‘ইন্ডিয়ান গার্ল!’ পার্ট-৪
হেলিমেরটার মতো চুংকিংয়ে আরো কয়েকটা ডরমিটরি আছে। দিন মজুর টাইপের কাজ করে যারা মুলত সস্তায় থাকা খাওয়া সাড়তে চায় তারাই এসবের বোর্ডার। ভাড়া সীটপ্রতি রাত দশ ডলার। রুমের সাইজ হবে বড় জোড় বারো বাই বারো। পাশে ছোট একটা কিচেন আর বাথরুম। খাওয়াখরচ সাশ্রয় করতে অনেকে এখানে রান্নার ব্যবস্থাও করে। রুমে তিন তালার তিনটা করে খাট আটানো যায়। তাতে নয়জন থাকতে পারে একটা রুমে। কম না। দিনে নব্বই ডলার। শুধু একটা রুম থেকেই মাসে আয় আড়াই হাজারের ওপরে। হেলিমের পুরো স্যুইটের ভাড়াই সম্ভবত: উঠে আসে এই এক ডরমিটরি থেকে। ব্যবসাটা মন্দ না।
নাম তার হালিম। হয়তো বিদেশে এসে মডার্ন করে নিয়েছে। হংকংয়ে সে পরিচিত হেলিম নামে। নাম শুনে প্রথম প্রথম অনেকে বুঝতেও পারে না লোকটা কোন দেশী। এতে অসুবিধার চেয়ে সুবিধাই বোধহয় বেশী তার কাছে। হরেক রকমের ব্যবসা হেলিমের। তবে মুল ব্যবসাটা যে কি, কোন দিন ধরতে পারি নাই। অবশ্য এ নিয়ে কখনো কোন আগ্রহও দেখাই নাই আমি। একটা চায়নীজ মহিলা আছে সাথে। বলে তার বউ। নাম জেনি। কিন্তু দু’জনকে এক সাথে দেখেছি যে ক’বার সন্দেহ জেগেছে কেমন বউ! হেলিমের চেয়ে বয়সে একটু বড়ই হবে। হতে পারে রেসিডেন্সির জন্য কাগজের বিয়ে। তবে হেলিম মাঝে মাঝে গলা উঁচু করেই বলে তার বউ একজন চায়নীজ। হংকং শহরে একটা চায়নীজ বউ, কোন বাঙ্গালীর জন্য এটা কম কথা না। জেনি এখানে রাতে থাকে না। সকালে আসে, সন্ধ্যার আগে চলে যায়। মাঝে মাঝে দুই একদিন আসেও না। শহরের অন্য এলাকায় নিজের বাসা আছে। সম্ভবত: কোন এক স্বামী বা বয় ফেন্ডের ঘরের সন্তানদের নিয়ে থাকে সেখানে। চুংকিংয়ে হেলিমের ব্যবসার সাথে মহিলাটির কি সম্পর্ক তাও জানি না। ও নিয়েও কখনো মাথা ঘামাই নাই। তবে হেলিম বলে বউয়ের ভরন পোষনের টাকা দিয়ে যেতে হয় তাকে নিয়মিত। সব কিছু মিলিয়ে দু’জনের সম্পর্কটা যে আসলে কি কখনো পরিষ্কার হয় নাই আমার কাছে। মাঝে মাঝে দেখেছি হেলিমকে বকাঝকাও করছে। আবার গোয়েন্দাগিরিও করে হেলিম অন্য কোন মেয়ে নিয়ে রাত কাটায় কিনা।
ইদানিং সে ব্যস্ত কোরিয়ায় লোক পাঠানো নিয়ে। হংকংয়ের মতো কোরিয়া যেতেও ভিসা লাগে না। অন এরাইভাল এন্ট্রি তিন মাসের জন্য। এক সময় বাংলাদেশী কাজান্বেষীরা সহজেই যেতে পারতো সে দেশে। অনেকে গেছে এভাবে। কিন্তু গিয়ে কেউ ফেরত না আসায় কোরিয়া সরকার হালে ইমিগ্রেশন টাইট দিয়েছে। এখন জেনুইন ভিজিটর ছাড়া এন্ট্রি দেওয়া হয় না। আর জেনুইন বিজনেসম্যান বা ভিজিটর প্রমান করতে