-হমিাদ্রী রয় সঞ্জীব, টরন্টো।
তাঁর হাসিতে শব্দেরা হাসে, তিনি শব্দের সাথে শব্দের সংযোগে তৈরি করেন কবিতার শরীর। তাঁর কবিতায় ভাবের সাথে ভাষার মিলন, নিজের অন্তরের সাথে বাহিরের মানুষের, নিজের বোধের সাথে বিশ্ব মানবতার বিনিসুতার রাখিঁ বন্ধন করেন। তাঁর সৃষ্টিতে দেশ-কাল-পাত্র-সমাজকে চিরকালের করে তোলেন, তাঁর হিরন্ময় কন্ঠে রসভাষ্য শ্রোতাদের অন্তরে সরস অনুভূতি উদ্রেক করে,তিনি প্রিয় কবি আসাদ চৌধুরী।
বরিশালের কীর্তনখোলার তীরের বাতাস গায়ে মেখে বড় হয়েছেন। সবুজ শ্যামলীমার আর গ্রাম গুলির মতই উলানিয়া। মেঠোপথ, স্কুলঘর, মসজিদ এবং মন্দির আর ছিলো বাড়ইদের পানের বরজ। পানের মধ্যে তিনি বোনেদিয়ানা খুঁজে ফেরেন। পান দেবতার পায়ে, সাত পাঁকের পর শুভ দৃষ্টিতে, চুন-সুপারি-খয়ের মিলিয়ে নানীর হাতে, পানের খিলির নান্দনিক সৃষ্টিতে। গ্রামীণ কৃষ্টির শুভমঙ্গল চিহ্ন নিয়ে পাঠকের দরবারে হাজির হন কবি আসাদ চৌধুরী এই পান নিয়েই।
“তবক দেওয়া পান” “বিত্ত নাই বেসাত নাই”, ‘দুঃখিরা গল্প করে, ‘মধ্য মাঠ থেকে, ‘প্রশ্ন নেই উত্তরের পাহাড়’ কাব্যগ্রন্থ গুলির মধ্য দিয়ে তাঁর কবিতার পথে যাত্রা, দশকের পর দশক আমাদের এগিয়ে নিয়ে চলেছেন প্রতিদিন। ষাটের দশকের কবিতার পালা বদল হয় ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে। তখন কবিদের অন্তরলোক হয়ে উঠে প্রতিবাদ মুখর। তাদের বোধের প্রতিবাদ মুক্তি পায় কবিতার ভাষায়।
শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, আব্দুল মান্নান সৈয়দ, আল মাহমুদ, নির্মলেন্দু গুন, আবুল হাসান, আব্দুল্লা আবু সায়ীদ, আহমদ ছফা, রফিক আজাদ,নুরুল হুদা, অরুনাভ সরকার, অসিম সাহা, শহীদ কাদেরী, হুমায়ুন আজাদ, কাজী রোজী, সিকদার আমিনুল, মাকিদ হায়দার, সমুদ্র গুপ্ত, হাবীবুল্লাহ সিরাজী উল্লেখযোগ্য। মনন, লোকজ শব্দের প্রয়োগ, উপমা এবং সৃষ্টির দ্যুতিময়তায় ষাটের দশকের উল্লেখিত কবিদের মধ্যে একজন, যিনি অর্জুনের স্থান দখল করে আছেন। তিনি আসাদ চৌধুরী।
বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় তাঁর নিরহংকার বিচরণ, তাঁর কবিতায় শ্রীকৃষ্ণ পদাবলীর ফাল্গুনকে এঁকেছেন প্রতিবাদের ভাষায়, কবিতার মাঠে অংকুরিত হয়েছে যেমন গোলাপ, কোকিল, নদী, জীবন ও স্বপ্নের বুনন তেমনি প্রকাশ করেছেন হৃদয়ের ক্ষরণ, মানুষকে করতে চেয়েছেন সত্যের অন্বেষী।
যার কবিতায় লোকজ ও গ্রামীণ জনপদ কে খুব আপন করে পাওয়া যায়। পাওয়া যায় মাটির সুধা-গন্ধ, পাতানো সৈ, মা-খালা থেকে কাজের মাসিদের মুখের বুলি-আদরের গালি।
“পেঁয়াজ আমার ননদী পেঁয়াজ বাটি যদি, নয়ন জলে আ-লো বুইন উথালপাথাল নদী।
মরিচ আমার শাউড়ি মরিচ বাটতাম না।( আ-গো) বাতাস বইলে বাউরী কানতে পারতাম না।
