আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বাংলাদেশের প্রত্যাশা অনুযায়ী ঋণ দিচ্ছে বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।
বুধবার (৯ নভেম্বর) সচিবালয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে আইএমএফের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠক শেষে অর্থ মন্ত্রণালয়ে আয়োজিত ব্রিফিংয়ে তিনি এ কথা বলেন।
তিনি বলেন, ‘ফেব্রুয়ারিতে আইএমএফ প্রথম কিস্তি বাবদ ৩৫২ দশমিক ৩৫ মিলিয়ন এসডিআর ছাড় করবে।’
অর্থমন্ত্রী বলেন, ঋণের পরিমাণ সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলার। সাত কিস্তিতে ২০২৬ পর্যন্ত এ ঋণ আসবে। প্রথম কিস্তি আসবে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে। বাকি ঋণ প্রতি ছয় মাস অন্তর অন্তর ৬৬০ মিলিয়ন এসডিআর (স্পেশাল ড্রয়িং রাইটস) হিসেবে ৬টি সমান কিস্তিতে ২০২৬ সালের মধ্যে পাওয়া যাবে।
আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, আইএমএফ মিশন জানিয়েছে তাদের কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী আগামী তিন মাসের মধ্যে ঋণপ্রস্তাবের সব আনুষ্ঠানিকতা ও চূড়ান্ত বোর্ড অনুমোদন শেষ হবে। ঋণটি ২০২৬ সাল পর্যন্ত চার বছর মেয়াদি।
তিনি বলেন, মোট ঋণের পরিমাণ হবে ৩ দশমিক ৪৬৮ বিলিয়ন এসডিআর। যা বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী প্রায় সাড়ে ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
মন্ত্রী বলেন, আগামী ফেব্রুয়ারি নাগাদ আইএমএফ প্রথম কিস্তি ৩৫২ দশমিক ৩৫ মিলিয়ন এসডিআর অর্থ ছাড় করতে পারবে বলে আশা করছি। বাকী ঋণ প্রতি ছয় মাস অন্তর ৫১৯ মিলিয়ন এসডিআর হিসেবে ছয়টি সমান কিস্তিতে ২০২৬ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে পাওয়া যাবে।
অর্থমন্ত্রী বলেন, সারা বিশ্বের অর্থনীতিই এখন একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। উন্নত থেকে উন্নয়নশীল সব দেশে অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে। প্রায় সব দেশের মুদ্রার মান ডলারের বিপরীতে কমে গেছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমেছে। বৈশ্বিক অর্থনীতির এ উত্তাপের আঁচ আমাদের অর্থনীতিতেও কিছুটা লেগেছে। এ অস্থিরতা যাতে কোনো ধরনের সংকটে ঘনীভূত না হয় তা নিশ্চিত করতেই আমরা আগাম সতর্কতা হিসেবে আইএমএফের ঋণের জন্য অনুরোধ করেছিলাম। তাদের সঙ্গে এর আগে একাধিকবার বৈঠক হয়েছে। চলমান ঋণ আলোচনার পর্বটি আজ আমরা সফলভাবে সমাপ্ত করলাম।
‘আমরা যেভাবে ঋণ চেয়েছিলাম, ঠিক সেভাবেই ঋণ পেতে যাচ্ছি বলে আমি আশা করছি। আইএমএফের সফররত দলটি বাংলাদেশ সরকারের সব স্টেক হোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা করেছে। আমাদের সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা অন্যান্য অনেক দেশের তুলনায় ভালো বলে তারা আমাদের জানিয়েছেন। আইএমএফ টিম আমাদের চলমান অর্থনৈতিক সংস্কারের সঙ্গে একমত পোষণ করেছে। সে অনুযায়ী আমরা চার বছর মেয়াদি ঋণ কর্মসূচি নিতে যাচ্ছি।’
এই ঋণ কর্মসূচির লক্ষ্য প্রসঙ্গে তিনি বলেন, অর্থনীতির বহিঃখাতকে স্থিতিশীল করা, ২০২৬ সালে এলডিসি থেকে উত্তরণকে সামনে রেখে অর্থনীতিকে শক্ত ভিত্তি দেওয়া, আর্থিক খাতকে শক্তিশালী করা, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবিলা করে উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জন এবং সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়া।
