আকলিমা চমন
মাতৃত্বের সঙ্গে অবধারিতভাবে যা আসে, সেটা হলো মায়ের শরীরে হরমোনের পরিবর্তন। আর তার কারণেই মায়েরা প্রসবোত্তর বিষণ্নতায় ভোগেন, ইংরেজিতে যাকে বলা হয় পোস্ট-পার্টাম ডিপ্রেশন বা বেবি ব্লুজ!
কতজন আমরা এর খোঁজ রাখি বা জানার পরও ব্যাপারটাকে পাত্তা দেই? বেবি ব্লুজ বা পোস্ট-পার্টাম বিষয়টির ব্যাখ্যা ডাক্তাররা ভালো বলতে পারবেন। আমি ডাক্তার নই, নিজ এবং বন্ধুদের অভিজ্ঞতা ও অল্প-বিস্তর পড়াশোনার ভিত্তিতে বলতে পারি, এই জিনিস এতো ভয়ংকর মোড় নিতে পারে যে মা আত্মহত্যা করতে পারেন, এমনকি নিজ সন্তানকে হত্যা পর্যন্ত করতে পারেন।
তিনটা ভাগে সাধারণভাবে এটাকে একটু বিশদ করিঃ
প্রথমত, সন্তান প্রসবের পরপরই মায়ের যেটা হতে পারে সেটা হলো বেবি-ব্লুজ। সাধারণত এর লক্ষণ হতে পারে এমন-
- ম্যুড স্যুইং
- দুঃশ্চিন্তা ( আমি ভালো মা নই!)
- নিদ্রাহীনতা বা ইনসমনিয়া
- কান্না
- অবসাদ
- ক্ষুধামন্দা
- সবকিছুতে বিরক্তি, ইত্যাদি।
এই লক্ষণগুলো যেমন বাচ্চা জন্মের পর পরই একজন নতুন মায়ের মধ্যে দেখা দিতে পারে, তেমনি এই লক্ষণগুলো আবার এক-দুই সপ্তাহের মধ্যে চলেও যায়। কিন্তু অনেক মা আছেন, যারা দীর্ঘদিন ধরেই ভোগেন। সেক্ষেত্রে এটাকে বলা হয় পোস্ট-পার্টাম ডিপ্রেশন।
পোস্ট-পার্টাম ডিপ্রেশন আর বেবি-ব্লুজের লক্ষণগুলো এক হলেও পোস্ট-পার্টাম ডিপ্রেশনের ক্ষেত্রে এই লক্ষণগুলোর স্থায়িত্ব আর তীব্রতা অনেক বেশি। যেমন-
- মাত্রাতিরিক্ত অবসাদ, দুশ্চিন্তা
- নিজেকে খুব খারাপ মা মনে করা
- অসহায় বোধ করা
- নিদ্রাহীনতা বা ইনসমনিয়া
- অতিরিক্ত কান্নাকাটি
- মাত্রাতিরিক্ত রাগ
- বাচ্চার সঙ্গে বন্ধন বা বন্ডিং না হওয়া
- পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গেও দুর্ব্যবহার করা
- মাত্রাতিরিক্ত বিরক্তি প্রকাশ
- ম্যুড সুইং
- যৌক্তিক চিন্তা করার বা ভাববার ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যাওয়া
- প্যানিক এটাক
- নিজেকে অনেক ক্ষেত্রে সবার থেকে গুটিয়ে ফেলা
- বাচ্চাকে মারধোর করা
- আত্মহত্যার প্রবণতা ইত্যাদি।
সব মায়েরই যে সবগুলো লক্ষণ এক সঙ্গে দেখা দেবে তা কিন্তু নয়। ব্যক্তি, পরিবার, পারিপার্শ্বিকতা ভেদে লক্ষণগুলোও ভিন্ন হতে পারে। পোস্ট-পার্টাম ডিপ্রেশন মাস বা বছর মেয়াদিও স্থায়ী হতে পারে।
এর পর যেটা আসতে পারে, তা হলো পোস্ট-পার্টাম সাইকোসিস। এই স্টেজটা আরো ভয়াবহ! যদিও বাচ্চা জন্মের পর পরই পোস্ট-পার্টাম সাইকোসিসের লক্ষণ প্রকাশ পাওয়াটা খুব বিরল, তথাপি অসম্ভব কিছু নয়। কোন কোন মায়ের হতে পারে এটা। বলা হয়ে থাকে যে প্রতি ১০০০ জনে ১ বা ২ জনের এই পোস্ট-পার্টাম সাইকোসিস এর লক্ষণ দেখা যায়। এটা বাইপোলার এপিসোডের মতোই অনেকটা। এর লক্ষণগুলো হতে পারে।
