‘ইন্ডিয়ান গার্ল!’ পার্ট-৮
শুধাই ‘ইউ নো হিন্দী?’
মাথা ঝাকায়। জানে না।
‘ইংলিশ?’ হ্যাঁ সুচক মাথা নাড়ে।
যাক এর সাথে হাত পা নেড়ে বা অঙ্গভঙ্গি করে কথা বলতে হবে না। আসলে কম্যুনিকেশনের জন্য ইংরেজী জানা থাকাটা যে কত দরকার বিদেশে গেলেই বোঝা যায়।
জড়োসরো হয়ে বসে আছে দেখে সহজ হতে বলি ‘বি ইজি। ডোন্ট গেট স্কেয়ার্ড। আই এ্যাম এ ম্যান, নট এনিমেল।’
‘আই নো।’ এই তার দ্বিতীয় কথা আমার উদ্দেশ্যে। সন্ধ্যারাতে রাস্তায় শুধু একবার শুধিয়েছিলো আমার রুম নম্বর কত আর এতক্ষন পর তার দ্বিতীয় কথাটি। একটু থমকেমতো গেলাম। বেশ মিষ্টি শোনালো। এরপর একটু নড়ে চরে সহজ হয়ে বসলো। ধীরে ধীরে তাকায় আমার মুখের দিকে। স্বচ্ছ সে দৃস্টিতে এক ধরনের উৎকন্ঠা যেন।
চোখ ফিরিয়ে আনি। আসলে আর পারছিলাম না তাকিয়ে থাকতে। সেই একই অবস্থা। তাকাই টিভির দিকে। কথা বলতে পারিনা কয়েক মিনিট। আক্ষার নীরবতা। বসে আছি চুপচাপ দু’জনই। একটুপর মনে হয় এভাবে চুপচাপ থাকা ঠিক না। কিছু কথা বলা উচিত। ফিরে শুধাই, রাতের খাবার খেয়েছো?
মাথা ঝাকায়। খেয়েছে।
কিছু খাবে? কোল্ড ড্রিক, বিষ্কিট, ফল।
মাথা নেড়ে বোঝায় খাবে না। মুখে বলে, তার এখন ক্ষিধে নেই।
এখন কি বলি। আবার চুপ হয়ে যাই। চোখ ফেরাই টিভির দিকে। দেখতে থাকি অনুষ্ঠান। কেটে যায় কিছুক্ষন এভাবে। আসলে আমি আর কোন কথাই খুঁজে পাচ্ছিলাম না। হঠাৎ ওপাশে একটু খচমচ শুনে ফিরি ওর দিকে। তাকিয়ে বিষম খেয়ে উঠি যেন। উঠে দাঁড়িয়েছে। বুকের ওপর থেকে আঁচলটা নামানো। দু’হাত পেছনে দিয়ে ব্লাউজের হুক খোলার চেষ্টা করছে। বুঝতে পারিনা অমন করছে কেন! এর মধ্যেই খোলা হয়ে যায় সবগুলো হুক। ব্লাউজটা খুলে ফেলতে যাবে আমি ধমকে উঠি যেন ‘এ্যয়, হোয়াট ইউ ডুয়িং!’
‘গেটিং অফ দ্য ক্লোদস্।’ পরিষ্কার ইংরেজীতে নিরুত্তাপ উত্তর। আমি আবার একটা ভালো হোঁচট খাই ওর ইংরেজী শুনে। ভেবেছিলাম একটা অর্দ্ধ শিক্ষিত গেঁয়ো টাইপের মেয়ে। ইয়েস নো ভেরী গুড ছাড়া জানেনা। এতো ভালো ইংরেজী জানা! একেবারে শুদ্ধ উচ্চারন!
কিন্তু সে বিষ্ময়ের চাইতেও বড় বিষ্ময় সে ব্লাউজ খুলছে কেন! বিষ্ফারিত চোখে শুধাই ‘বাট হোয়াই!’
‘ইউ পেইড ফর দ্যাট। ডোঞ্চিউ?’
থতমত খেয়ে যাই ওর বলার ভঙ্গিতে। বলছে কি! সামলে নিয়ে বলি ‘আই পেইড ফর ইওর টাইম উইথ মি, নট ফর গেটিং অফ দ্য ক্লোদস্।’
চুপ হয়ে যায়। ব্লাউজ খোলা বন্ধ করে। বলে ‘হোয়াই, ইউ ডোন্ট লাইক মি?’
