-অনিন্দিতা চৌধুরী
তারিখটি ছিল ফেব্রুয়ারির ৮। কানাডার টরন্টো শহরে তাপমাত্রা সেদিন ছিল নিগেটিভ ২২ ।দুদিন অনবরত বরফ পড়ার পর সেই শনিবার সকালে ঝলমলে রোদ উঠলেও, হাড় হীম করা ঠান্ডা।এমন দিনে কী আর বাঙালির বিছানা ছাড়তে ইচ্ছে করে ! তা সত্ত্বেও ছয়শ’রও বেশি বাঙালি একত্রিত হলো পূর্বায়ন এর সরস্বতী পুজোয় – কেবলে বাঙালি “ল্যাদ”।
বিদেশের পুজোতো দেশের মতো গুপ্ত প্রেসের নিদান মেনে হয় না, উইকেন্ড আর কবে জায়গা পাওয়া যাবে, তার উপর নির্ভর করে দেব-দেবীদের যাওয়া আসা! সেই তারিখে টরন্টো শহরে পূর্বায়ন নামক সংস্থা আয়োজন করেছিল সরস্বতী পুজোর। পূর্বায়ন – এর এই বার ছিল সপ্তম বছর।দুপুরের দিকে ঘুরে গেলেন ইন্ডিয়ান কনসাল জেনারেল অপূর্বা শ্রী বাস্তব, আর বাংলাদেশের কনসাল মানসুরিন খান চৌধুরী।দুজনেই প্রভূত প্রশংসা করলেন পূর্বায়ন-এর প্রচেষ্টার।
দেশের থেকে বহুদূর- এ যাঁরা বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন, পূর্বায়ন প্রতি বছর এমন একজনকে সম্মান জানায়।এই বছর তারা বেছে নিয়েছিল দুই বাংলার অতি পরিচিত, বিশিষ্ট গবেষক ও লেখক সুব্রত কুমার দাসকে। সুব্রত কুমার দাসের জন্ম ১৯৬৪ সালে, বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলায়।এ পর্যন্ত তাঁর রচিত, সম্পাদিত এবং অনূদিত গ্রন্থের সংখ্যা ২৭। তাঁর গভীর অনুসন্ধানের বিষয় জাপান-বাংলা সর্ম্পকের আদি ইতিহাস এবং ভারতীয় পুরাণ।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং কাজী নজরুল ইসলাম নিয়ে বই লেখাও অনুবাদ করা ছাড়া ও তিনি লিখেছেন ‘শ্রীচৈতন্যদেব’, ‘আমার মহাভারত’ ইত্যাদি।গত বছর কানাডার সাহিত্য নিয়ে প্রথম বাংলা বই রচনা করেন তিনি যেটি সুধী মহলে ব্যাপক ভাবে প্রশংসিত হয়েছে।
পূর্বায়নের এই বছরের থিম ছিল বাংলা ভাষা।দেশ থেকে বহুদূরে বড়ো হওয়া দ্বিতীয় প্রজন্মের কাছে বাংলা ভাষাকে তুলে ধরাই ছিল উদ্দেশ্য।একুশে ফেব্রুয়ারী-র শহীদদের সম্মান জানানোর জন্য সমস্ত ডেকোরেশন ছিল সাদা আর কালোয়।প্রায় একশো-র কাছা কাছি শিশু-কিশোর, যাদের বয়স চার থেকে ষোলো, এবং অধিকাংশের ই জন্ম ভারতের বাইরে, অংশ গ্রহণ করলো দুপুর আড়াইটে থেকে হওয়া সাংস্কৃতিকঅনুষ্ঠানে।