‘ইন্ডিয়ান গার্ল!’ পার্ট-২
ভাবি, শাই ভাব ধরে নিউ কামার প্রমান করছে কিনা। এ লাইনের খদ্দেররা শুনেছি নিউ কামারদের ব্যপারে বেশী আগ্রহী হয়। টাকা পয়সা নিয়ে বার্গেনিংয়ে যায়না। মহিলাটি তার ভাষায় আরো কিছু বলে মেয়েটির উদ্দেশ্যে। কন্ঠে এবার রীতিমতো ধমক। যেন হুকুম।
মিনিটখানেক যায়। আমি তাকিয়ে রয়েছি অদুরের মেয়েটির দিকে। এক ধরনের আগ্রহ জন্মায় পরের ব্যপারটা দেখতে। হুকুমে কাজ হলো বলে মনে হলো। এক পা দু’পা করে এগিয়ে আসতে থাকে মেয়েটি। হাসিতে মুখ ভরে ওঠে এ মহিলার। একটু দুরত্ব রেখেই দাঁড়ায় মেয়েটি। দৃষ্টি নীচের দিকে। জড়োসরোভাব তখনো।
একেবারে ছিপছিপে গড়নের একটি মেয়ে। ভালো করে চেহারাটা দেখা যাচ্ছিলো না। তবে মনে হলো বয়স পচিশ ছাব্বিশ হবে। শাড়ী পরেছে সাউথ ইন্ডিয়ান ঢংয়ে। হালকা হলুদ গোলাপী কলাপাতা রং মিলিয়ে একটা সিল্ক বা শিফনের শাড়ি। পরিষ্কার আলো না থাকায় চেহারাটা ভালো দেখা যাচ্ছিলো না। গায়ের রং শ্যামলা হবে। মুখে পাউডার ঘষার মতো প্রলেপ। খানিকটা সেজেছে যেন। কপালে একটা লাল টিপ।
আমাকে একদৃষ্টে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মহিলা বলে ওঠে ‘ইউ লাইক হার?’
আমি ফিরি তার দিকে। বলে চলে ‘টেক হার। ইউ উইল বি হার ফার্ষ্ট ম্যান।’ বলে একটু মুচকি হাসে।
চমকে উঠি এ কথায়। ফার্ষ্ট ম্যান মানে! এ ব্যবসায় এই প্রথম নামা! নাকি খদ্দেরকে প্রলুব্ধ করার এটাও একটা কৌশল! এই প্রথম, আর কারো সাথে যায় নি কখনো। শুনেছি এ ব্যবসার বুলিই নাকি এই। সব খদ্দেরকেই বলা হয়, তুমিই আমার প্রথম পুরুষ।
হাসি পায় মহিলাটির কথায়। সামলে নিয়ে বলি ‘শি নেভার হ্যাড এ ম্যান বিফোর!’
‘নো। ইউ উইল বি হার ফার্ষ্ট ম্যান। বিলিভ মি।’
‘রিয়েলি!’ বলে হেসে দেই।
তামিলনাড়– থেকে হংকং এসেছে। সেজেগুজে রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছে খদ্দের ধরতে। আর বলছে ফার্ষ্ট ম্যান! আমার হাসি দেখে মহিলাটি একটু শক্ত হয়। বলে ‘ইউ ডোন্ট বিলিভ মি? টেক হার এ্যন্ড সি।’
আমার যা বোঝার হয়ে গেছে। মিনিট দশেকের ওপরে দাঁড়িয়ে আছি এখানে। আশপাশ দিয়ে লোকজনের চলাচল বেশ। কেউ লক্ষ্য করছেনা আমাদেরকে। তবে একটু দুরে রাস্তার পাশের রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়ানো কয়েকটা বাঙ্গালী ছেলেকে দেখলাম বারবার তাকাচ্ছে এদিকে। হয়তো এ ব্যপারগুলো ওরা জানে। একবার চোখাচোখিও হলো একজনের সাথে। আড়চোখে দেখলাম নিজেদের মধ্যে কিছু বলাবলি করে হেসে উঠছে মাঝে মাঝে। উপলক্ষ্যটা যে আমি, বুঝতে পারছিলাম। অবশ্য তাতে আমার কিছু যায় আসে না। এটা ঢাকা শহর নয়। পুরো পশ্চিমা ধাঁচের হংকং। এখানে কে কাকে দেখে কি বললো, হাসলো না কাঁদলো তা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। তবে ওদের ভাব দেখে মনে হলো ওরা বুঝতে পেরেছে আমি একজন বাঙ্গালী। রাস্তা থেকে মেয়ে টোকাচ্ছি। হয়তো অনেকেই এ কাজ করে। অপেক্ষা করছে দেখতে শেষ পর্যন্ত কি করে তাদের দেশী ভাইটি।
এবার মহিলার দিকে চোখ ফেরাই। সেও তাকায় আমার দিকে। রাজ্যের আশা আর এক ধরনের উৎকন্ঠা সে দৃষ্টিতে। যেন চাইছে আমি রাজী হই। অবশ্য না করে দিলে ওদের কিছু যায় আসেনা। আরো অপেক্ষা করবে। শুধাবে লোকজনকে। এবং এক সময় পেয়েও যাবে কাউকে। শুধাই ‘হয়্যার ইউ স্টেয়িং?’
