কানাডার টরন্টোয় শিল্প-সাহিত্যচর্চার প্ল্যাটফর্ম পাঠশালার ১৬তম আসর হয়ে গেল যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের অন্যতম প্রভাবশালী লোকগায়ক পিট সিগারকে নিয়ে। গণমানুষের নায়ক ও বিপ্লবী চিন্তার দ্রষ্টা পিট সিগারের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে এবারের আসরে আলোচনা হয় পিট সিগারের ওপর অ্যালান এম উইঙ্কলারের লেখা ‘টু এভরিথিং দেয়ার ইজ আ সিজন: পিট সিগার অ্যান্ড দ্য পাওয়ার অব সং’ বইটি নিয়ে।
গত বৃহস্পতিবার (২১ নভেম্বর) এগলিন্টন স্কয়ারের টরন্টো পাবলিক লাইব্রেরিতে আয়োজিত এবারের আসরে আলোচনা করেন লেখক-অনুবাদক মুস্তাফা মাহমুদ ও সূত্রধরের দায়িত্ব পালন করেন ফারহানা আজিম শিউলী।
আসরে জানানো হয়, শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রাম, বর্ণবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম, পরিবেশ রক্ষার সংগ্রামসহ বিশ শতকের ন্যায়সংগত প্রতিটি প্রতিবাদ-আন্দোলনের সাংগীতিক ভাষ্যকার-আমেরিকার বিশ্বখ্যাত গণপ্রতিবাদী লোকসংগীতশিল্পী, সংগীতবিশারদ, গানের সংগ্রাহক ও রচনাকারী, গণমানুষের নায়ক ও বিপ্লবী চিন্তার দ্রষ্টা ছিলেন পিট সিগার।
২০০৯ সালের ৩ মে। নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে ১৫ হাজারের বেশি ভক্ত সমবেত হয়েছিলেন। সবাই এসেছিলেন খুব দীর্ঘদেহী, খুব হালকা-পাতলা, খুব সাধারণ পোশাক পরা একজন মিউজিশিয়ানকে শ্রদ্ধা জানাতে। সেদিন ছিল তাঁর ৯০তম জন্মদিন। কে ছিলেন এই শিল্পী? যদিও তাঁর লেখা ও গাওয়া গান আমেরিকাজুড়ে পরিচিত, কিন্তু আমাদের অনেকেই হয়তো তাঁর সম্পর্কে ততটা জানেন না। অবশ্য এর একটা বড় কারণ, তিনি রেডিওতে নিষিদ্ধ ছিলেন। টিভিতেও তাঁকে কখনোই দেখা যায়নি। সেই রাতে সবাই তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিলেন তাঁর গানের জন্য এবং নিজস্ব বিশ্বাসে অটল থাকার জন্য। তাঁর বিশ্বাসটা কী ছিল? তাঁর বিশ্বাস ছিল সব মানুষ সমান, গায়ের রং যা–ই হোক না কেন; পরিবেশ–প্রকৃতিকে বাঁচাতেই হবে এবং পৃথিবীতে শান্তি সম্ভব।
ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে সে অনুষ্ঠানে সেই শিল্পীর সম্মানে গেয়েছিলেন সংগীত লিজেন্ডরা—ব্রুস স্প্রিংস্টিন, ডেইভ ম্যাথিউস, জোয়ান বায়েজ প্রমুখ। একদম শেষে সব লিজেন্ডসহ পুরো অডিয়েন্স একসঙ্গে গেয়েছিল ‘উই শ্যাল ওভারকাম’ গানটি। গত শতকের ষাটের দশকে সমধিকারের জন্য যখন আফ্রিকান-আমেরিকানরা প্রাণপণ লড়াই করছিলেন, তখন সেই শিল্পী এই গানকে স্লোগানে পরিণত করেছিলেন। আর তাঁর দীর্ঘ জীবনে একটাই গল্প, মুক্তির জন্য গান গাওয়া।
আলোচক মুস্তাফা মাহমুদ বলেন, বিত্তবান ও হার্ভার্ডপড়ুয়া, বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-পিয়ানিস্ট চার্লস সিগার ও নামকরা ভায়োলিনিস্ট কন্ট্যান্সের সন্তান পিট সিগার সেই শিল্পী। পিট নিজেও পড়েছেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। কয়েক প্রজন্মের শিক্ষা-পারিবারিক আভিজাত্য পায়ে মাড়িয়ে তিনি হাতে তুলে নিয়েছিলেন পাঁচ তারের ব্যাঞ্জো আর কণ্ঠে গণমানুষের গান। শিশুদের জন্যও গেয়েছেন অসংখ্য গান। আর তাঁর ৯৫ বছরের দীর্ঘ অভিযাত্রায় সঙ্গী হয়েছেন লিড বেলি, পল রবসন, উডি গাথরি, বব ডিলানের মতো পৃথিবীখ্যাত আইকনিক শিল্পীরা, সঙ্গে জোয়ান বায়েজ-আর্লো গাথরি প্রজন্মও।
