মম কাজী
ট্রেনের ঝিকঝিকে যাত্রা, কামরার ভেতরে আলো-আঁধারির লুকোচুরিতে এক রহস্যময় মানুষ। পটভূমিতে ভরাট গলায় পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয় আলোর ফেরিওয়ালা এস. কে. আলমামুনকে। জানালা দিয়ে দেখা খাঁটি বাংলাদেশের পরিবর্তনশীল সবুজ সব ছবি। কখনও সূর্যালোকে উজ্জ্বল আবার কখনও বৃষ্টির শীতল পরশ।
এভাবেই ট্রেনের যাত্রার মাঝে শুরু এবং সমাপ্ত হয় প্রখ্যাত আলোকচিত্রি ও নির্মাতা নাদিম ইকবালের চলচ্চিত্র “বিদ্যাভূবন”।মাত্র ছাব্বিশ মিনিটে তিনি দর্শকদের নিয়ে গেছেন কংশ নদীর ধারে নেত্রকোনার কাছিয়াকান্দা গ্রামে, পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন এক স্বপ্নের সাথে। মামুনের প্রতিষ্ঠিত ভিন্নধর্মী বিদ্যায়তন “বিদ্যাভুবন”।
চলচ্চিত্রটির প্রতিটি সেকেন্ড ধীরে ধীরে প্রকাশ করে মামুনের আলোকিত সম্ভবনাময় মানুষ তৈরীর প্রস্তুতি। তাঁর বহুবছরের তপস্যার ফল এই “বিদ্যাভুবন”। ছোটবেলা থেকেই অতিসাধারণ আর্থিকভাবে নিন্মবিত্তের নিত্তনৈমিত্তিক গ্রাম্য জীবন দেখতে দেখতে বড় হওয়া মামুনের চিন্তাই ছিল কিভাবে তাঁদের আলোর পথ দেখানো যায়। যখন হাজার বছরের সংস্কার, ক্ষুধা নিবৃত্তির প্রচন্ড সংগ্রাম ও যথাযথ শিক্ষার অভাব তাঁদের বাক্সবন্দি করে রেখেছে চিরজীবন, তখন গৃহপালিত পশুর আবেদন আপন সন্তানের চেয়েও মূখ্য ভূমিকা পালন করে। দারিদ্রের নির্মম কষাঘাতে জর্জরিত মানুষগুলোর মাঝে স্বপ্নের বীজ বুনে এগিয়ে চলা কোনও সহজ কথা নয়।
বহু পরিশ্রমের পরে মামুনের উপলব্ধি হয়েছে যে তাঁকে আনকোরা মন নিয়ে কাজ করতে হবে। তাই তিনি তাঁর যাত্রা শুরু করেন কোমলমতি শিশুদের নিয়ে।তাঁদের সংস্কারমুক্ত শুভ্র মনে এঁকে দিতে চেয়েছেন জীবনের সব বাস্তবিক উপকরন। তৈরী করতে চেয়েছেন দেশ ও দশের স্বার্থে কাজ করার মত আলোকিত সম্পূর্ণ নাগরিক।
স্হানীয় সকল উপকরন দিয়ে শুরু হয় বিদ্যাভূবনের ভিত্তি। দরাজদিল বন্ধু নাইম আহমেদ কিবরিয়ার আর্থিক সহযোগিতায় বাস্তবায়িত হয় বিদ্যাভূবনের গঠন। পুঁথিগত বিদ্যার ঊর্ধ্বে যেয়ে শিক্ষা দেওয়া হয় কিভাবে একজন পরিনত “মানুষ” হওয়া যায়।মুখস্ত বিদ্যা নয় বরং তাঁদের ভেতরের কৌতুহলকে উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছেন।
তিনি যেমন সৃজনশীলতাকে উৎসাহ দেন তেমনি শিশুদের সমস্ত পরিবারকে একই সুতোয় গেঁথে একসাথে বন্ধুর পথ অতিক্রম করেন।শিশুদের এমনভাবে বিদ্যাশিক্ষা দেওয়া হয় যেন তারা বিষয়বস্তু উপভোগ করে এবং বিদ্যাভুবনে আসার জন্য অধীর আগ্রহে সকালের অপেক্ষা করে। তিনি চান পৃথিবীতে সৎ,স্বনির্ভর এবং আত্বিবিশ্বাসে ভরপুর মানুষ উপহার দিতে যারা তাঁর এই আলোকবর্তিকা বয়ে নিয়ে যাবে সমগ্র বিশ্বে।
মামুন এবং তাঁর দল একজন শিশু শিক্ষার্থীর সামগ্রিক জীবনকে উন্নত করার লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। এখানে নির্মাতা নাদিম ইকবাল বিভিন্ন দৃশ্যে যোগ ব্যায়াম করা থেকে শুরু করে, প্রার্থনা, আহার, সৃজনশীল নাটকের অংশসহ সকল বিষয় অত্যন্ত নান্দনিকভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।প্রতিটি ফ্রেম গল্প বলে এক এক টুকরো বাংলাদেশের অপরূপ গ্রামের।
চলচ্চিত্রটি শেষ হয় সেই ট্রেনের কামরায় যা হয়ত মামুনের এই যাত্রাপথকেই বোঝায়। বৃষ্টির স্বচ্ছ্ব পানিতে হাত ভিজিয়ে তিনি নতুনকে স্বাগতম জানান। শেষ দৃশ্যের হাস্যোজ্জ্বল স্কুলগামী মেয়েদের চন্চলতায় প্রকাশ পায় আগামী দিনের অসীম সম্ভবনা। আর রবি ঠাকুরের অমৃতবানী দর্শকের মনে আনে তৃপ্তির পরশ।
যেই মানুষটি তাঁর বহু যত্নে গড়া বিদ্যাভূবনের জন্য নিজের কিডনী পর্যন্ত বিক্রী করতে চেয়েছিলেন, তাঁর এই অনবদ্য গল্প জনসাধারণের সামনে শৈল্পিক এবং নিঁখুতভাবে তুলে ধরার জন্য নাদিম ইকবালকে অভিনন্দন।