কাল নারী দিবস রবি বাবু। তোমার সেই অন্তঃপুরের নারী যাদের নিয়ে গেছ ত্যাগের পথে দুঃখের উচ্চতায়। হৃদয়হীন সংসারে করেছো তাদের বিদ্রোহী, চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছো নারীর মধ্যে ও বিশ্ববিজয়ী যাদু আছে। সেই যাদুর কাঠির ছোঁয়ায় বিশ্বায়নে, পন্যের বাজারে, প্রযুক্তিতে, ঘরের কাজে নারী আজ সর্বাঙ্গীনী। কুশলি,প্রকৌশলী, চিকিৎসা, বিজ্ঞান, রাজনীতি সবেতেই নারীর জয়জয়কার, নারী হয়েছে মহাকাশচারী,আজ তাঁরা আন্তর্জাতিক! কিন্তু আমাদের পুরুষদের দৃষ্টিতে ফুল চন্দন আর পড়লো কই? আমাদের মানসিকতা জুড়ে নারীর আত্মমর্যাদার উন্মুক্ত স্থান কি করতে পেরেছি? চলার পথে কতটুকু নিরাপদ তারা এখনো, এই সময়ে?
সাবওয়েতে,বাসেতে,সহকর্মীর পাশে বসাতে, তাঁর গোলাপি পেলব, চোখের কাজল, নাকের দুল কেমন দুলা দেয় চোখের আলোয়। আর মনের কালোয় ধরা দেয়, অনাবৃত শরীর দেখার বাসনা। বোধনের নারীর মধ্যে মায়ের মুখ আর তখন ভাসে না। নারীকে ক্ষমতার সিঁড়ি বানিয়ে রাজনৈতিক নেতা-আমলাদের রাজকীয় লাম্পট্য শেষে, ছুঁড়ে ফেলা হয় মিডিয়ার নর্দমায় গণিকার মোহর লাগিয়ে।
আকাশের সজল মেঘ আর উজ্জ্বল রোদ, বেদনার বাতাস্ কে ঢেকে রাখে এই আমাদের আশে-পাশে। চোখে স্বপ্নের মিথ্যে কাজল পড়িয়ে, সুসজ্জিত বিছানায় শক্তিমান পুরুষের তরল অপমান গর্ভে ঢেলে,দায়িত্ব এড়াতে, এই যুগেও নারীকে কুন্তি হয়ে, কর্ণকে জলে ভাসিয়ে দিতে প্ররোচনা দেয় পুরুষ আমাদের এই সমাজে। বন্ধুত্বের পদস্খলন হয়েছে দাবি করে তাঁর পাশে দাঁড়ানোর সহমর্মিতা চায় পুরুষতান্ত্রিক সংস্কারে আচ্ছন্ন বুদ্ধিজীবী। এরাই আবার ফেইসবুকের মুক্তাঞ্চলে আন্তর্জাতিক নারী দিবসে নারীর জন্যে চাটুবাক্য বর্ষন করবে।
আবার আন্তর্জাতিক নারী, সংসারে এখনো অনেকটাই অন্তঃপুরবাসিনী। সেই মেইড ইন বাংলাদেশের নারী থেকে দেশে-প্রবাসের কর্মজীবী নারী, ভাই-বোন মানুষ করে, মায়ের হাসপাতাল, বাবার হজ্ব, সাংস্কৃতিক চর্চা,পরচর্চা সবকিছু সামলিয়ে পরে সুখের পঞ্চব্যাঞ্জনের রান্না ঘর যেন মা দশভুজা। আর এই শেষ দৃশ্যের মুখরোচক অঙ্কন না হলে, তবে নারী মাথায় বুঝা। অবশ্য নারীরা ও অভ্যস্ত যৌথ জীবনের সিদ্ধান্তের ভার পুরুষদের হাতে ছেড়ে দিয়ে। সকল প্রশংসা পুরুষের নামে করে।
