শরীফ হাসান
আমি মায়ের ছেলে। আমার স্বভাব-চরিত্র, গুণ-দোষের আশি শতাংশই মায়ের কাছ থেকে পাওয়া। আশির দশকেও মফঃস্বলের বাবারা সন্তানদেরকে খুব একটা সময় দিতেন না। মাকে ঘিরেই বেশিরভাগের পৃথিবী। আমিও তার ব্যতিক্রম ছিলাম না। অবশ্য সময়ের সাথে সাথে অবস্থার উন্নতি হয়েছে। আব্বার (বাবাকে আমরা দুই ভাই আব্বা ডাকি) সাথে ভীষণ বন্ধুত্ব গড়ে না উঠলেও বেশ বন্ধুভাবাপন্ন সহজ সম্পর্ক আমাদের। এখন অনেক কিছুই আমরা খোলাখুলি আলাপ করি, তর্ক-বিতর্কও হয়।
মধ্যবিত্ত ব্যবসায়ী আব্বা সাধ্যাতীত চেষ্টা করে মোটামুটি স্বচ্ছলভাবেই আমাদের বড় করেছেন। কড়া শাসনে সন্তান মানুষ করার নীতিতে বিশ্বাসী আব্বার বেত্রাঘাতের ভয়ে আমরা দুই ভাই তটস্থঃ থাকতাম। কিন্তু আমরা একটু বড় হতেই, বিশেষ করে, আমরা পাবলিক পরীক্ষায় ভালো ফল করার পর আব্বাকে বেশ নমনীয় ও বন্ধুসুলভ মনে হল। আমাদের সঙ্গে বেশি করে মিশতে লাগলেন। এমনকি আমার বন্ধুদের সাথেও তাঁর ভাব হলো।
সে সময়টাতে আব্বা হাতে ধরে ভালো-মন্দের পার্থক্য শিখিয়েছেন। সংস্কৃতিমনা আব্বার কাছ থেকেই প্রগতিশীল চিন্তা-ভাবনা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বীজ আমার মাঝে বপিত হয়েছে। জীবনের প্রতিটি মোড়ে তাঁর পরামর্শ পেয়েছি। অনেক ক্ষেত্রে দ্বিমত হয়েছে, তাকে উপেক্ষা করে অনেক সিদ্ধান্তও নিয়েছি এবং দিন শেষে আবিষ্কার করেছি তিনিই সঠিক।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে হলে উঠেছি আব্বার গুছিয়ে দেওয়া টিনের ট্রাঙ্ক নিয়ে। রীতিমত ফর্দ করে বাছাই করে কিনে আনা জিনিস পত্র দিয়ে ট্রাঙ্কটা ভর্তি ছিল। অনেকদিন আমাকে কিছু কিনতে হয়নি। এরপর প্রায় প্রতি মাসেই আব্বা সেই যশোর থেকে খাবার-দাবার আর ফলমূল কার্টনে ভর্তি করে হলে নিয়ে যেতেন। এমনিতে কিছুটা অলস ও কেতাদুরস্ত আব্বার এই কাজটিতে কোন ক্লান্তি বা সংকোচ ছিলনা।
পড়ালেখা শেষ করে ঢাকায় যখন বাসা ভাড়া করে থেকেছি তখনো তাঁর সেই অভ্যাস বজায় ছিল। আমি ক্যানাডা চলে আসাতে সেটি আর করতে পারেননা এবং এ নিয়ে তাঁর দুঃখের শেষ নেই। আব্বার সঙ্গে আমার এই অঘোষিত বন্ধুত্ব দিন দিন বাড়ছে। আমি বড় হচ্ছি, বন্ধুত্বও গাড় হচ্ছে। আমার বাবা হওয়াটা এই বন্ধুত্বকে নতুন মাত্রায় নিয়ে গিয়েছে।
চার বছর হলো আমি বাবা হয়েছি। সন্তান জন্মানোর আগে থেকেই তাকে নিয়ে সার্বক্ষণিক ভাবনা আমার পৃথিবীটাকে একটু একটু করে বদলে দিয়েছে। প্রসব বেদনায় কাতর স্ত্রীর পাশে দাঁড়িয়ে থেকে সন্তান ভূমিষ্ট হওয়ার পুরো প্রক্রিয়া আমি প্রত্যক্ষ করেছি। সে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা! অতঃপর সন্তানের আগমনী গান-সুতীব্র ক্রন্দন, আত্মজকে বুকে জড়িয়ে ধরা, নিজ হাতে তার নাড়ি কাটা – এসব কিছু আমাকে এক নতুন মানুষ বানিয়েছে।
শুরুর আদিখ্যেতা না থাকলেও সন্তান অরিককে ঘিরেই আমার সব কিছু। তার সামান্য কিছুতেই আমার আনন্দ, তার ভাঙাচোরা বাংলা, ইউকেলেলে নিয়ে টুংটাং, বাইসাইকেল চালিয়ে পার্কে যাওয়া, ডে-কেয়ার বন্ধ থাকায় হাঁটতে নিয়ে যাওয়া, স্কুল নিয়ে পরিকল্পনা এসবের মধ্যেই আমার জীবন। আমার ধারণা, এমনটি পৃথিবীর সব বাবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
আবার সন্তানদের কাছে বাবা এক ভরসার নাম। বাবাই তার প্রথম নায়ক। আমি গাইতে পারিনা, অরিকের চাপে তার সাথে তাল-বেতাল গলা মেলাতে হয়। তাতেই সে অভিভূত। আমাকে ‘সুপার সিঙ্গার’ উপাধিতে ভূষিত করেছে। সেদিন ঘরে একটা মশা ঢুকে পড়েছে। মশাটাকে বহু কষ্টে নিকেশ করার পর তা দেখে উচ্ছ্বসিত অরিক বলে উঠল, “মাইটি শিশির, ইউ গট সুপার পাওয়ারস।