কচি-কাচাদের ধিতাং ধিতাং বোলের তালে তালমেলানো থেকে শুরু করে, বাংলা ভাষার বিভিন্ন রূপ কেনা চের মধ্যে দিয়ে ফুটিয়ে তোলা, বা একশো বছরের বাংলা সিনেমার প্রতি তাদের শ্রদ্ধার্ঘ্য, দর্শকদের মন ছুঁয়ে গেলো। ছোট্ট ছোট্ট ছেলে মেয়েরা যারা হয়তো উত্তম কুমার বা সুচিত্রা সেনের কোনো ছবি-ই দেখেনি, তারাই মঞ্চে ফুটিয়ে তুললো কিংবদন্তি নায়ক-নায়িকাদের অমরকরে দেওয়া গান এবং দৃশ্য গুলিকে! শুধু বাচ্চারাই নয়, নাচ গানের মনোরঞ্জনে বড়রাও কিছু কম ছিলো না।বাংলার দৈনন্দিন জীবনের টুকরো টুকরো দৃশ্য নাচ গানের মধ্যে দিয়ে তুলে ধরলেন তাঁরা।কিছু বহুল প্রচলিত বাংলাগানের সঙ্গে একেবারে নতুন আঙ্গিকে “ফিউশন” নৃত্য মন জয় করলো দর্শকদের।এইঅনুষ্ঠান গুলির পরিচালনায় ছিলেন চন্দনা কুন্ডু বেহেল, কেয়াকলি ঘোষ, ইন্দিরা দেব, এবং সুতমা ঘোষ সকালেই ছিল পুজো, অঞ্জলি, আর হাতে খড়ি।পুজোর শেষে আয়োজন ছিল সবার জন্য ফল প্রসাদের।আর ছিল বাচ্চাদের জন্য ‘বসে আঁকো’ প্রতিযোগিতা, যেটিতে প্রায় ৫০টির ও বেশি শিশু অংশ গ্রহণ করে।বসে আঁকো প্রতিযোগিতার বিষয় ছিল “তোমার চোখে সরস্বতী পুজো”।শ্রেষ্ঠ ছবি বাছতে তিন বিচারক দেবাশীষ গাঙ্গুলী, অনন্যা মজুমদার, এবং ঐন্দ্রিলা ঘোষকে বেশখানিকটা কষ্ট করতে দেখা গেলো!
বাঙালির কি আর খাবার ছাড়া চলে! আর সেই কথা মাথায় রেখেই পূর্বায়ন অন্যবারের মতোই আয়োজন করেছিল খিচুড়ি, তরকারি, চাটনি আর মালপোয়ার।বিভিন্ন খাবারের স্টল থেকে পাওয়া যাচ্ছিলো জিভে জল আনা এগরোল, ফুচকা, চপ, বিরিয়ানি, এমন কি মশলা থাম্বস আপ! আর ছিল শাড়ি, গয়না, বাংলা বই -র নানান সম্ভার।সামনেই স্কুল-এর ছুটি, আবার ট্যাক্স জমা করার ও দিনআসছে।আর সেই কথা মাথায় রেখেই হাজির ছিলেন বিভিন্ন ট্রাভেল এজেন্সী এবং ফিনান্সিয়াল সার্ভিস এর প্রতিনিধিরা।সাহায্যের হাতবাড়িয়ে দিয়েছিলেন টরন্টোর অতি সুখ্যাত দুই রিয়েল এস্টেট এজেন্ট।এছাড়াও আয়োজন ছিল কলকাতার বিভিন্ন স্কুলের রিইউনিয়নের এবংএই বছর থেকে শুরুকরা নিউকামার্স মিট, যেখানে হাজির ছিলেন সেটেলমেন্ট এজেন্সির প্রতিনিধিরা।অংশ গ্রহণ কারীদের মধ্যে যেমন ছিলেন সদ্য টরন্টো আসা পরিবার তেমনি ছিলেন পুরোনোরাও।সব মিলিয়ে সে এক জম জমাট ব্যাপার।পূর্বায়ন এর এক প্রতিনিধিকে বলতে শোনা গেলো পনেরো বছর আগে তিনি যখন এসেছিলেন, নিজের “কমিউনিটি”র থেকে এই সাহায্য ছিল কল্পনাতীত, আর বাংলা ভাষায়সেই “সাপোর্ট সিস্টেম” তৈরী করার জন্যই তাদের এই প্রচেষ্টা।এখানে কারুর-ই পরিবার নেই, তাই ভাষাই হয়ে উঠুক আত্মীয় তার যোগসূত্র।