মহিলাটি বলে, পাশের বিল্ডিংয়েই। মিরাডর ম্যানশন।
কোন গেস্ট হাউস?
আমার এ প্রশ্নে সন্দিগ্ধ চোখে তাকায় মহিলা। ওর ঠিকানা জানতে চাইছি কেন! এবার পাল্টা শুধায়, তুমি কোথায় থাকো?
বলি, একই বিল্ডিংয়ে।
কোন গেষ্ট হাউস?
মুখ ফষ্কে বের হয়ে যায়, চ্যাংওয়ে।
একটু কি যেন ভাবে মহিলা। তারপর বলে, টেন ফ্লোর?
হঠাৎ খেয়াল হয় ওকে গেস্ট হাউসের নাম বলাটা ঠিক হলো কি! প্রসঙ্গ চাপা দিতে বলি ‘আই ডোন্ট নো।’
হেসে বলে,‘ইউ ডোন্ট ওয়ান্ট টু টেক হার ইন ইওর রুম?’
আমি চুপ হয়ে যাই। ভাবি, অনেক হয়েছে। কৌতুহল জেগেছিলো, মিটেছে। এবার বিদায় নিয়ে চলে যাওয়াই ভালো। বলি ‘লুক, আই এ্যম সরি।’ তোমরা ভুল লোককে ধরেছো।
কি বললে! মহিলাটির কন্ঠে রীতিমতো বিষ্ময়।
বলি, দ্যাখো, আমি এ লাইনের লোক না।
আমার কথায় মহিলা যেন ঝাড়া দিয়ে ওঠে এবার। অনেকটা খেকিয়ে ওঠার মতো করে বলে, তাহলে এতক্ষন আমাদের সময় নষ্ট করলে কেন?
আমি তার কথায় না গিয়ে তাকাই ও মেয়েটার দিকে। কেমন যেন খটকা লাগে হঠাৎ। দেখে মনে হচ্ছে বেশ ভীত মেয়েটি। তাকিয়ে রয়েছে আমার দিকে। জড়োসরোভাব কাটেনি। না, কোন অভিনয় তো মনে হচ্ছে না। খদ্দের ধরতে রাস্তায় নেমেছে, এমন আড়ষ্ট সংকুচিত কেন! ডাকি ‘এ্যয়, ইউ গার্ল। কাম হিয়ার। লুক এ্যট মি।’
আমার কথায় মহিলাটি যেন আবার আশার আলো দেখতে পায়। তামিল ভাষায় কিছু বলে মেয়েটির উদ্দেশ্যে। হয়তো আমি যা বলছি তা করতে বলছে।
কাজ হয়। দু’পা এগিয়ে আসে এবার সে। দৃস্টি নীচের দিকে। এখন আমাদের ব্যবধান তিন হাতের মতো। আরো একটু আলোতে এসেছে। এবার আরো স্পষ্ট দেখতে পেলাম চেহারাটা। চুল সিঁথি করে দু’পাশে ছড়ানো। গোড়ার দিকটা রিবন দিয়ে বাধা। অবাক হয়ে গেলাম একটা অদ্ভূত সুন্দর মিস্টি মুখ। কাটা চেহারা। কোথাও বাড়তি কিছু নেই। টিকালো নাক। আয়ত চোখদু’টোয় মায়াবি চাহনি। সারা চেহারায় এক অনির্বচনীয় সৌন্দর্য্য। এক মোহনীয় আকর্ষন। হঠাৎই মনে হলো একটা ধাক্কা খেলাম যেন কিছুর সাথে। মুখ দিয়ে অষ্ফুটে বের হয়ে এলো ‘ও মাই গড্!’ সঙ্গে সঙ্গে দু’জনেই চমকে ওঠে। আমার দৃষ্টি মেয়েটার ওপরই আটকে থাকে কয়েক মুহুর্ত। ভাবি এমন সুন্দর একটা মেয়ে, এই পেশায় নেমেছে!