নকশী করা কেঁথা বানাই রঙ্গীল সুতা দিয়া,
ঘরের মানুষ বাহির হৈল রুমাল উড়াল দিয়া”।
আবার কখনো তিনি বেদনায় আলোড়িত হয়েছেন বিরাংগনার উদাস করা দৃষ্টিতে।
শুনিয়েছেন বেগবতী তটিনীর মত স্নিগ্ধ মনোরম নারীর কথা।
‘এ-সব রহস্যময়ী রমণীরা পুরুষের কন্ঠস্বর শুনে বৃক্ষের আড়ালে স’রে যায়-
বেড়ার ফোঁকড় দিয়ে নিজের রন্ধনে তৃপ্ত অতিথির প্রসন্ন ভোজন দেখে শুধু মুখ টিপে হাসে।
প্রথম পোয়াতী লজ্জায় অনন্ত হ’য়ে কোঁচরে ভরেন অনূজের সংগৃহীত কাঁচা আম,পেয়ারা,চালিতা-
সূর্য্যকেও পর্দা করে এ-সব রমণী।
অথচ যোহরা ছিলো নির্মম শিকার, অকৃতজ্ঞ লম্পটেরা সংগীনের সুতীব্র চুম্বন গেঁথে গেছে-
আমি তার সুরকার- তার রক্তে স্বরলিপি লিখি’।
মুক্তিযোদ্ধের নয় মাস কাটিয়েছেন বিনীদ্র রজনী তাকে স্মৃতি কাতর করে তোলে, চোখের দেখা সেই সময়কার নদীতে ভেসে যাওয়া শতশত লাস। মাছে চোখ খেয়া নেওয়া সেই লাসের চোখে সূর্য্যের কিরণ পরে ঝল্কে উঠতো। জ্বলে উঠে তাঁর হৃদয়, ফুঁসে উঠেন কবি, গর্জে উঠে কলম “নদীর জলে আগুন ছিল,আগুন ছিলো বৃষ্টিতে”।
শুধু লাঠি হাতে নিয়ে যেমন ব্রিটিশ খেদানোর স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন বাপু সমগ্র ভারতবাসীকে। ৭১ এ কবি প্রত্যক্ষ করলেন শুধু মাত্র এক তর্জনী উঁচিয়ে বজ্রকন্ঠ আগুন জ্বালিয়েছিলো বাংগালীর স্বপ্নে। কবির কলম মুক্ত হয়ে বেড়িয়ে এলো প্রতিবাদ “আগুন ছিলো মুক্তিসেনার স্বপ্নঢলের বন্যায় প্রতিবাদের প্রবল ঝরে কাঁপছিলো সব অন্যায়”।
এই দেশ, এই মাটি, এই ভাষা কে নিয়ে কবির যত অহংকার। এই ভাষাতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, এই ভাষাতেই লিখে নোবেল পেয়েছেন একজন কবি, এই ভাষা এই সংস্কৃতির জন্যে রক্তাক্ত হয়েছিল একটি অধ্যায়; একটি পতাকার জন্যে প্রাণ দিয়েছিল ৩০ লক্ষ মানুষ। আমাদের অতীত গৌরবের সকল কর্মকান্ড বাংগালীকে মানুষের স্তরে পৌছিয়েছিল, আমরা এগিয়ে গেছি অনেকদূর যাচ্ছিও শুধু মুনষত্ব স্টপ সাইনের মত ঠায় দাঁড়িয়ে যা কবিকে আহত করে। আমরা দেশটাকে ভালো রাখবো এই ভরসায় নাটাই-ঘুড়ি ফেলে রেখে মুক্তিযোদ্ধাদের বুলেটের বাক্স তুলে নিয়েছিল মাথায় যে কিশোর,চোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে বুকে মাইন বেঁধে ঝাপিয়ে পড়েছিল প্রদিপ্ত যুবক,মাথায় গামছা বেঁধে রাইফেল হাতে তোলে নিয়েছিল কীর্তনখোলার মাঝি,খবরি হয়ে হানাদারদের আস্তানার খবর পৌছেদিতেন কিশোরী মুক্তিযোদ্ধা ডালিয়া আহমেদ ;যিনি আজকের বরেণ্য আবৃত্তিকার। সেই রক্তাক্ত ইতিহাসকে যখন আমরা দিবস বনিয়ে শুধু ছুটির দিন উপভোগ করি,প্রচন্ড আক্ষেপ থেকে কবি বলে উঠেন “এখন এসব স্বপ্নকথা দুরের শুনা গল্প”।তখন সত্যি এরা মানুষ ছিলেন আর এখন আমরা????