নিজে শ্রম দিয়ে মনের মাধুরি মিশিয়ে দশপদ রান্না করে খাইয়ে বলবে অমুক কর্তার বাসায় এসেছেন এই কটা পদ না খেয়ে গেলে কি হয়! এই হচ্ছে আমাদের বাঙালি নারী। ছোটবেলায় মা কে দেখতাম বাবা বিছানায় গেলে, মশারির চারপাশ গুজে দিতে, দাদাদের জন্যে বৌদিরা, কখনো ক্লান্ত বিধ্বস্ত শরীর টিভির সামনে অজান্তেই চোখে ঘুম জড়িয়ে আসলে, গায়ের উপর কাঁথা ছড়িয়ে দেয় বৌ। একে বলে কেয়ারিং। ছাতার মত ঝড়বৃষ্টি থেকে আগলে রাখা। নারীর ছাতার তলে সুখে বাঁচে সংসার।
সংসার সুখের হয় রমনীর গুনে বলে বলে নারীর কোমড়ে নাড়া লাগিয়ে ঘুরাচ্ছে রমনেরা যুগ যুগ ধরে। যেমন পুরুষের ইগো থাকবে, নারীর থাকলে হয় না। পুরুষকে তেমন সংসারি হতে হয় না কিন্তু নারী সংসারী না হলে অশান্তি চরমে উঠবে। আমি কাজ শেষে, বন্ধুদের সাথে জমিয়ে আড্ডা মেরে বাসায় ফিরবো মধ্যরাতে, নারী কেন ঘুরবে রাত বিরাতে। রান্নায় লবন কম, পুরুষ অনায়াসে ভাঙতে পারে কাঁচের বাসন, এই সব সয়ে যাওয়াই নারীর গুন। সয়ে যাওয়ার মধ্যেই নিহিত দেখানোর সুখি গৃহকোণ।
কেমন হবে নারীর জীবন, কেমন তাঁর চলন, কেমন হবে পোশাকের ধরন তা আজকাল পুরুষদের চিন্তার কারণ। “If Women wear revealing clothes they have more chances of getting raped” Zakir Naik. এই বিশ্বাসের মানুষ নেহাত কম নয়, এরা নিজের চোখ সারাবে না। পৌরষত্বের দম্ভ নিয়ে, স্কুলে,কলেজে, বানিজ্যে বসতে,পাব্লিক ট্রান্সপোর্টে,চলতি পথে চুল থেকে গোড়ালি পর্যন্ত দেখে নারীদের, আরোও অনেককিছু দেখার ও মাপার বাসনা জাগে। এরাও নারী দিবস, মা দিবস, গোলাপ দিবস, শুধু দিবসের আদিখ্যেতা করে। চিন্তাশীল একজন চিন্তা নায়ক যখন আন্তর্জাতিক ভাবে এ কথা বলতে পারেন এই সময়ে যখন সভ্যতা আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করছে তখন ভাবতে হয়, আশে-পাশের এই অসভ্য পুরুষদের মানসিকতায় অস্ত্রোপচার কতটা জরুরি।
শুধু অবস্থান আর প্রগতির ধাপ পেড়িয়ে উঁচু শিখরে পৌছানোই নারীর মর্যাদা নয়, তাদের মর্যাদা দিতে হবে আমাদের চিন্তার মানসিকতায়। নয়তো বিলম্বিত লয়ে নারী জ্বলে উঠবে নিজেই নিজের শর্তে। মর্তের পুরুষতান্ত্রিক অব্যাবস্থাপনার মুখে করবে চপেটাঘাত।
চপেটাঘাত আদিখ্যেতার মুখে, চপেটাঘাত সমাজ-সংসারের মুখে, চপেটাঘাত পুরুষের চাটুবাক্যে, মিছে কথার সাহিত্য আর কাব্যে। তার পর নিজেই নিজেদের প্রতিটি দিবসে ওড়াবে মৃত্যুহীন মর্যাদার পতাকা।
হিমাদ্রী রয় সঞ্জীব।