ইচ্ছে হয় বলি ইয়েস আই লাইক ইউ, লাইক ইউ ভেরী মাচ। একটু হেসে ঘুড়িয়ে বলি ‘ইজ দেয়ার এনি ম্যান হু উইল নট লাইক ইউ! ইউ আর প্রিটি, বিউটিফুল।’
‘সো?’
‘হোয়াট সো!’
‘হোয়াই ডোঞ্চিউ টেক মি?’
‘হোয়াট ইউ সে!’ কথাটা আমার যেন আর্ত্তনাদের মতো শোনায়।
‘আই এ্যাম এ গার্ল ফ্রম দ্য স্ট্রিট, দ্যাটস হোয়াই?’ বলে তাকায় সোজা চোখের দিকে।
টিকতে পারিনা সে দৃস্টির সমানে। চোখ সড়িয়ে নেই। কি জবাব দেবো এ কথার! আসলে ওর সাথে কোন শারিরীক সম্পর্ক হতে পারে এমন তো মাথায়ই আসে নাই কখনো। এবার বিছানা থেকে উঠে আসে। আমার সামনে এসে দাঁড়ায়। আমি একটু ঘাবড়েমতো যাই। কি করবে এখন! ধরে বসবে নাতো! না, সেসব কিছু করলো না। বøাউজের হুকগুলো লাগায়। শাড়ির আঁচলটা বুকের ওপর দিয়ে দেয়। তারপর শান্ত কন্ঠে বলে ‘আই এ্যম নট এ গার্ল ফ্রম দ্য স্ট্রিট। বিলিভ মি-!’
এই বিলিভ মি কথাটা বলার সময় কন্ঠটা কেঁপে উঠলো যেন। চমকে উঠি ওর সে কন্ঠে। কি বলতে চাইছে! মনে পড়লো সন্ধ্যায় যখন প্রথম দেখেছিলাম চোখ দু’টো ভেজা দেখেছি। মনে হয়েছিলো কয়েক ঝলক দেখা সে দৃষ্টিতে যেন কিছু অব্যক্ত কথা। আমি সে মূহুর্তে আনমনা হয়ে পরেছিলাম।
এবার অবাক চোখে তাকাই ওর দিকে। ও-ও তাকিয়ে আমার চোখে। ধীরে দু’ফোটা পানি গড়িয়ে পরে গাল বেয়ে। বিষ্ময়ে হতবাক হয়ে যাই, ও কি কাঁদছে! কয়েক মূহুর্ত। এরপর হঠাৎই যেন ভেঙ্গে পড়ে মেয়েটি। হাতদু’টো জোড়বদ্ধ করে কাতরকন্ঠে বলে ওঠে ‘আই এ্যম ট্র্যাপড্। প্লিজ হেল্প মি!’ বলেই হাঁটু গেড়ে বসে পরে মেঝেতে। এবার রীতিমতো কেঁদে দেয়। কাঁদতে কাঁদতেই বলে চলে, আমি জানি তুমি একজন ভালো লোক। তোমাকে বিশ্বাষ করা যায়। আন্টি তোমার এখানে আমাকে আনতে চায়নি। আমিই জোড় করে এসেছি। আমার কাছে মনে হয়েছে তুমি আমাকে সাহায্য করতে পারো। সে জন্যে তোমার কাছে আসতে তখন আমিই তোমার রুম নম্বর জিজ্ঞেস করেছিলাম। কৌশলে আন্টিকে বিদায় করে এখানে থেকে গেছি একান্তে তোমাকে আমার কথাগুলো বলবো বলে।
আমি রীতিমতো হতবাক হয়ে যাই ওর এ কথায়। ‘প্লিজ হেল্প মি’ বলে এবার আমার পায়ে হাত রাখে।
শশব্যস্ত হয়ে উঠি। ধরে তুলতে তুলতে বলি ‘ওকে ওকে। গেট ইজি। এখানে বসো।’ বলে আমার পাশে বসিয়ে দেই ধরে। ও আঁচলে মুখ ঢেকে ফোপাতে থাকে।
একটু ধাতস্থ হয়ে নিয়ে শুধাই, কি ব্যপার! কি হয়েছে?
কিছুটা সামলে নেয় নিজেকে। তারপর ফোপানির মধ্যেই বলে, সে আমাকে মিথ্যা কথা বলে এখানে এনেছে।
কে!
ওই মহিলা।
ওই মহিলা কে হয় তোমার?
কেউই না। তবে আমি চিনি তাকে। আমাদের পরিবারের পরিচিত।
কিন্তু সে তোমাকে এখানে আনলো কিভাবে!