জাতীর জনক বংগবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে আমাদের জন্মের চিহ্ণকে মুছে দেওয়ার প্রয়াস, রাজনীতির নামে ধর্ম শিকারিদের প্রথম শিকার হলো সংবিধান, তারপর একে একে সমাজ,পোষাকে-আষাকে সাম্প্রদায়িকতার আবরণে ঢেকে ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তের জানাজা পড়ানো হয়। লাজ-শরম-কৃতজ্ঞতাবোধ নির্বাসিত হলো পরিবার থেকে সমাজ থেকে।মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ হারিয়ে একশ্রেণির মানুষ আজ উদ্বাস্তু। ধর্ম শিকারিদের সর্বশেষ শিকার পাঠ্যপুস্তক সাম্প্রদায়িকি করন।
৫২ থেকে ৭১ ইতিহাসের প্রতিটি বাঁকে -বাঁকে মুক্তি পাগল কবিরা যে কথা বলতে চেয়েছিলেন তাদের কবিতায়, প্রাণে যে সুর জাগিয়ে ছিলেন শিল্পী, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন বধ্যভূমিতে ক্ষতবিক্ষত পড়ে থাকা শিক্ষক ,ডালের বড়ি শুকিয়ে রাখা মায়ের কাছে ফিরে আসা হয়নি যে খোকার, রক্তমাখা বুকের বিনিময়ে সবুজ জমিটি এনেদিয়েছিল যে লক্ষপ্রাণ, তারা যা বলতে চেয়েছিলেন বলছে না আজ বাংলাদেশ; এই সময়ে এসেও আমাদের মনে করিয়েদেন কবি আসাদ চৌধুরী।
বেশি দিন আগের কথা নয়,টরন্টো বইমেলায় এনায়েত করিম বাবুল পরিচয় করিয়ে দিলেন কবির সাথে। ক্ষণকালের সাক্ষাত চিরকালের হয়ে আসে তাঁর কথায়, আপন করে নেওয়ায়। কোন অভিযোগ নেই, মনে কোন ক্ষেধ নেই, সব ছেড়ে সব ভূলে শুধু আনন্দ খোঁজে তাঁর মন। শেক্সপিয়ার সিটিতে বেড়াতে যাওয়ার পথে আমি, বিদ্যুৎ’দা ও কবি দেলওয়ার এলাহী মুগ্ধ হয়ে শুনেছি আসাদ চৌধুরীর মুখ থেকে তাঁর স্মরণ কালের স্মৃতি চারণ। ষাটের দশকে কবি পরিচিতী পাওয়া আসাদ চৌধুরীর প্রথম কাব্য পাঠকের কাছে আসে ৭০ এর দশকে। অপেক্ষার এতগুলো বছর কবি বন্ধুদের বই বের করেছেন তিনি। আব্দুল মান্নান সৈয়দের জন্মান্ধ কবিতা গুচ্ছ অন্যতম।
ফুল নিজে ফুটে সফল হয় আনন্দ পায় তবে ফুল ফোটানোতে ও আনন্দ থাকে, তা আমরা খুঁজেই দেখিনা। তালের বাহিরের আবরনের মত জীবন বড় কঠিন, কিন্তু তার ভিতর যে নরম সাঁশ থাকে তার স্বাদ নেওয়ার চেষ্টা করিনা।
মানুষ আসাদ চৌধুরীর সাহচার্য জীবনের রস আস্বাদনের তৃপ্ত অনুভূতি, মনকে লোভি করে তোলে, আনন্দ পাওয়ার লোভ। বিনয় আর ভদ্রতা ফেরিকরে পথ চলছেন পৃথিবীর বুকে, গিলে করা পাঞ্জাবি, কাঁচাপাকা চুল, অপরাজেয় গোঁফ, মুখে লাজুক রোদ্দুরের মত স্মিত হাসির আসাদ চৌধুরী। আপন হৃদয় গহনে শুধু এতটুকু আশা, যেন পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ মর্যাদার জীবন পায়। যেখানে ধর্মের কারনে, জাত-পাতের কারনে, শ্রেণী বৈশম্যের কারনে কোন মানুষের মর্যাদাহানি হবেনা।
তাকে চোখের দেখায়, কানে শুনায়, পড়ায়, জানায়, উজ্জ্বল রঙ হৃতকমলে, আমার মাথা নত হয়ে আসে, মানবিক, বিনয়ি আবার প্রতিবাদী কিন্তু প্রেমময় রসে টইটুম্বুর কবি আসাদ চৌধুরীর চরণকমলে।