“পৃথিবীর এই ক্রান্তিলগ্নে যখন সব কিছু এলোমেলো, যখন স্বার্থপরতার কাছে প্রতিদিন হারছে মানবতা তখন পিতা আর সন্তানের আস্থার সম্পর্কও হার মানছে এক অদেখা ভাইরাসের কাছে। ঘরে তালাবদ্ধ হয়ে পানি না পেয়ে চিৎকার করতে করতে প্রাণ হারাচ্ছে বাবা। মৃতদেহ থেকে করোনা ছড়ায়না জানার পরও সন্তান পালিয়ে যাচ্ছে। বেওয়ারিশ দাফন হচ্ছে প্রিয় পিতার শব। আবার মধ্যরাতে ঝোপের পাশে কিশোর সন্তানকে ফেলে যাচ্ছে পিতা।
তবে অন্ধকারের বিপরীতে আছে আলো। আছে ত্যাগের গল্প, মানবিক সম্পর্কের জয়গাঁথা। হাসপাতালে কোন সাহায্য না পেয়ে ক্লান্ত হতোদ্যম এক সাধারণ মানুষ বীরের মত গর্জে উঠেন। করোনা আক্রান্ত পুত্রকে কাঁধে তুলে বাবা হাঁকেন, “কোন ভয় নেই বাজান। বাংলাদেশ মরে গেলেও তোর বাপে মরে নাই।
“এবারের বাবা দিবস বাবা এবং প্রাপ্তবয়স্ক সন্তান উভয়ের জন্য এক বিরাট পরীক্ষা। বলা হয়ে থাকে, বিপর্যয়েই মানুষের চরিত্র প্রকাশিত হয়। আমার পরিচিত একাধিক প্রবীণ বড্ড ভয়ে আছেন। মৃত্যুভয় নয়, তাদের ভয় যদি সন্তানেরা তাদেরকে আক্রান্ত দেখে পরিত্যাগ করে। তাঁরা সেবা চাননা, চাননা অহেতুক সন্তান ঝুঁকির মুখে পড়ুক। তারা শুধু চান সন্তান দূর থেকে হলেও খবরটুকু রাখুক। রোগে ভুগে মৃত্যুর আগে সন্তান পাশে আছে এই নির্ভরতাটুকু নিয়ে যেতে চান।
মানুষ মানুষ হয়েছে বর্ণিল মানবিক সম্পর্কের কারণে। এক ভাইরাস তা সে যতই প্রাণঘাতী হোক না তার কাছে মানুষ হারতে পারেনা, হারতে পারেনা পিতা-সন্তানের নির্ভরতার সম্পর্ক। তাই এখনই সময় বয়স্ক বাবার কাঁধে হাত রাখার। দৃঢ় কণ্ঠে বলার, “বাবা, তুমি ভেবনা। তোমার সন্তান তোমার পাশেই আছে।
“অন্যদিকে এই করোনা বিপর্যস্ত সময়ে বাবাদের বিশেষ করে অল্প বয়সী শিশুর বাবাদেরকে বাড়তি দায়িত্ব নিতে হবে। বিশ্বজুড়ে কোটি শিশু এখন ঘরবন্দি। নিজেদের প্রয়োজনে চাই বা না চাই, আমরা বড়রা ঘর থেকে বেরুতে পারলেও ঘরবন্দি হয়ে পড়েছে শিশুরা যা তাদের মানসিক চাপ বাড়াচ্ছে। এ সময় শিশুদের দিকে বিশেষ মনোযোগ ও তাদের হাসিখুশি রাখার উদ্যোগটি বাবাদেরকেই নিতে হবে। হাত ধোয়া, হাঁচি-কাশির শিষ্টাচার, স্বাস্থ্য সচেতনতার বার্তাগুলো শিশুকে হাতে ধরে শেখাতে হবে।
ইউনিসেফ আশংকা করছে, “করোনা প্রতিরোধে পদক্ষেপসমূহের কারণে বিশ্বজুড়ে লাখ লাখ শিশু দুর্ব্যবহার, লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা, শোষণ, সামাজিক বাধার মুখোমুখি হতে পারে বা যত্নকারীদের থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়াসহ তাদের নিরাপত্তা ও কল্যাণের ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান হুমকির মুখে পড়তে পারে।“ বাবাকে খেয়াল রাখতে হবে তার সন্তান যেন এমন কিছুর সম্মুখীন না হয়। স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে শিশুদের সঙ্গে সময় কাটানোর জন্য বাবারা তেমন একটা সুযোগ পান না। এখন শিশুদের সঙ্গে কাটানো প্রতিটি মুহূর্ত যাতে আনন্দময় হয় সেটি বাবাকে নিশ্চিত করতে হবে। মানুষের সভ্যতার ইতিহাসে এমন সংকট এই প্রথম নয়। অতীতে এমন হাজারো সংকট মোকাবেলা করেই মানুষ আজকের অবস্থানে এসেছে। মানুষের টিকে থাকার, বিজয়ী হবার সংগ্রামে শক্তি ও প্রেরণা যুগিয়েছে তার পরিবার ও সমাজ। এবারও তার ব্যতিক্রম হবেনা। শুধু দরকার ভরসার সম্পর্কগুলোকে আরও দৃঢ় করা। এই বাবা দিবসে এটিই হোক আমাদের মূল প্রতিপাদ্য। সন্তানের শ্রেষ্ঠ বন্ধু, সকল বাবার জন্য শ্রদ্ধা। শুভ বাবা দিবস।