‘ইন্ডিয়ান গার্ল!’ পার্ট-১০
আমি খুব মনোযোগ দিয়ে শুনি কথাগুলো। আর একটা সিগারেট ধরাতে ইচ্ছা হয়। প্যাকেটটা হাতে নিয়েও রেখে দেই। এরপর ভালো করে তাকাই ওর চোখের দিকে। কথা শেষ করে মেয়েটি পূর্ন দৃষ্টিতে তাকায় আমার দিকে। চোখাচোখি হয়ে যায়, কিন্তু কেউই সড়াই না চোখ। আমি পড়ার চেষ্টা করি ওর চোখের সে ভাষা। বুঝতে চাইছিলাম কতটুকু সত্য বললো, কতটা বিশ্বাস করা যায় তা।
এবার একটু নড়ে বসি। বলি ‘হুঁ, সো হোয়াট ইউ ওয়ান্ট মি টু ডু!’
কাতর কন্ঠে বলে ওঠে ‘সেভ মি!’
‘হাও?’
‘আই ওয়ান্ট টু গো ব্যাক চেন্নাই।’
একটু ভেবে শুধাই, ‘হয়্যার ইজ ইওর পাসপোর্ট এ্যন্ড টিকেট?’
ত্রস্তে বলে ‘উইথ হার।’
‘সো, হোয়াটস দ্য প্রব্লেম? গেট দোজ ব্যাক এ্যন্ড ফ্লাই।’
‘শি ডাজন্ট ওয়ান্ট টু গিভ মি ব্যাক! শি ওয়ান্টস হার মানি।’ বলে অসহায়ের মতো তাকিয়ে থাকে মুখের দিকে।
হুঁ। পরিস্থিতিটা বেশ জটিল। ভালো একটা ফাঁদে আটকিয়েছে মহিলা। টাকা না পেলে পাসপোর্ট টিকেট ফেরত দেবেনা, আর এর কাছে কানাকড়িও নাই।
আমাকে চুপ থাকতে দেখে যেন ভেঙ্গে পরে মেয়েটা। বলে, যদি পাসপোর্ট টিকেট ফেরত না পাই আমি কি দেশে ফিরে যেতে পারবো না!
ওর দিকে তাকিয়ে বলি, না। দেশে ফিরতে হলে তোমার পাসপোর্ট টিকেট লাগবেই।
কিন্তু আমার কাছে তা নেই এখন!
মহিলাকে বেশ শক্তভাবে বলো ফেরত দিতে।
বলেছি। টাকা ছাড়া সে দেবে না তা।
কত টাকা?
অনেক।
বলেনি কত?
না। তবে অনুমান করি কমপক্ষে তিরিশ হাজার রুপী।
একটু হিসাব করে বলি, তার মানে প্রায় সাত হাজার হংকং মানি।
আমি জানি না। বলে আবার ফুপিয়ে কেঁদে ওঠে। মুখে আঁচল চাপা দেয়।
এ সময়ই ফোন বেজে ওঠে। রুমের ফোন। রিসেপশন থেকে। নিশ্চয়ই মহিলা এসে গেছে। ঘড়ির দিকে তাকাই। হ্যাঁ এক ঘন্টা পার হয়ে গেছে। রিসিভার তুলে কানে ঠেকাই। ওপার থেকে বলে, ‘লেডি কাম ব্যাক।’
‘হোল্ড অন-’ বলে তাকাই মেয়েটার দিকে। ও-ও তাকায় আমার দিকে। দৃষ্টিতে প্রশ্ন। বলি, ‘শি ইজ ব্যাক। ওয়ান আওয়ার পাস্ড।’
মূহুর্তে ফ্যাকাশে হয়ে যায় মুখ। যেন বুঝতে পারে না কি বলবে। বলি, ‘শি হ্যাজ কাম টু টেক ইউ ব্যাক।’
‘নো।’ রীতিমতো আর্ত্তনাদ করে ওঠে মেয়েটা।