পর মুহুর্তেই সামলে নিতে হয় নিজেকে। সহজ হয়ে বলি ‘লুক এ্যট মি।’
সঙ্গে সঙ্গে মহিলাটিও কিছু বলে ওঠে। এবার ধীরে ধীরে মুখ তোলে মেয়েটি। ভালো করে তাকাতে অবাকই হলাম। চোখের কোন দু’টো কি চিক চিক করে উঠলো ওর! মনে হলো পাপড়ি দু’টোও ভেজা খানিকটা। সেকি! খদ্দের শিকারে চোখ ভেজা থাকবে কেন!
সন্দেহ হয়, কিছু একটা গন্ডগোল আছে কি এর মধ্যে! শুধাই ‘আর ইউ ওকে?’
আমার মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে বলে ওঠে মহিলাটি ‘শি ইজ ওকে, শি ইজ ওকে।’
বলি, মনে হচ্ছে মেয়েটা আপসেট। ও কি ভয় পেয়েছে?
মহিলাটি এবার ইঙ্গিতময় ভঙ্গিতে হেসে ওঠে। ফিসফিস করে বলে, বলেছিলাম না সে একেবারে আনকোড়া। ফ্রেশ ফ্রম ইন্ডিয়া। জানো না মেয়েরা যখন প্রথমবারের মতো কোন পুরুষের কাছে যায় ভীতই থাকে।
আমি তাকাই তার দিকে সন্দিগ্ধ চোখে। কি বোঝাতে চাইছে। মহিলাটি হেসে চলে নি:শব্দে। ফিরি মেয়েটার দিকে। এ সময় লক্ষ্য করলাম কেমন যেন ঠায় তাকিয়ে রয়েছে আমার দিকে। ছলছল চোখ। সন্দেহ নাই একটু আগে কেঁদেছে। পুরো ব্যপারটা বেশ রহস্যজনকই ঠেকে। এবার ভালো করে তাকাই ওর চোখের দিকে। মেয়েটিও তাকিয়ে আমার চোখের দিকে। মনে হলো সে যেন বোঝার চেষ্টা করছে আমাকে।
হঠাৎই কেমন একটু অস্বস্তি বোধ হয় আমার। সব মিলিয়ে ব্যপারটা ভালো ঠেকছিলো না। কিছু একটা গন্ডগোল যে আছে সেটা বোঝা গেছে। কিন্তু কি, পুরোটা বুঝতে গেলে এর মধ্যে ঢুকতে হবে। একবার ভাবি, দেখবো কি আসলে ঘটনাটা কি! আবার ভাবি, না: দরকার নাই বাবা। যে যার ব্যপার নিয়ে আছে, আমার কি দরকার অন্যের ভ্যাজালে নাক গলানোর! কিন্তু মেয়েটার দৃষ্টির সেই আকুতি যেন এলোমেলো করে দিতে চায় মনটাকে।
আমাকে চুপ থাকতে দেখে বলে ওঠে মহিলাটি, ‘ইউ লাইক হার?’
বলি, ‘ইয়েস। শি ইজ বিউটিফুল।’
এবার বেশ খুশী হয়ে ওঠে। বলে, তাহলে তুমি তাকে নিচ্ছো!
চমকে উঠি, কোথায়!
হেসে বলে ‘নো প্রবলেম। ইউ ক্যান টেক হার টু আওয়ার রুম।’
‘হোয়াট? হেল নো!’ বলে তাকাই তার দিকে। এবার ধাতস্থ হয়ে উঠি। কেটে যায় ভাবালুতা।
মহিলা বলে, তাহলে তোমার রুমে নিয়ে যাও!
-চলবে…