- হ্যালুসিনেশন। মায়েরা এমন কিছু দেখে বা শোনে, যা সত্য নয়
-ডিলিউশন, বা অবাস্তব চিন্তা। যেমন, মায়েরা ভাবে অন্যকেউ তার বাচ্চার ক্ষতি করবে।
-স্থান-কাল-পাত্রের হিসেব ঠিক না থাকা - হঠাৎ করেই খুব বিষাদগ্রস্ত হয়ে যাওয়া আবার হঠাৎ করেই খুব হাসিখুশি হয়ে যাওয়া
- সহিংস বা ভায়োলেন্ট হয়ে যাওয়া
-নিজেকে বা বাচ্চাকে মেরে ফেলার চিন্তা করা, ইত্যাদি।
সন্তান জন্মের পর পর কমবেশি সব মায়েরাই বেবি-ব্লুজ বা পোস্ট-পার্টাম ডিপ্রেশনের ভেতর দিয়ে যান। যারা কমের ওপর দিয়ে এই সময়টা পার করে ফেলেন, তারা ভাগ্যবান! যাদের ডিপ্রেশন বেশি হয়, তারা জানেন কী যে উথাল-পাথাল সেই ইমোশনাল স্টেজ! কী যে মানসিক কষ্ট!
হলফ করে বলতে পারি, বাংলাদেশের মায়েরা এই কষ্ট হজম করে ফেলেন! এই হজম করার প্রক্রিয়ায় হয়ত সারা জীবনের জন্য স্বামী বা শাশুড়ি বা ননদ বা ভাই-বোন, কারো না কারো সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হয়।
মাতৃত্বকে মহিমান্বিত করতে গিয়ে আমরা জেনে বা না জেনে একজন মায়ের মানসিক স্বাস্থ্যকে এড়িয়ে যাই। মা তার সন্তানকে ভালোবাসবে, এটা খুব স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। প্রকৃতিগতভাবে প্রাপ্ত একটা ক্ষমতা। তেমনি মায়ের শারিরীক, মানসিক পরিবর্তনও কিন্তু খুব স্বাভাবিক।
তাই একজন নতুন মা সকাল বেলায় কতক্ষন ঘুমিয়ে থাকলো, বা বাচ্চার প্রতি অবহেলা, বা অতিরিক্ত প্রোটেকটিভ হবার বা আদিখ্যেতা করাকে বিষ-নজরে না দেখে তাকে সাহায্য করুন। বাচ্চাটা ছেলে বাচ্চা না মেয়ে বাচ্চা, ফর্সা না কালো এইসব ফালতু বিষয়ে মায়ের সামনে রসিকতা করবেন না। কোন কারণ ছাড়াই নতুন মা যখন কাঁদেন, তখন তাকে সাহস যোগান। মাকে ঘরবন্দি না রেখে একটু বাইরে ঘুরতে নিয়ে যান। নতুন মা’টা খুব বেশি ঝামেলা করছেন? সারাক্ষণ খ্যাচ-খ্যাচ করেন? মন খারাপ করে থাকেন? বাচ্চাকে মারেন? দয়া করে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান, কাউন্সেলিং করান। বিষয়টাকে আরো জানতে চেষ্টা করুন। ইন্টারনেটে অনেক তথ্য আছে, দয়া করে পড়ুন।
আরেকটু বলি, বাবাদেরও কিন্তু বাচ্চা জন্মের পর ডিপ্রেশন হতে পারে। সে ক্ষেত্রে এটাকে “প্যাটারন্যাল পোস্ট-পার্টাম” বলা হয়। বিশেষ করে অল্প বয়সি বাবা, অথবা যাদের আগেও ডিপ্রেশন ছিলো, যাদের অর্থনৈতিক টানাপোড়েন আছে, বা যেই দাম্পত্যে আগে থেকেই সমস্যা চলছে এসব ক্ষেত্রে নতুন বাবাদের মাঝেও ডিপ্রেশন দেখা দিতে পারে। ডাক্তার দেখানোটা এক্ষেত্রেও জরুরি।
সবশেষে, “মা” হওয়াটা শুধু একজন মায়ের দায়িত্ব না, তাকে “মা” হতে সাহায্য করা পুরো পরিবারের দায়িত্ব!