মম কাজী
আমি বাঙালি এবং বাংলাদেশী। এই পরিচয়ে আমি গর্বিত হলেও কিছু ব্যাপার যুক্তিসঙ্গত বলে মনে হয় না, তাই মনেপ্রাণে শতভাগ বাঙালি হলেও কাজে কর্মে হয়ত সবসময় তার প্রমান দিতে পারি না।কিছু কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন সময়ের সাথে সাথে সকল কৃষ্টির মাঝে আনতে হয় তা না হলে সংস্কৃতির মৃত্যু ঘটে। আমাদের দেশে একটি কথা বহুল প্রচলিত, “অপসংস্কৃতি”। আমার বিশ্বাস, অপসংস্কৃতি বলে কিছু নেই, এর সবটাই পুরোনোকে ফেলে নতুনের দিকে ধাবিত হওয়া। সকল প্রজন্মের কাছেই তার পরবর্তি প্রজন্মের কর্মকান্ডকে অপসংস্কৃতি বলে মনে হয়েছে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর যখন বিধবাবিবাহের জন্য চেষ্টা করছিলেন, সেটাও তৎকালীন সুধিসমাজের কাছে ছিল অপসংস্কৃতি। আমি বলছি না সকল নতুন সংস্কৃতির ভালো, কিন্তু যে সব কিছুর প্রচলন অন্যত্র বছরের পর বছর ধরে কোনও বিশেষ ক্ষতির কারন না হয়েই চলে আসছে সেই ধারা আপন করে নিতে কেন এত দ্বিধা? এই মুহূর্তে “অপসংস্কৃতি” বয়ে আনার জন্য পরবর্তি অনেক প্রজন্ম হয়ত ইতিহাসের পাতায় আজকের পাড়ার বখাটে ছেলেটির নাম শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে।
ইবেলা বলে রাখি, অত্যন্ত নাজুক একটি ব্যাপারে কথা বলতে যাচ্ছি- প্রজন্ম বা জেনারেশন। যখনই এই ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলতে শুরু করি কিছু কিছু ভ্রান্ত ধারনা পাঠকের মনে আগে থেকেই তৈরী থাকে, তাই বিষয়বস্তু সম্পূর্ণ না জেনেই লম্ফ দিয়ে প্রাণপাত করে থাকেন। আমরা প্রায়ই বলতে শুনি- “ আরে আজকালকার ছেলেমেয়েরা কোনও কাজের না।”
মজার ব্যাপার হল এই কথা যেমন ৭০ বছরের বাবা তাঁর ৪৮ বছরের ছেলের ব্যাপারে বলেন তেমনি নবম শ্রেণীতে পড়া বড় বোন তাঁর তৃতীয় শ্রেণীতে পড়া ছোটবোন সম্পর্কেও বলে থাকে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম আসে আর এর মাধ্যমেই মানবজাতি আরও সভ্য আরও উন্নতির দিকে ধাবিত হয়। কোনও প্রজন্মের অবদানই অনস্বীকার্য নয়। এই মুহূর্তে পৃথিবীতে বেঁচে থাকা মানুষের মাঝেও রয়েছে বেশ কিছু প্রজন্ম। এদের প্রত্যেকেরই রয়েছে নিজস্ব সামর্থ্য, চাহিদা এবং অবদান। ইংরেজীতে এদের রয়েছে কিছু গালভরা নাম।
– সোনালী প্রজন্ম- ১৯৪৫ সালের পূর্বে যাদের জন্ম। তাঁরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী এবং সংগ্রামী। যুদ্ধপরবর্তী বিধ্বস্ত বিশ্বের “গ্রেট ডিপ্রেশন” জয় করে পৃথিবীতে নতুন প্রাণ দিয়েছেন। তাঁরা ধার্মিক ও স্বচ্ছ্বল।
বেবি বুমার- ১৯৪৬-১৯৬৪ সালের মধ্যে যাদের জন্ম। তাঁরা সাক্ষি হয়েছেন বহু গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ঘটনার। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বেশিরভাগ মানুষই ছিলেন এই প্রজন্মের।বেঁচে থাকার তাগিদে তাঁরা বিভিন্ন সময় প্রচলিত নিয়মের বাহিরে গিয়েছেন। তাঁরা সংগ্রামী প্রজন্ম এবং বিশ্বের মন্দার এই বাজারে পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশে এখনও কাজ করে যাচ্ছেন যদিও এখন তাঁদের অবসর গ্রহনের সময়। তাঁরা ধার্মিয় অনুশাসন মেনে চলেন।
