জসিম মল্লিক
লেখক পরিচিতিঃজন্ম বরিশাল শহরে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেন। কলেজ জীবন থেকেই তাঁর লেখালেখির শুরু এবং দেশের বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক ও সাপ্তাহিক-এ নিয়মিত লিখছেন। ১৯৮৩ সালে তৎকালীন সাপ্তাহিক বিচিত্রায় কাজের মধ্য দিয়ে তার সাংবাদিকতার শুরু। দীর্ঘ প্রায় চল্লিশ বছরের সাংবাদিকতা ও লেখালেখির অভিজ্ঞতা।এ পর্যন্ত তার প্রায় পঁয়ত্রিশটির মতো গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।
২০০৩ সাল। জুলাই মাস। আমি কানাডার জীবন যাপনে প্রবেশ করেছি মাত্র। সাধারণতঃ কানাডার গ্রীস্মকাল হয় ভীষণ রকম উপভোগ্য। সেবারও তেমন। ঢাকার তীব্র কোলাহলপূর্ণ শহর ছেড়ে অত্যন্ত শান্ত এবং ছিমছাম এক শহরে পদার্পণ করলাম আমি। এ যেন মনুষ্য জঙ্গল ছাড়িয়ে সবুজ বনাঞ্চল ঘেরা কোন এক কল্পলোকে প্রবেশ। লোকসংখ্যা মাত্র সাত লাখ যে শহরে। যেনো এক গাছপালায় পূর্ণ সবুজের গালিচার মধ্যে কেউ ঢুকিয়ে দিয়েছে। সন্ধ্যার পর মানুষজন তেমন চোখে পরে না। সাতটা বাজলেই অনেকের ঘরের লাইটও অফ হয়ে যায়। ডিনার শেষ করে ঘুমোতে চলে যায় তারা। শুক্রবার ও শনিবার রাতটাই যা একটু জীবন্ত।
সে বছর সেপ্টেম্বর থেকেই তাপমাত্রা কমতে শুরু করে। সঙ্গে একটা হালকা গরম কাপড় না থাকলেই নয়। একমাস পার হতেই মনে হলো কিছু একটাতো করতে হবে! অটোয়া অন্টারিও প্রদেশের অংশ হলেও কানাডার রাজধানীও বটে। বস্তুত অটোয়া হচ্ছে ডিপ্লোমেটিক সিটি।
কানাডা পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ হওয়া সত্বেও লোকসংখ্যা মাত্র তেত্রিশ মিলিয়ন! কানাডায় যারা ইমিগ্রান্ট হয়ে আসেন তারা সবাই উচ্চ শিক্ষিত এবং যার যার ক্ষেত্রে ভাল অবস্থানেই ছিল বলা যায়। সেই তুলনায় ইমিগ্রান্টদের জন্য চাকরির বন্দোবস্ত অপ্রতুল। সারভাইভাল জবও অতো সহজলভ্য না। অটোয়াতেতো আরো না। তাই বেশীরভাগ ইমিগ্রান্টরা শুরুতে ছোটখাট কাজ দিয়ে শুরু করে। একটা ভাল কাজ পেতে হলে কানাডার ডিগ্রী ও অভিজ্ঞতা দরকার হয়।
আগষ্ট মাস জুড়ে আমি একটি প্রতিষ্ঠানের সাথে ট্রেনিং করলাম। ট্রেনিং শেষ হওয়ার দিনই সেই প্রতিষ্ঠান চাকরির ব্যবস্থা করল একটা কোম্পানীতে। আমরা প্রায় বিশ জনের মতো একসাথে ট্রেনিং ক্লাস করতাম। বিভিন্ন দেশের মানুষ ছিল তারা। তার মধ্যে জেনিফার নামে একটা মেয়ে ছিল। জেনিফার ছিল অসম্ভব সুন্দর দেখতে। সে প্রায়ই আমার পাশে বসত। জেনিফারের ইংরেজী এ্যাকসেন্ট ভাল বুঝতাম না কারন জেনিফার কথা বলত দ্রুত। তবুও আমি চেষ্টা করতাম তার সাথে কমিউনিকেট করতে। সে আমাকে খুব হেল্প করত। ব্রেকে আমরা একসাথে কফি খেতে যেতাম, গল্প করতাম। স্বল্পভাষী জেনিফার গ্রাজুয়েশন পাটির দিন আমাকে বলল, জসিম তোমাকে আজকে খুব সুন্দর লাগছে। শুনে আমার বুকের মধ্যে একশটা ব্যাঙ লাফ মেরেছিল!