এখনই যেতে চাইছে না। আমাদের কথা এখনো শেষ হয়নি। সবে শোনা হলো, আমার কিছু বলা হয়নি। একটু ভেবে নিয়ে রিসেপশনিস্টকে বলি, ‘ওকে, টেল হার উই আর নট ডান ইয়েট। আস্ক হার টু কাম ব্যাক আফটার হাফ এন আওয়ার।’
‘ওকে’ বলে ওধারে ফোন রাখে।
আমি আবার একটা সিগারেট ধরাই। আনমনেই ধরিয়ে ফেলি। ধরানোর পর মনে হলো আবার ধরালাম! একটু অপরাধীর দৃষ্টিতে তাকাই ওর দিকে। বুঝতে পারে। এত দু:খের মধ্যেও ঠোটের কোনে চিলতে হাসি ফুটে ওঠে। বলে,‘ নো প্রব্লেম, ক্যারি অন।’
‘থ্যাংক ইউ’ বলে ধোয়া ছাড়ি। ভাবতে থাকি কি করবো এখন। মনে হচ্ছে মেয়েটা যা বলছে সত্যি। আসলেই ভালো একটা মেয়ে বোকামির কারনে ফেঁসে গেছে। জীবনে তার এই প্রথম বিদেশে আসা। তাও এসে পড়েছে একেবারে হংকংয়ের মতো একটা আধুনিক শহরে। আমাদের অঞ্চলের মানুষের প্রথমবার পশ্চিমা ধাঁচের এসব শহরে এলে যে অবস্থা হয়, যা দেখে সবই বিষ্ময় ঠেকে। আর এ তো একটা মেয়ে। একমাত্র ওই মহিলাটি ছাড়া আর কোন পরিচিত লোক নাই এখানে। অথচ সেই এখন তার শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু আমি তাকে কিভাবে উদ্ধার করতে পারি এ বিপদ থেকে!
তার চেয়ে বড় কথা এ ঝামেলায় জড়ানো উচিত হবে কিনা আমার! মেয়েঘটিত ব্যপার এমনিতেই ভ্যাজালে। তার মধ্যে এ পরেছে একটা নোংড়া ব্যপারের মধ্যে। আমি এর মধ্যে জড়িয়ে আবার নিজেই না কোন ঝামেলায় পরে যাই। বোঝা যাচ্ছে মহিলাটা ঘাগু। এ শহরে তার নিয়মিত যাতায়ত। নিশ্চয়ই এর আগেও নানা জায়গা থেকে মেয়ে এনে ব্যবসা করিয়েছে। খারাপ কিসিমের লোকজন হাতে থাকা অস্বাভাবিক নয়। শেষে মেয়েটাকে বাঁচাতে গিয়ে নিজে ওদের টার্গেট হয়ে গেলে! হিন্দী ফিল্মের গল্প হলে ঠিক ছিলো। নায়িকা ট্র্যাপড্। রোগা পটকা নায়ক একা ঝাপিয়ে পরলো দশ বিশটা ভোমা সাইজের ষন্ডার ওপর। এবং স্ক্রিপ্ট রাইটারের বদৌলতে সব কটাকে ধরাশায়ী করে নায়িকাকে উদ্ধার করে নিয়ে এলো! কাহিনী শেষ। কিন্তু আমরা তো পর্দায় না। বাস্তবে। কুংফু কারাতের হংকং শহর। দশ বিশটা দুরের কথা ও রকম একটার পাল্লায় পড়লেই তো আমার দফা রফা হয়ে যাবে। একবার মনে হয় মেয়েটাই বা আমার কে! নিজের দেশের কেউ হলে একটা দায়িত্ব থাকতো। কোথাকার কে, চিনি না জানি না, রাস্তায় দেখা। এমন বিপদে তো কতজনই পড়ে আছে। কে কার খোঁজ রাখে, সাহায্য করে। ভাবতে ভাবতে তাকাই ওর দিকে।