সহসা জবাব দেয়না। তারপর ফোপাতে ফোপাতেই বলে চলে, সব আমার দোষ। আমার পরিবার বাবা মা কেউই আসতে দিতে চায় নাই। আমিই জোড় করে এসেছি। ভালো আয় করবো, ভালো থাকবো। অনেক বড় আশা করেছিলাম। এখন লোভের ফাঁদে আটকা পরেছি। তুমি আমাকে এখান থেকে উদ্ধার করো। আমাকে বাঁচাও, প্লিজ। বলে আবার হাত দু’টো জোড় করে তুলে ধরে। দু’চোখে অশ্রুধারা। কন্ঠে কান্না। আমি থ’ হয়ে যাই। কি বলবো কি করবো যেন স্বাভাবিক বুদ্ধিও লোপ পেয়ে যায় সে মূহুর্তে।
হাত দু’টো ধরে নামিয়ে বলি, ওকে, রিলাক্স। ব্যপারটা আমাকে সব খুলে বলো।
কান্না সংবরন করে মেয়েটা। তারপর বলে যায় ওর মতো করে পুরো ঘটনা। ওদের বাড়ী চেন্নাই থেকে মাইল চল্লিশেক দুরে পাত্তাবিরাম নামের এক শহরতলীতে। সুন্দর গাছগাছালি ঘেরা এলাকা। ওখানেই জন্ম, সে শহরেই তার বেড়ে ওঠা। বাবা রেলে সামান্য বেতনে চাকরি করে। চার ভাইবোন মিলে ছয় জনের সংসার। ভাইটা বড়। বিএ পাশ করে চাকরির খোঁজ করছে। সে মেঝ। এর পরেরজন বোন। সবচেয়ে ছোটটা ভাই। সে পড়াশোনা নিয়মিত চালিয়ে যেতে পারেনি। কয়েক বছর করে গ্যাপ গেছে। এবার বিএ ফাইনাল দেবে। একা বাবার আয়ে সংসার চলতে চায় না বলে মাঝে মাঝে ছোটখাট চাকরি করেছে। কোন চাকরিই স্থায়ী হতে পারেনি। চাকরি করার কারনেই সময়মতো বিএটা পাশ করতে পারে নাই। সঙ্গের মহিলাটির বাড়ী চেন্নাই। তবে ওদের পাড়ায় মহিলার এক আত্মীয় থাকে। সে সুবাদে মহিলা আসে মাঝেমাঝে তাদের পাড়ায়। সেই সূত্রেই পরিচয় তাদের পরিবারের সাথে, ওরা ডাকে তাকে আন্টি। মহিলা আগে দুবাই থাকতো। কয়েক বছর যাবত আসা যাওয়া করে। তবে মাঝে মাঝে চেন্নাই থেকে মেয়েদেরকে নিয়ে যায় সাথে করে। বিদেশে চাকরির ব্যবস্থা করে দেয়। তাদের পাড়ারও কয়েকজনকে নিয়ে গেছে। কিছুদিন পর পর এসব মেয়ে দেশে ফিরে আসে। আসার সময় বেশ টাকা পয়সা নিয়ে আসে। আবার যায়। সবাই জানে মেয়েরা বিদেশে গার্মেন্টসয়ে বা বড় লোকের বাসাবাড়ীতে রান্নাবান্না ঝাড়পোছের কাজ করে। পরোপকারি হিসেবে তাদের এলাকায় মহিলার বেশ নামও হয়েছে। কিছুদিন আগে সে তাদের বাসায় গিয়ে বলে হংকংয়ে একটা গার্মেন্টসয়ে মেয়েদের চাকরি আছে। ভালো বেতন। বছরখানেক করতে পারলে অনেক টাকা নিয়ে আসতে পারবে। সে তাকে যেতে বলে তার সাথে। বাসার কেউ সায় দেয়না তার এ প্রস্তাবে। সে-ই জোড় করে আসার জন্য। আসলে পরিবারের ওই অর্থকষ্ট বাবার ওপর চাপ সে সহ্য করতে পারছিলো না। সবার মতের বিরুদ্ধেই আসতে চায় মহিলার সাথে। পাসপোর্ট বিমানভাড়া সব মহিলা দিয়েছে। শর্ত, বেতনের টাকা থেকে মাসে মাসে শোধ করে দিতে হবে। সে শর্ত মেনেই একদিন প্লেনে চাপে মহিলার সাথে।
চলবে…