হেলিম আর রউফ সাহেব দুইজনই যেন বোকা হয়ে গেছেন। উঠে দাঁড়াই। বলি ‘লেটস্ গো।’ সাথে সাথে ওরাও ওঠে। রউফ সাহেব বিল বুকে টাকা রাখেন। আমরা বের হয়ে আসি রেস্টুরেন্ট থেকে। হাটতে হাটতে হেলিম একটু নীচু গলায় বলে, তাইলে আমাগো আইজ বসা অইবো না?
রউফ সাহেবও একই ভঙ্গিতে বলেন, ওকে রুমে রেখে চলে আসতে পারেন।
বলি, রাত তো কম হলো না। এ সময় একবার রুমে গিয়ে আবার বাইরে বের হওয়া কি ভালো দেখাবে! কি মনে করবে মেয়েটা! কাল বসি। এখন গিয়ে শুরু করলে মাঝ রাতে মাতাল হয়ে রুমে ফিরতে হবে-!
রউফ সাহেব বোঝেন ব্যপারটা। বলেন, তা অবশ্য ঠিক।
হেলিম ফোড়ন কাটে, আরে বুঝলেন না, একলা ছাড়তে মন চায় না। তো চলেন একটু হাটি। তারপর আপনেরা চইল্যা যান। আমরা দুইজন নাহয় যাইয়্যা পার্টির বাকিটা শ্যাষ করুমনে।
ঘড়ি দেখি। দশটা এখনো হয়নি। হাঁটা যায় খানিকটা। নিশাকে শুধাই এখনই রুমে ফিরে যাবে না কিছুক্ষন হাঁটবে।
ও-ও হাঁটার পক্ষে। বলে কয়েক দিন ধরে রুমে শুয়ে বসে থেকে শরীর ব্যাথা হয়ে গেছে। একটু হাঁটলে ভালোই লাগবে।
দিনে গড়ম গেছে। এ সময়টা বেশ ঠান্ডামতো পড়েছিলো। সুন্দর বাতাস। ভালোই লাগছিলো হাঁটতে। আমরা হাঁটতে হাঁটতে আসি নদীর ধারে। বেশী দুর না। রাস্তায় তেমন ভীড়ভাট্টা নাই। হাঁটতে কোন অসুবিধা হলো না। কথা বলতে বলতে এসে যাই স্পেস মিউজিয়াম, কালচারাল সেন্টার চত্বরে। তাপমাত্রা মোটামুটি স্প্রিংয়ের মতো হওয়ায় অনেক মানুষ এসেছে। এ এলাকাটা ট্যুরিস্ট এরিয়া, ডাউন টাউন হংকং। বেশ ইউরোপীয় সাদা বাদামী চামড়ার মানুষ দেখা গেলো। শ্রমিক শ্রেণীর এশীয়দের অবশ্য ঘুড়ে বেড়ানোর সময় নাই। পরদিন সকালেই কাজ। দিনে পনেরো ষোল ঘন্টা করে কাজ করার পর আর হাওয়া খাওয়ার সময় থাকে না তাদের। তবে ছুটির দিনে বেশ ঘুড়ে বেড়ায়।
নদীর পাড় ঘেষে প্রশস্ত বাধানো বেদী, রেলিং দেয়া। একটু পরপরই বসার বেঞ্চ। এত রাতেও ভীড় মোটামুটি কম না। তবে এ সময়টায় ট্যুরিস্টরা বেশী থাকে না। সবাই স্থানীয় চায়নীজ। দিনের গড়মের পর রাতে নদীর ধারে খোলা হাওয়া খেতে এসেছে। একটু দুরেই ফেরি ঘাট। স্টার ফেরি নামে প্রসিদ্ধ। কাউলুন হংকং পারাপার করে। কিছুক্ষন পরপরই ছেড়ে যাচ্ছে, ওপার থেকে আসছে। স্পেস মিউজিয়াম, কালচারাল সেন্টার চত্বর পুরো এলাকাটাই বিকেল থেকে মেলার মতো হয়ে ওঠে। ছোট ছোট দোকান টং বসে যায়। আইস ক্রিম গ্যাস বেলুন ছবি তোলা বই বিক্রি, কয়েকজন অংকন শিল্পীকে দেখা গেলো বসে আছে রং তুলি নিয়ে। এরা মানুষের মুখের দিকে তাকিয়ে তার ছবি একে দেয়। তাদেরকেও বেশ ব্যস্ত দেখা গেলো। অনেকেই পোজ দিয়ে বসে আছে সামনে।
আমরা চারজন হাঁটতে থাকি নদীর পার ধরে উদ্দেশ্যহীনভাবে। হেলিম আর রউফ সাহেব সামনে, আমি আর নিশা পেছনে। বেশ মুগ্ধ চোখে নিশা তাকাচ্ছিলো চারদিক। একটু পর এসে বসি একটা বেঞ্চে। হেলিম সবাইকে আইসক্রিম খাওয়ায়। সামনেই নদী। বাতাস ছিলো সে সময় বেশ। কেমন এক ধরনের শো শো আওয়াজ। বাতাস থাকলে নদীতে ঢেউ ওঠে। ঢেউয়ের দোলায় নদীতে ছোট ছোট নৌযানগুলো দুলছিলো। ওপারে হংকং শহর। সুউচ্চ ভবনগুলো আলো আধারিতে কেমন মোহনীয় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অত রাতেও নদীতে স্পীড বোট লঞ্চ কার্গো চলাচল কম না। কিছুক্ষন একনাগাড়ে তাকিয়ে থাকলে তন্ময় হয়ে যেতে হয়। এক সময় আমি আর নিশা উঠে এসে রেলিংয়ে ভর দিয়ে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে দেখতে থাকি হংকংয়ের রাতের সে রূপ। নীচে বেদীতে ঢেউ আছড়ে পড়ছিলো। তার দু’এক ছটা উঠে আসছিলো ওপরে। কিছু আমাদের মুখে চোখে এসেও লাগে। মুগ্ধ হয়ে থাকে নিশা বেশ খানিকক্ষন।
এক সময় আমি বলে উঠি ‘ইটস্ নাইস, রাইট!’
ঘাড় ফিরিয়ে তাকায়। মিষ্টি হেসে বলে ‘হংকং ইজ সো বিউটিফুল, আই কুডন্ট থিংক অফ ইট। থ্যাংক ইউ ভেরি মাচ।’
বলি, থ্যাংক ইউ কি জন্য!
এই যে তুমি আমাকে এখানে নিয়ে এসেছো। তোমাকে না পেলে আমার কি এসব দেখা হতো!
বলি, আমাকে পেয়েছো মানে!
Disclaimer:
The editorial team is not responsible for the content of the writing.