স্থানীয় কোন কোম্পানীর আমন্ত্রন বা স্পন্সরশীপ দেখাতে হয়। প্যাসেঞ্জারের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ থাকতে হয়। শুধুমাত্র ভ্রমনের উদ্দেশ্যে কোন বাংলাদেশী কোরিয়া যায়, এটা সে দেশের সরকার আর বিশ্বাষ করে না। তবে জেনুইন ব্যবসায়ীদের কোন সমস্যা হয় না। বিশেষ করে যারা অন্যান্ন দেশ ভ্রমন করেছে বা দুই একবার কোরিয়া গিয়ে ফিরে এসেছে তারা সহজেই পেয়ে যায় এন্ট্রি। সাদা পাসপোর্ট হলেই সমস্যা। এভাবে অনেকে ফেরত আসায় হেলিমদের গুরুত্ব বেড়েছে। মাঝখানের এই স্পন্সরশীপ ইনভাইটেশন কাগজপত্রের ব্যপারগুলো করে দিচ্ছে ওরা। ভালো পয়সা পায়। এখন নাকি রেট জনপ্রতি তিন লাখের ওপর গিয়ে পৌঁছেছে।
আমি কোরিয়ার একটা ইলেক্ট্রনিক্স কোম্পানীর ডিলারশীপ নিয়েছি ঢাকায়। ফ্রিজ এয়ারকুলার মার্কেটিং। আপাতত ইমপোর্ট। পড়ে বাজার পেলে এ্যসেম্বলিং প্লান্ট করা হবে বাংলাদেশে। প্যাকেজটা সূদুরপ্রসারি। মাস তিনেক আগে সিওল গিয়ে কাগজপত্র সই করে এসেছি। কোম্পানীর এক ডিরেক্টর, হেরিয়েল গত মাসে ঢাকা ঘুড়ে গেছে। এখনো এলসি করিনি। আমি এবার ঢাকা থেকে বেড়িয়েছি মূলত: সিওলের উদ্দেশ্যে। হংকংয়ে ট্রানজিট। কথা অনুযায়ি ওরা আমার কোম্পানীর কিছু লোককে ট্রেনিং দেবে সিওল নিয়ে গিয়ে। ওদের প্রস্তাব, খরচটা আধাআধি ভাগ করে নিতে। আমি চাইছি পুরো ব্যয়টা ওদের ঘাড়ে চাপাতে। এ নিয়ে কোন সমঝোতা এখনো হয়নি। ডিরেক্টর হেরিয়েল কয়েকবার কথা বলেছে ফোনে। ও অবশ্য আমার পক্ষে। ও-ই বুদ্ধি দিয়েছে সিওল গিয়ে চেয়ারম্যানকে সামনাসামনি ধরলে সে না করতে পারবে না। চেয়ারম্যান খুব ব্যস্ত। তার সাথে আমার মিটিংয়ের দিনক্ষনটা এখনো ঠিক করতে পারেনি। বলেছে আমি যেন রওনা দিয়ে দেই। একটু এগিয়ে হংকং এসে থাকি। যাতে প্রগ্রাম হওয়ার সাথে সাথেই গিয়ে পৌঁছুতে পারি। তার ধারনা আমি হংকং আসতে আসতে সে প্রগ্রাম ফাইনাল করে ফেলতে পারবে। এমনিতেও ঢাকা থেকে সিওল কোন সরাসরি ফ্লাইট নাই। হংকং ব্যাংকক বা সিঙ্গাপুরে ট্রানজিট নিতে হয়। এদিকে হেলিম খবর পেয়ে গেছে যে আমার কোম্পানীর মাধ্যমে কিছু লোক যাবে সিওল ট্রেনিং পারপাজে। ধরে বসেছে, যেন এবার সিওল যাওয়ার পথে অবশ্যই হংকং ঢুকি। সে আমার সাথে একটা ডীলে আসতে চায়।
