির্বাচন ভবনে ইইউ ই–মেইলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে বিষয়টি জানিয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ই–মেইলটি সিইসির কাছে পাঠিয়েছে। চিঠিতে ইইউর বাজেটস্বল্পতার কথা বলা হয়েছে।
ইইউর চিঠিতে বলা হয়, গত জুলাই মাসে ঢাকা সফর করে যাওয়া ইইউ’র প্রাক-নির্বাচন পর্যবেক্ষক দলের সুপারিশের ভিত্তিতে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন জোসেপ বোরেল। সিদ্ধান্তের পেছনে নির্বাচন পর্যবেক্ষণে ২০২৩-২৪ সালের জন্য ইইউ’র বাজেটস্বল্পতার কথা বলা হয়েছে। বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচনের সময় প্রয়োজনীয় শর্তগুলো পূরণ করা হবে কি না, তা এ মুহূর্তে যথেষ্ট স্পষ্ট নয়। এমন সিদ্ধান্ত সত্ত্বেও ইইউ বর্তমানে এই নির্বাচনী প্রক্রিয়ার সঙ্গে থাকার ব্যাপারে অন্যান্য বিকল্প খতিয়ে দেখছে বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়।
চিঠিতে ইইউর পক্ষ থেকে বলা হয়, বাংলাদেশে নির্বাচন যাতে অবাধ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক হয়, তা নিশ্চিত করতে তারা সব ধরনের প্রচেষ্টাকে উৎসাহিত করছে।
উল্লেখ্য, সংবিধানে জাতীয় সংসদের মেয়াদ পূর্তির আগের ৯০ দিনের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন করার বাধ্যবাধকতা আছে। আগামী বছরের ২৯ জানুয়ারি চলতি একাদশ জাতীয় সংসদের পাঁচ বছরের মেয়াদ পূর্ণ হবে। তার আগের ৯০ দিনের মধ্যে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন করতে হবে। ১ নভেম্বর থেকে ২৯ জানুয়ারির মধ্যে এই নির্বাচন করার আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে।