তাসরীনা শিখা।
আজ বিশ্ব নারী দিবস। আজ আমাকে আপনারা কিছু বলতে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। আপনারা জানেন আমি মোটেও কোমল মনের নারী নই। আমি আমার মতো করে নারীর সম অধিকার নিয়ে সংগ্রাম কোরে চলেছি। আমি জানি না মিথ্যা কোরে সুখের কথা শুনাতে। আমি আজ আপনাদের আমার নারী জীবনের গল্প শোনাবো। আপনারা জানেন আমার নাম জোহরা বেগমকিন্তু জানেন আমি কিন্তু এমনটি ছিলাম না। ছোট বেলা থেকে মা শিখিয়েছিলেন ,ভদ্র ঘরের মেয়েরা জোরে চিৎকার করে কথা বলে না। ছেলেদের মতো হা হা করে গলা ফাটিয়ে হাসে না। এমন কি জোরে শব্দ করে কাঁদতেও নেই। এতে করে দুর্নাম হয়। সে নাকি ভালো মেয়েদের তালিকাতে পরে না। বড়দের চোখে চোখ রেখে কথা বলতে নেই , তর্ক করতে নেই। এর নাম বেয়াদবি।
আমি অক্ষরে অক্ষরে মায়ের কথা মেনে চলেছি। না মানলে যে আমি ভদ্র মেয়ের তালিকা থেকে বাদ হয়ে যাবো ।আমি যখন মৌলভী সাহেবের কাছে কুরআন শিখতাম। একদিন আমার পড়া ভালো হয়েছে বোলে তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়েছিলেন। আমি তখন নিতান্তই ছোটো। তাই এর অন্য কোন ব্যাখ্যা আমার মনে আসেনি।আমার খুব বাজে লেগেছিলো কিন্তু আমি কাঊকে কিছু বলিনি। কারণ ভদ্র ঘরের মেয়েদের চিন্তাশক্তি এতো নিকৃষ্ট মানের হওয়া উচিৎ না।
আমার অংকের মাষ্টার আমাকে অংক বুঝানোর ছলে আমার ঊরুতে হাত রেখেছিলো। সেদিন আমার আমার বুকের ভেতর বিদ্রোহের একটা বীজ বসে ছিলো সেটি নড়ে চড়ে উঠলো। আমি মাষ্টার মশায়ের হাতটা মোচর দিয়ে ধরে জোরে কামড় বসিয়ে দিলাম। মাষ্টার মশাই মাগো বোলে চীৎকার করে উঠলো। মা কি হোলো কি হোলো বোলে ছূটে এলেন। মাষ্টার মশাই পেটে হাত দিয়ে বললেন ,আমার হঠাৎ করে পেটে প্রচণ্ড ব্যাথা শুরু হোয়েছে আমি আজ আর পড়াতে পারবো না। এই বোলে মাষ্টার মশাই যে গেলেন তিনি কখনো পড়াতে আসে নি।আমি মধ্যবিত্ত ভদ্র ঘরের মেয়েটি বেড়ে উঠে বিয়ের বয়েসে এটা ঠেকলাম। ভদ্র ঘরের মেয়েদের সময় মতো বিয়ে না হোলেও দুর্নাম হয়। সে দুর্নাম থেকে বাঁচার জন্য আমার বিয়ে দেয়া হোলো। নতুন সংসার শুরু করার আগে মা পই পই করে বূঝয়ে দিলেন , শুনরে মা স্বামীর ঘরই মেয়েদের আসল ঘর। স্বামীর কথা মেনে চলবি। ও যে ভাবে চায় সে ভাবেই চলবি। জানিস তো ভদ্র ঘরের মেয়েরা স্বামীর অবাধ্য হয় না। এতে করে দুর্নাম হয়। দুর্নাম , দুর্নাম , দুর্নাম মা আর কতো শুনবো তোমার কাছে একই শব্দ। ঠিক আছে আমি তোমাদের দুর্নাম করবো না , সুনামই রক্ষা করবো হোলোতো মা? মা খুশী হলেন।
আমি মধ্যবিত্ত ঘরের সাধারণ মেয়ে জোহরা। কিন্তু আমার স্বামী টপ আধুনিক । সাধারণ মেয়েকে কি করে পরিচয় দিবে সমাজে? আমাকে পার্লারে নিয়ে দীর্ঘ কেশ কেটে ঘাড় পর্যন্ত তুলে আনা হোলো। আমার মায়ের অতি যত্ন করে বাড়িয়ে তোলা আমার দীর্ঘ চুল গুলো পার্লারের ফ্লোরে ছড়িয়ে পড়লো। সাথে সাথে আমার চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো । আমার জন্য নতুন আলমারি সাজানো হোলো। সেখানে টপ মডেল ডিজাইনের শাড়ী ব্লাঊজ, জুতা পার্স সাজানো হোলো। আমার গ্রাম্য জোহরা নামটি ছোটো কোরে রাখা হোল”জোরা”। আমি তখন আধুনিকা নারী। সমাজে টপ আধুনিক নারী জোরা।
আমার স্বামীর বন্ধুরা আসে হৈ চৈ করে। মদ্য পান করে টাল হোয়ে বাড়ী ফিরে। তাদের মদের গ্লাস গুলি আমাকেই সাজিয়ে দিতে হয়। এটাই আধুনিক সমাজের নিয়ম। একরাতে আমার স্বামীর অফিসের বড় বস মদ্যপান করে আমাকে জড়িয়ে ধরে বোললো হ্যাঁ জোরা আজ রাতটি তোমার আমার জন্য লিখা। বলে তিনি হেচকা টান মেরে এগিয়ে যেতে চাইলেন। সে দিন আমার বুকের ভেতরে বিদ্রোহের যে বীজটী নড়ে উঠেছিলো সেটা এক ঝটকাতে খুলে বিশাল গাছ হোয়ে গেলো। আমি টেবিল থেকে একটি মদের বোতল নিয়ে প্রচণ্ড জোরে আঘাত করলাম লোকটির মাথায়। লোকটি অজ্ঞান হোয়ে পড়ে গেলো। সে রাতে আমাকে এই অপরাধের জন্য আমার স্বামী বেদম প্রহার করলো । আমার নাক দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়লো। ওর জুতা পরা লাথি আমার সারা শরীর অবশ করে দিলো । আমি সূর্য উঠার আগেই, আমার সাজানো আলমারি, দামি গহনা, জুতা , ব্যাগ এবং আধুনিক নাম জোরা কে চিরো বিদায় দিয়ে আবারো জোহরা বেগম নামে পথে নামলাম। জোহরা হোয়েই আমি নিজের শক্তি অর্জন করলাম। ঘাত প্রতিঘাতে হয়েছি বিদ্রোহী ও প্রতিবাদী নারী। আমি এখন কাঊকে ভয় পাইনা । আমি স্পষ্ট ভাবে নির্ণয় করতে পারি সাদা কালোর ব্যবধান। আজ নারী দিবসে লাঞ্ছিত ,নির্যাতিত নারীদের দিকে হাত বাড়িয়ে বলি , তোমরা মুক্তির আলো খুঁজে নাও। মানুষের মতো বাঁচতে শেখো। অন্যায়ের সাথে আপোষ কোর না। মনে রেখো তুমি শুধু একজন নারী নও তুমি একজন মানুষ।