বসে আছে আড়ষ্ট হয়ে একই ভাবে। করুন দৃস্টিতে তাকিয়ে। অপেক্ষা, আমি কি বলি, কি সিদ্ধান্ত নেই। যেন এই মূহুর্তে আমার একটি সিদ্ধান্তের ওপর ওর সমস্ত জীবন ওর ভবিষ্যত নির্ভর করছে। ভাবি, যদি মেয়েটা এ পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আসতে না পারে! কি করবে শেষে! ওই খাতায়ই নাম লেখাবে! কি করতে পারে আর। প্রথমে বাধ্যবাধকতা, পরে যখন ব্যপারটা গা সওয়া হয়ে যাবে, এবং এক সময় দেখবে ভালোই টাকা আসছে- পুরোপুরি লাইনে এসে যাবে। এবং এভাবেই একটা ভালো ভদ্র ঘরের মেয়ের নাম উঠে যাবে পতিতার খাতায়। এভাবেই আমাদের সমাজে মেয়েরা বেশ্যা হয়ে যায়। ক’দিন পর এই সমাজই আঙুল তুলে বলে ওই দ্যাখো বেশ্যা যায়!
কথাটা ভাবতেই একটু আঁতকে উঠি যেন। এবার ভাল করে তাকাই মেয়েটার দিকে। এই রকম সুন্দর ফুলের মতো নিষ্পাপ একটা মেয়ে নষ্ট হয়ে যাবে! এই মূহুর্তে আমার সামনে যে বসে আছে ভয় লজ্জা আড়ষ্টতায় সেঁধিয়ে, কাল থেকে সে রাস্তায় দাঁড়িয়ে হেসে হেসে কথা বলবে খদ্দেরদের সাথে! বুকের মধ্যে কেমন যেন মোচড় দিয়ে ওঠে। না না, তা হতে পারে না। তা হতে দেওয়া আমার উচিত হবে না। একজন মানুষ হিসেবেও তো দায়িত্ব বিপদাপন্ন কাউকে রক্ষা করা। মেয়েটা বাঁচতে চাইছে। হোক সে ভারতীয়। এই স্টেজটাই সমাজের গরীব মেয়েদের জন্যে সব চাইতে জটিল সময়। সামাল দিতে না পারলে পাঁকে পরে যাবে। সে চাক বা না চাক। সে কি আমাদের সমাজে, কি ভারতের সমাজে কি পশ্চিমে। অথচ সময়মতো যদি একটু সাহায্য পায়, ফিরে আসতে পারে সে পথ থেকে। কেউ তো ঈচ্ছা করে বেছে নেয় না নরকের জীবন।
চুপচাপ বসে আছে একই ভঙ্গিতে। কেমন মায়া বোধ হয় এক ধরনের। আহা কি সারল্য! বাঁচার কি ব্যকুল চেষ্টা। সব চিন্তা ঝেড়ে ফেলে এবার মুখ খুলি। ‘ওকে, হোয়াট্স ইওর আউডিয়া, হাও ক্যান আই হেল্প ইউ?’
কান্নাভেজা কন্ঠে বলে ওঠে ‘আই ডোন্ট নো!’
বলি, তুমি কি চাও পাসপোর্ট টিকেট ফিরে পেতে মহিলাকে আমি টাকাগুলো দিয়ে দেই?
এবার বিষ্ময়ে চোখ বড় হতে থাকে ওর। বলে, কি বলছো তুমি! সেতো অনেক টাকা! আর তুমি সে টাকা দেবে কেন!
তোমাকে সাহায্য করতে।
আমি তো বলিনি টাকা দিয়ে আমাকে সাহায্য করতে! তাই যদি হতো আন্টির কথা শুনে নিজেই তো আয় করতে পারতাম!