সিওলের পথে সাধারনত: হংকংয়েই ট্রানজিট নিয়ে থাকি আমি। কয়েকজন পরিচিত লোক আছে। বাল্যবন্ধু সাচ্চু আজ বিশ বছরের ওপরে এখানে। কি সুখ পায়, সেই ভালো জানে। শহরতলিতে একটা এক রুমের বাসা ভাড়া করে থাকে। আমাকে একবার নিয়ে গেছিলো সে বাসায়। তার যা অবস্থা তা বর্ণনা না করাই ভালো। কিছু একটা কায়দা করে রেসিডেন্সি নিয়েছে। হংকংয়ে কোন বিদেশীর নাগরিকত্ব পাওয়া কঠিন। সাচ্চুও পায়নি। পাঁচ বছর পর পর রেসিডেন্সি রিনিউ করিয়ে চলছে। হংকং এলে এসব বন্ধু বান্ধবের সাহচর্য্যে দু’চার দিন ভালোই কেটে যায়।
হেলিমের প্রস্তাবটা আমাকে ফোনেই বলেছে। সে চাইছে ট্রেনিংয়ের জন্য আমার কোম্পানীর পক্ষ থেকে যে লোকজন যাবে তাদের সাথে তারও কিছু লোককে যেন পাঠিয়ে দেই। বিনিময়ে ভালো টাকা পাওয়া যাবে। কিন্তু ট্রেনিং শেষে ওর লোক আর ফেরত আসবে না। সোজা বাংলায় আদম পাচার। প্রস্তাবটা আমার কাছে ভালো মনে হয়নি। প্রথম ব্যবসা করতে যাচ্ছি কোম্পানীটার সাথে। প্রথমেই দুই নম্বরী করে বসবো! ধরে ফেললে ভুল বোঝাবুঝি হবে। শেষে সম্পর্কই নষ্ট হয়ে যাবে। দুইদিনের ব্যবসায় তো নামিনি ওদের সাথে। লং টার্ম প্রজেক্ট। অনেক চেষ্টা চরিত্র করে এই কোম্পানীর ডিলারশীপটা নিতে হয়েছে। শক্ত প্রতিদ্বন্ধি ছিলো। তাদেরকে কাটাতে হয়েছে। এখনো ব্যবসা শুরু হয় নাই। এই সামান্য টাকার লোভ করতে গিয়ে শেষে পুরো ব্যবসাটাই খোয়াবো!। কিন্তু হেলিম নাছোড়বান্দা। শেষে বলেছি, ঠিক আছে, সিওল যাওয়ার পথে হংকং আসছি। সাক্ষাতে আলাপ করবো।
সকালে হেলিম নিজেই গেছিলো এয়ারপোর্টে আমাকে রিসিভ করতে। ফিরে গেস্ট হাউসে তুলে দিয়ে চলে এসেছে। রাতের খাবার আমাদের এক সঙ্গে খাওয়ার কথা। সেই রাতের খাবার খেতেই এসেছি।
এখন রাত দশটার কাছাকাছি। রুম থেকে রওনা দিয়েছিলাম সময়মতোই। মাঝে রাস্তায় ওই ঝক্কিতে দেরী হয়ে গেলো। হেলিম জানতে চায় দেরী করলাম কেন। একটুপর এরা বন্ধ করে দেবে। তাড়াতাড়ি খাবার অর্ডার দিতে হয়। অর্ডার দিয়ে বসি শান্ত হয়ে। তারপর খুলে বলি তাকে পথের ওই ঘটনাটা। সব শুনে একটু মুচকি হেসে হেলিম বলে ‘তাইলে আপনেও পড়ছিলেন ওই পাল্লায়!’
বলি, কিন্তু কবে থেকে শুরু হলো এই চল। এর আগেরবার তো এমন দেখি নাই।
হেলিম একটু বিরক্তিভাব নিয়ে বলে, আর কইয়েন না, কইত্থিকা যে এরা খবর পাইছে হংকংয়ে ইন্ডিয়ান মাইয়াগো ডিমান্ড আছে। এখন দলে দলে আইতাছে। সন্ধ্যায় দেখবেন চুংকিং মিরাডরের সামনে সব শাড়ি সালোয়ার কামিজ পইড়্যা হাটাহাটি করতাছে।
বিষ্মিত হতে হয় তার কথায়। বলি, বলেন কি! অনেক!
অনেক মানে টান বাজারের মতো না। তয় দুই তিনজনের গ্রুপ কইর্যা ঘুইর্যা বেড়ায়।
থাকে কোথায় ওরা?
বেশীরভাগ মিরাডরে। চুংকিংয়েও থাকে কিছু।
বলি, নিশ্চয়ই ভালো আয় হয়।
তাতো হয়ই। নাইলে আসে ক্যান!
বলি, ভালোই তো। তো কাস্টমার কারা এদের।
চলবে…