জেনারেশন “এক্স” অথবা বিস্মৃত প্রজন্ম- ১৯৬৫-১৯৮০ সালের মাঝে এদের জন্ম। বাংলাদেশের পরিপ্রক্ষিতে তাঁরা মুক্তিযুদ্ধের সময় ছোট থাকলেও যুদ্ধের হিংস্রতা তাঁদের জীবনকে ছুঁয়ে গেছে। দুর্ভিক্ষ ও যুদ্ধপরবর্তি দরিদ্রতার অভিজ্ঞতার থাকার কারনে তাঁরা অপচয় সহ্য করেন না এবং বৈষয়িক হয়ে থাকেন। তাঁরা ছকে বাঁধা জীবনে অভ্যস্ত এবং একারনেই তাঁদের অবদান খুব একটা চোখে পড়ে না। বাংলায় ছা-পোষা এবং ইংরেজীতে “ফরগটেন” প্রজন্ম হিসেবেই পরিচিত।তাঁরা পারিবারিক মূল্যবোধ এবং সংস্কারকে গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। পৃথিবীর বেশিরভাগ গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত বর্তমানে তাঁদের হাতে।
মিলেনিয়াল- ১৯৮১-১৯৯৬ সালের মাঝে যাদের জন্ম। এরাই আজকের তরুন সমাজ যাদের শিক্ষার হার সবচেয়ে বেশি। তবে পূর্ববর্তী প্রজন্মের মত সংগ্রাম করতে হয়নি তাদের। বেশিরভাগের অভিভাবক একটা সহজ পথ তৈরী করে দিয়েছেন তাদের। এই কারনে অন্তত মৌলিক চাহিদা মেটাতে কাঠ খড় পোড়াতে হয় নি। তারা তাই পারিবারিক গন্ডি ভেঙে প্রকৃতি, পরিবেশ এবং গনমানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। তারা কোমল হৃদয়ের অধিকারী এবং অত্যন্ত অনুভূতিপ্রবণ।বাহ্যিক সৌন্দর্যের উপরে মনের সৌন্দর্য্যকে প্রাধান্য দেয়। তারা নিয়ম ভাঙার মানুষ এবং প্রচলিত প্রথা মানতে নারাজ। প্রযুক্তিগত দিক থেকে এই প্রজন্মের অবদান অনস্বীকার্য। ইন্টারনেট নিয়মিত ব্যবহারের ফলে একটি সংস্কৃতি নয়, বরং বিশ্বসংস্কৃতির সাথে তাল মিলিয়ে চলছে তারা। আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই পৃথিবীর সকল সিদ্ধান্ত এই প্রজন্মের উপরে এসে পড়বে।
জেনারেশন “যি”- ১৯৯৭-২০১০ এর মাঝে এদের জন্ম। এরা বেড়ে উঠেছে ইন্টারনেট ও প্রযুক্তির মধ্য দিয়ে এবং পড়াশুনা, কাজ সবকিছুর মাঝেই তাদের প্রযুক্তির ব্যবহার লক্ষনীয়। যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ার বিধ্বস্ত হবার পরে যেহেতু তাদের জন্ম তাই শান্তিময় পৃথিবী, বিশেষ করে মুসলিমদের প্রতি বৈষম্য এবং জঙ্গিবাদবিহীন পৃথিবীর অভিজ্ঞতা তাদের নেই। অতিরিক্ত প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে তারা সামনা সামনি কথপকথনে পারদর্শি নয়। পারিবারিক, আত্মীয় ও বন্ধুত্বের বন্ধন তাদের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু তারা অসম্ভব মেধাবী এবং পরিবেশের প্রতি অত্যন্ত দায়িত্বশীল।তারাও দৈহিক সৈন্দর্যের উপরে মানসিক সৌন্দর্য্যকে প্রাধান্য দেয়। তাদের মাঝে অসততা এবং বৈষয়িক লোভ কাজ করে খুব কম। এখন তারা ছাত্র এবং দেশের ভবিষ্যত।
স্নোফ্লেক জেনারেশন বা তুষারকনা প্রজন্ম- ২০১০ সালের পরে যাদের জন্ম। এখনও শিশু। খুব অল্প কথায় প্রজন্মের গল্প বলে গেলাম। এক একটি প্রজন্মের জন্য এক একটি বই লেখা যাবে। প্রতিটি পরিবারেই সব প্রজন্মের মানুষ থাকে। যেই পরিবার প্রজন্মের মাঝের শূন্যস্হান পূরণ করতে পারে, সেই পরিবারের বন্ধন অটুট।আর এর জন্য নিজের প্রজন্ম ছাড়াও অন্য প্রজন্মের সম্পর্কে তথ্য এবং জ্ঞান ধারন করতে হবে। একই কথা কর্মক্ষেত্র, স্কুলে, যে কোনও দলে বা আড্ডার জন্যও প্রযোজ্য।
তবে মূল কথা হল, প্রতিটি প্রজন্মই তাদের নিজগুনে অনন্য। একটি ছাড়া আরেকটি অচল এবং প্রতিটি প্রজন্মই তাদের পূর্ববর্তী প্রজন্মের কাছে ঋণী।আমরা মানুষ এবং ভুল করার চরিত্র নিয়েই আমাদের অস্তিত্ব। পৃথিবীর ইতিহাসে একটি প্রজন্মের ভুল থেকেও পরবর্তী প্রজন্ম শিক্ষা গ্রহন করে এবং পৃথিবীকে আর একটু বেশি বাসযোগ্য করে তোলে।
হাজার বছরের অত্যাচারে পৃথিবীর পরিবেশ আজ রুগ্ন। তাই এখনকার তরুন প্রজন্ম পৃথিবীর হয়ে কাজ করতে আগ্রহী। তেমনি হাজার বছরের শিক্ষার আলোয় আলোকিত না হলে তাদের মাঝে এই বোধ কাজ করত না। মানবজাতিকে এগিয়ে নিয়ম যাওয়াটাই প্রতিটি প্রজন্মের কর্তব্য।