অটোয়ার অদূরে ’কানাটা’ নামক ছোট্ট এক শহর। তখন মাত্র কিছু কিছু আইটি এবং গাড়ির ইন্ডাস্ট্রি গড়ে উঠছে। সন্ধ্যার পর যে শহর মৃতপূরী হয়ে যায়। ছুটির দিন যেখানে প্যাসেঞ্জারের অভাবে বাস পযর্ন্ত চলে না। সেই কানাটা নামক জায়গায় আমার প্রথমদিন ডিউটি পরল। আমার শিফট শুরু রাত এগারোটায়। গিয়ে দেখি খা খা বিরান বিশাল মাঠের মতো একটা যায়গা। সেখানে কিয়া কোম্পানীর গাড়ির ফ্যাক্টরী হচ্ছে। আমার কাজ রাতে পেট্রোল করা। একটা সিডান গাড়ির মধ্যে আমার থাকার ব্যবস্থা। ওখানে গিয়ে দেখি জেনিফার। তার শিফট শেষ। জেনিফার আমার ফ্যাকাশে মুখ দেখে হাসল। বলল ভয় পেওনা। আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে। জেনিফার আমাকে সব বুঝিয়ে দিল। ওর ওয়াকিটকি, ফ্লাইশ লাইট দিল।
প্রথম তিন রাত আমি বেশ আগ্রহ নিয়ে কাজটা করলাম। রাত বাড়লে গাড়ির মধ্যে বসে সুনীলের বই পড়ি। অনেক কষ্টে চোখ খোলা রাখি। ঘুম পেলে ফ্লাক্সের চা খাই। চতুর্থ রাতে ঘটনাটা ঘটল। পরের দিন শনিবার। আমি একটু রিলাক্স মুডে। রাতের দিকে খুউব ঠান্ডা বাতাস বইছিল। আমি গাড়িতে হীটিং ছেড়ে অবস্থান করছি। এক ঘন্টা পর পর প্রেট্রোল দেওয়ার নিয়ম। রাত গভীর হলে ভয়ে আমার গা ছম ছম করতে থাকে। অনেক দুরে হুস হুস করে দু’একটা গাড়ি চলার শব্দ পাওয়া যায়। দূর থেকে একটা কফি শপ চোখে পড়ে। সেখানে ড্রাইভ থ্রু থেকে কেউ কেউ কফি নেয়। রাত বারোটা হলে কফি শপটা বন্ধ হয়ে যায়।
আজকে রাতের বাতাসে একটা ভৌতিক কান্নার হাহাকার। ঘুট ঘুটে অন্ধকার রাত। হঠাৎ আমার গাড়ির দরজায় টোকার শব্দ পেয়ে আমি ভয়ে আঁতকে উঠি! চোখ খুলে তাকিয়ে দেখি আমার সুপার ভাইজার। সে আমাকে ওয়াকিটকিতে বার বার কল করে পাচ্ছিল না। তাই সে ছুটে এসেছে আমার কিছু বিপদ হয়েছে কিনা। আসলে আমি গভীরঘুমে তলিয়ে গেছিলাম! পরেরদিন আমি জেনিফারকে বললাম আমি এই কাজটা আর করব না। কাল রাতে আমি অনেক ভয় পেয়েছি। তাছাড়া আমি রাত জাগতে পারি না। জেনিফার বলল আমিও কাজটা ছেড়ে দিয়েছি এবং আমাকে বিস্মিত করে দিয়ে বলল, জসিম পরশু দিন আমি ফ্লোরিডা চলে যাচ্ছি। আর ফিরব না কানাডায়। আমি খুউব অবাক হয়ে জেনিফারের মুখের দিকে থাকিয়ে থাকলাম..।