মন্ত্রী আরও বলেন, সরকারের বাজেট ঘাটতি ধারণযোগ্য পর্যায়ে রাখা হবে, যা গত ১৪ বছর ধরে আমরা করে আসছি। আমাদের সরকারের সবসময় প্রচেষ্টা থাকে বাজেট ঘাটতিকে জিডিপির ৫ শতাংশের মধ্যে সীমিত রাখা। গত বছর আমাদের বাজেট ঘাটতি ছিল ৫.১ শতাংশ, যা এই অর্থবছরে ৫.৫ শতাংশ ধরা আছে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক নিরাপত্তার মতো সামাজিক খাতে সরকারের ব্যয় বৃদ্ধি করা, যা আমরা প্রতি অর্থবছরে ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি করছি।
তিনি বলেন, সামাজিক নিরাপত্তা খাতে চলতি অর্থবছরে আমাদের বরাদ্দ রয়েছে ১ লাখ ১৩ হাজার ৫৭৬ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের প্রায় ১৭ শতাংশ। আর্থিক খাতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নতুন কয়েকটি আইন প্রণয়ন এবং পুরোনো কয়েকটি আইনের সংশোধনের চলমান কার্যক্রম ত্বরান্বিত করা, রাজস্ব ব্যবস্থার সংস্কার জোরদার এবং কর প্রশাসনের দক্ষতা বাড়ানোর মাধ্যমে সরকারের রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি করা হবে। ভ্যাট আদায়ের জন্য আমরা ইএফডি মেশিন স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছি। এ যাবত ৬ হাজার ৭৩২টি মেশিন স্থাপন করা হয়েছে। আগামী বছরে আরও ৬০ হাজার মেশিন স্থাপন করা হবে এবং পরবর্তী ৪ বছরে ২ লাখ ৪০ হাজার মেশিন স্থাপিত হবে।
তিনি আরও বলেন, জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয়ের ব্যবস্থাটি আন্তর্জাতিক বাজারের মূল্যের সঙ্গে সময়ে সময়ে সমন্বয় করা, যাতে সামনে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের মূল্য কমলে দেশের ভেতরেও তা একইভাবে কমানো যায়। টাকার বিনিময় হার নির্ধারণের কাজটি ধীরে ধীরে বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া, যা আমরা ইতোমধ্যে শুরু করেছি। সরকারের উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকির বিষয়কে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা এবং সেদিকে লক্ষ্য রেখে উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা। একটি দুর্যোগ ঝুঁকি অর্থায়নের পরিকল্পনা করা, যার মধ্যে দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তার বিষয়টিও থাকবে ইত্যাদি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, আইএমএফ যে ঋণ দিচ্ছে তা কিস্তির ওপর ভিত্তি করে সাড়ে তিন বছর থেকে ১০ বছর গ্রেস পিরিয়ডে পরিশোধ করতে হবে। সুদের নির্ধারণ হার ফ্লোটিং রেটে অর্থাৎ আন্তর্জাতিক বাজার অনুযায়ী নির্ধারণ করা হবে। তবে এটা গড়ে ২ শতাংশের ওপর যাবে না।
তিনি বলেন, আইএমএফ ঋণের বিপরীতে কোনও শর্ত দেয়নি। আমাদের আর্থিক খাতে চলমান বিভিন্ন সংস্কার সম্পর্কে জানতে চেয়েছে। আমরা তাদের সব বিষয়ে খোলামেলা জানিয়েছি। তারা যা চায় সরকারও সেভাবেই কাজ করছে। খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনা, রাজস্ব আদায় বাড়ানো, ভর্তুকি কমিয়ে আনা। এসবি বিষয়ে তারা জানতে চেয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এসব বিষয়ে নানা কার্যক্রম চলছে। তবে কৃষিখাতে বিশেষ করে সারের ওপর যে ভর্তুকি দেওয়া হয়, সেটা এখন তুলে নেওয়া সম্ভব নয় বলে তাদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রতিনিধিদল সব বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছে। আশা করছি, আগামী ডিসেম্বরে ঋণের প্রথম কিস্তি পাওয়া যাবে।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ফাতিমা ইয়াসমিন।