মুস্তাফা মাহমুদ বলেন, ১৯৫৭ সালে আমেরিকার টেনেসির হাইল্যান্ডার স্কুলে (ইন্টাররেসিয়াল স্কুল) মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের উপস্থিতিতে বেশ প্রাচীন একটি গসপেল গানের কথায় কিছু পরিবর্তন এনে নতুন এক স্তবক জুড়ে ‘উইল’–এর জায়গায় ‘শ্যাল’ করে প্রথমবারের মতো ‘উই শ্যাল ওভারকাম’ গানটি পরিবেশন করেন পিট সিগার। সেই গান পঞ্চাশ ও ষাটের দশকজুড়ে সিভিল রাইটস মুভমেন্টের আন–অফিশিয়াল অ্যান্থেম হয়ে দাঁড়ায়। পৃথিবীজুড়ে বিভিন্ন ভাষায় গানটি প্রটেস্ট মুভমেন্টের অপরিহার্য সংগীত হয়ে ওঠে।
আলোচক বলেন, গত শতাব্দীর পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে যুদ্ধবিরোধী গান গেয়ে আলোড়ন তোলেন প্রটেস্ট মুভমেন্টের সাংগীতিক ভাষ্যকার, আমেরিকার লোকগায়ক পিট সিগার। ভিয়েতনাম যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে যুদ্ধবিরোধী ভূমিকাকে তুলে ধরতে পিট সিগার রচনা ও সুরারোপ করেন ‘হোয়্যার হ্যাভ অল দ্য ফ্লাওয়ারস গন’ গানটি। সেই গান এখন পর্যন্ত যুদ্ধবিরোধী গানের আইকন হয়ে আছে। দেশ-কালনির্বিশেষে অসংখ্য ভাষায় প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে প্রবাহিত পিট সিগারের অবিস্মরণীয় সেই গান।
মুস্তাফা মাহমুদ বলেন, এ দুটি গান ছাড়াও পিট সিগারের গাওয়া ‘ইফ আই হ্যাড আ হ্যামার’, ‘টার্ন টার্ন টার্ন’—এসব গানও সারা পৃথিবীর মানুষের মুখে মুখে। নামী লেখক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অ্যালান এম উইঙ্কলার তাঁর ‘টু এভরিথিং দেয়ার ইজ আ সিজন: পিট সিগার অ্যান্ড দ্য পাওয়ার অব সং’ বইয়ের শিরোনাম নিয়েছেন পিট সিগারের অত্যন্ত বিখ্যাত ২০ শতকের সিভিল রাইটস মুভমেন্টের অনানুষ্ঠানিক জাতীয় সংগীত ‘টার্ন টার্ন টার্ন’ গানটি থেকে।
আলোচক বলেন, পৃথিবীর নানা অঞ্চলের নানান ভাষার লোকগান প্রথম পিট সিগারের কণ্ঠেই শোনে সারা পৃথিবীর মানুষ। এ পর্যায়ে আলোচক মুস্তাফা মাহমুদ গেয়ে শোনান পিট সিগারের কণ্ঠে পরিচিতি পাওয়া বিশ্বময় অসম্ভব জনপ্রিয় স্প্যানিশ ভাষায় কিউবার লোকসংগীত ‘গুয়ান্তানামেরা’।
মুস্তাফা মাহমুদ বলেন, অ্যালান এম উইঙ্কলার তাঁর ‘টু এভরিথিং দেয়ার ইজ আ সিজন: পিট সিগার অ্যান্ড দ্য পাওয়ার অব সং’ বইতে দেখিয়েছেন সারা পৃথিবীর সুবিধাবঞ্চিত মানুষের অধিকার আদায়ে, সিভিল রাইটস মুভমেন্টে, পরিবেশ রক্ষার আন্দোলনে, শান্তি রক্ষার আন্দোলনে, বর্ণবৈষম্যবিরোধী মুভমেন্টে কীভাবে পিট সিগার তাঁর সাংগীতিক প্রতিভাকে কাজে লাগিয়েছেন।
বইয়ের আলোচনার সঙ্গে সম্পূরক তথ্য হিসেবে আলোচক মুস্তাফা মাহমুদ বলেন, ‘“আমরা করব জয়”, “নাম তার ছিল জন হেনরি”, “ফুলগুলো কোথায় গেল” গানগুলো আমাদের সামাজিক-রাজনৈতিক প্রতিবাদের হাতিয়ার, শান্তি-সম্প্রীতির বাহক। এ গানগুলো আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ। এ গান শোনেননি, উদ্দীপ্ত হননি, এমন বাঙালি বিরল। আর এসব গানের প্রতিটির সঙ্গে জড়িয়ে আছেন পিট সিগার। পিট সিগারের “উই শ্যাল ওভারকাম”, “জন হেনরি”, “জন ব্রাউন,” “হোয়্যার হ্যাভ অল দ্য ফ্লাওয়ারস গন”—গানগুলোর সুর ও কথা বাংলায় প্রাণ পেয়েছে ১৯ শতকে বাংলার প্রতিবাদ আন্দোলনের শিল্পী-সংগঠক হেমাঙ্গ বিশ্বাসের হাতে। ভিয়েতনাম যুদ্ধবিরোধী পিট সিগারের লেখা ও সুর করা “হোয়্যার হ্যাভ অল দ্য ফ্লাওয়ারস গন” গানটির ছায়ায় হেমাঙ্গ বিশ্বাস রচনা করেন “ফুলগুলি কোথায় গেল”।’
