সাবরিনা নিপুঃ আজকাল মাঝে মাঝেই দিন তারিখ ভুলে যায় নন্দিনী। কিছুতেই মনে করতে পারেনা বার, তারিখ, সন। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে জানলার পাশে, ছোট্ট ব্যালকনির ইজি চেয়ারে অথবা বিছানার এক কোনায় কেন যে চুপচাপ বসে থাকে তাও ও বুঝতে পারেনা। আচমকা কোনো এক খাঁ -খাঁ দুপুরে একলা চিলের ডাক শুনে অন্যমনস্কতার ঘোর ছিঁড়ে যায় । বড় আলমারির আয়নায় চোখ পড়তেই মনে পড়ে যায় এই গেরস্থালির সাথে তার কি সম্পর্ক। সব মনে পড়তে থাকে। জলপ্রপাতের মতো ফিরে আসতে থাকে সব স্মৃতি। মনে পড়ে যায় আজ ওর একটা বিশেষ দিন । আজ নন্দিনীর জন্মদিন।
এক সময় এই দিনটিকে ঘিরে কতো কতো পরিকল্পনা করা হতো। বন্ধুরা একমাস আগে থেকেই প্ল্যান করতে থাকতো এই দিনে কে কিভাবে তাকে সারপ্রাইজ দেবে। অথচ এখন সে বন্ধুরাও কতো দূরে সরে গেছে।
আসলে মানুষ কখন কোন পরিস্থিতিতে পড়বে তা যদি আগে থেকেই বুঝতো তাহলে কোনো মানুষকেই বোধ হয় অস্বস্তিতে পড়তে হতো না। আবার অনেক সময় আশে পাশের মানুষরা বুঝতে পারলেও কেউ যদি নিজেই আবেগের বশে আগুনে ঝাঁপ দেয় তাতে অন্যেরা তাকে প্রোটেক্ট করার যতই চেষ্টা করুক তাদের অবস্থা নিশ্চিত নন্দিনীর মতোই হবে এখন রাত দিন শুধু একথাই মনে হয় নন্দিনীর। নন্দিনী নিজে পছন্দ করেই সুদর্শন এক ছাত্র নেতার হাত ধরে পালিয়ে এসেছিলো বাসা থেকে। ক্লিন শেভড, ঘাড় পর্যন্ত লম্বা চুল, খাড়া নাক আর স্কীন টাইট টি সার্ট সবল পেশীতে আঁট হয়ে থাকতো তখন ওকে গ্রীক দেবতাদের মতো মনে হতো। এতোটাই আবসেস্ট ছিলো নন্দিনী তখন সমাজ সংসার বাবা মা , পরিবেশ পরিস্থিতি কোনোটাই ওর ওপর প্রভাব ফেলতে পারেনি। বাবা মা কষ্ট পেয়েছিলেন ভীষণ। এমন বংশ পরিচয়হীন ছন্নছাড়া , বেকার ছেলের সাথে তাঁদের একমাত্র মেয়ের বিয়েকে স্বীকৃতি দেননি । এটাই ছিলো রাশেদের জেদের কারণ ! ও ভেবেছিলো রাজ্য সহ রাজকন্যা পেয়ে যাচ্ছে তাই তড়িঘড়ি বিয়েটা করে নিয়েছিলো নন্দিনীকে। কিন্তু যেদিন নন্দিনীর বাবা ওকে ত্যাজ্য করেছেন সেদিন থেকে ওর প্রতি রাশেদের ব্যবহার পাল্টে যেতে শুরু করলো। তার ওপর শুরু হয়ে গিয়েছিলো করোনা মহামারীর ভয়াবহতা। সেই দিনগুলো যে নন্দিনী কিভাবে দাঁত মুখ চেপে পার করেছে সেই একমাত্র জানে। রাশেদ হয় সারাদিন চুপচাপ বাসায় শুয়ে থাকতো , নয়তো দু তিনদিনের জন্য কোথাও চলে যেতো পার্টির কাজে। এখন পরিস্থিতি অনেকটা ভালো হলেও সম্পর্কটা কেমন যেন স্থবির হয়ে গেছে দিনে দিনে। ইদানিং খুব একটা কথাও হয়না দুজনের। একই ছাদের নীচে দুটো আলাদা জীবন।
এখন এই একা আয়নার সামনে বসে নিজের মুখোমুখি হলেই বেশ বুঝতে পারে ও বোবা বা চিন্তাশুন্য হয়ে পড়েনি এখনও। এখন ও বুঝতে পারে সদ্য টিন পেরুনো সেই বিস্ময়বোধ আর একটা রোমান্টিক মোহকে প্রেম বলে ভুল করেছিলেন সে। ওই নতুন মটর সাইকেল চালিয়ে রাশেদ যখন কলেজের সব মেয়েদের মাঝ থেকে তাকে পেছনে বসিয়ে নিয়ে চলে যেতো সে অনুভূতিটা ছিলো রোমাঞ্চকর। নিজেকে আর পাঁচজনের চেয়ে আলাদা মনে হতো যেন নিজেকে। আর এখন এই বন্ধুবান্ধব , আত্মীয় স্বজনদের কাছ থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে একা থাকার অভ্যাস করে নিয়েছে সে।
চলবে……