পূর্বায়ন যেমন সেতু তৈরী করছে বাংলা ভাষার সঙ্গে দ্বিতীয় প্রজন্মের, তেমনি আবার তারা সচেষ্ট প্রবাসী বাঙালিদের কানাডার সঙ্গে মেল বন্ধনে।আর এই মিলন মেলার যোগ সূত্র হিসেবে বাংলা ভাষাকেই তারা বেছে নিয়েছিল। অনুষ্ঠানের সঞ্চালিকাদের একজন ছিলেন কলকাতার বাঙালি অনিন্দিতা, একজন মুম্বাইয়ের বাঙালি শর্মিনী, আর অন্যজন ছিলেন ঢাকার বাঙালি দীপা।ভিন্ন জায়গায় জন্মানো সত্ত্বেও, বাংলা ভাষার প্রতি তাদের শ্রদ্ধা যে কিছুমাত্র অভিন্ন নয়, সে কথাই বলতে শোনা গেলো।মঞ্চে বাংলা ভাষার নাচ গানের মধ্যে দিয়ে এক হয়ে গেলো দুই বাংলার শিশুরা, তাল মিলিয়ে পা ফেললেন বড়োরা।কিছুক্ষণের জন্য হলেও ভাষাই ঝাপসা করে দিলো ৭০বছর আগে টানা সিরিল রাডক্লিফ-এর সেই স্বৈর রেখা।
সমগ্র অনুষ্ঠানটির পরিচালনায় ছিলেন পূর্বায়নের ৩৪টি সদস্য পরিবার: শঙ্কর দত্ত, বিজয় চক্রবর্তী, বাসব গোস্বামী, প্রদীপ্ত চ্যাটার্জী, সন্দীপ চৌধুরী, প্রসেনজিৎ রায়, অতনু চৌধুরী, অংকুশ বিশ্বাস, সৌমক চ্যাটার্জী, সীমার বেহেল, ঋত্বিক দত্ত, প্রদীপ ভট্টাচার্য, মৃণাল ঘোষ, ডন সিনহা, সৌমিত্র রায়, রেমন্ড গ্যারিসন, নীলাঞ্জন রায়, দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, সন্দীপন কুন্ডু, পার্থপ্রতিম চট্টোপাধ্যায়, অভিষেক সেনাপতি, দেব কান্তি মজুমদার, প্রসেনজিৎ রায়, ইন্দ্রনীল ঘোষ, সৌরভ সেন গুপ্ত, প্রদীপ্ত পাল, বুদ্ধদেব বন্দোপাধ্যায়, শুভজিৎ ঘোষ, তাপস সরকার, স্বপ্ননীল সাহা, নীল মুখার্জী, অরিন্দম মজুমদার, টিনা চক্রবর্তী, উতথ্য রায় এবং তাদের পরিবারের সদস্যরা ।
মূলত বাঙালির উৎসব হলেও, এসে ছিলেন ভারতের অন্য সম্প্রদায়ের মানুষেরা ও; এমনকি বেশ কিছু অভারতীয়রাও । রেমন্ড গ্যারিসনের কন্যা সৰ্জনা যখন মঞ্চে “আমি মিস ক্যালকাটা”-র সঙ্গে নাচছে, গর্বিত পিতাকে দেখা গেলো, উইংস এর ধার থেকে ফোনে রেকর্ড করতে। কিং বা ছয় বছরের কন্যা সিওনা যখন “ময়না ছলাৎ ছলাৎ” এর সঙ্গে গান গাইছে আর তাল মেলাচ্ছে, বাবা সীমার বেহেল তখন অতি ব্যস্ত ছবি তুলতে। স্নেহ যে ভাষার দেওয়াল মানে না!
পূর্বায়নের এই আয়োজনে টরন্টোর জনপ্রিয় কমিউনিটি টিভিএনআরবি এবং ওমনির সহযোগিতার কথা বিশেষ ভাবে মনে রাখার মতো।
সব মিলিয়ে বিদেশ বিভূঁইয়ে পূর্বায়নের সরস্বতী পূজা আর বাংলা ভাষার প্রতি তাদের শ্রদ্ধার্ঘ্য মনে করিয়ে দিলো এক রং এর কোম্পানির দুর্গা পূজাকে নিয়ে লেখা একটি লাইন – শুদ্ধ, সূচি, সুস্থরুচি।