উল্লেখ্য, ১৯৬৫ সালে পিট সিগার কলকাতায় এলে সরাসরি তাঁর কাছে হেমাঙ্গ বিশ্বাস এই গান শেখেন এবং গানটিতে মুগ্ধ হেমাঙ্গ ‘ফুলগুলি কোথায় গেল’ রচনা করেন। পিট সিগারের ‘জন হেনরি’র আদলে হেমাঙ্গ বিশ্বাস সৃষ্টি করেন ‘নাম তার ছিল জন হেনরি,’ ‘জন ব্রাউন’–এর ছায়ায় করেন ‘জন ব্রাউনের দেহ শুয়ে সমাধিতলে’। আর পিট সিগারের গাওয়া বিশ্বজুড়ে সামাজিক প্রতিবাদ আন্দোলনের অ্যান্থেম, আইকনিক গান ‘উই শ্যাল ওভারকাম’ থেকে হেমাঙ্গ বিশ্বাস রচনা করেন ‘আমরা করব জয়’। হেমাঙ্গ বিশ্বাস পিট সিগারের আরও কয়েকটি গান থেকে বাংলার প্রতিবাদ-সংগীত/গণসংগীত তৈরি করেন। পিট সিগারের গান থেকে বাংলা গান বেঁধেছেন কবীর সুমন, গান বেঁধেছে ক্যালকাটা ইয়ুথ ক্যয়ার। তাঁর গান থেকে সৃষ্টি হয়েছে বাংলা কবিতাও।
মুস্তাফা মাহমুদ বলেন, এই বইয়ে পিটের দীর্ঘ জীবন এবং দারুণ সব গানের আলোচনার মধ্য দিয়ে ২০ শতকের বিভিন্ন প্রটেস্ট মুভমেন্টে লোকগানের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা তুলে ধরা হয়েছে। ত্রিশের দশকের ইউনিয়ন মুভমেন্টের অন্যতম সমর্থক পিট কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়ে শ্রমিকদের সলিডারিটি জাগাতে ব্যাঞ্জো ও গিটার হাতে গান করেন। পঞ্চাশের দশকে লালভীতির সময় তাঁর এই বিপ্লবী অতীতের জন্য তিনি তীব্র রোষের শিকার হন। ষাটের দশকের সিভিল রাইটস মুভমেন্টের তিনি হয়ে ওঠেন মুখপাত্র। শাসকের বর্ণবাদী বৈষম্যের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন এবং প্রতিবাদীদের সাহস জোগান গান গেয়ে। ২০ শতকের শেষভাগে এসে তাঁর গান সহায় হয় ভিয়েতনাম যুদ্ধবিরোধী মুভমেন্টে। আবারও রোষানলের শিকার হন তিনি। আর সত্তরের দশকে হাডসন নদী সংস্কারের মধ্য দিয়ে পরিবেশবাদী অ্যাকটিভিস্ট হিসেবে কণ্ঠে তুলে নেন গান।
আলোচক বলেন, উইঙ্কলার যে মানুষটির গল্প বলেছেন, সেটি আর একক ব্যক্তির গল্প থাকেনি। হয়ে উঠেছে একটি জাতির একটি পৃথিবীর গল্প, যে গল্পের অন্যতম নায়ক ব্যাঞ্জো হাতে এক লোকগায়ক।
বইয়ে উত্তর খোঁজা হয়েছে কয়েকটি মৌলিক প্রশ্নের। ১. পিট সিগারের আকর্ষণ-ক্ষমতার উৎস কী? ২. তিনি কেমন করে সারা পৃথিবীর মানুষের মনোযোগ কাড়তে সক্ষম হয়েছেন এবং ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছেন? এবং ৩. গান কেন এতটা শক্তিশালী মাধ্যম?
আলোচকের প্রাণবন্ত আলোচনায় উপস্থিত শ্রোতারাও এ প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে ফিরেছেন এবং পেয়েছেন। আলোচনার ফাঁকে ফাঁকে পিট সিগারের ওপর ভিডিও ক্লিপ দেখানো হয়। বিশ শতকের এই মহান শিল্পীর জন্মশতবর্ষে পাঠশালার পক্ষ থেকে সবাই মিলে ‘উই শ্যাল ওভারকাম’ গানটি গেয়ে অভিবাদন জানিয়ে আসর সমাপ্ত করা হয়।