জসিম মল্লিক
বাইরে ঝড় বৃষ্টি হচ্ছে প্রবল প্রতাপে। আবহাওয়ার খবর কিছু জানা হয় নাই। ঘরে কোনো রেডিও ট্রানজিষ্টর নাই। বাতাসের দাপটে ডালপালা ভেঙ্গে পড়ছে মড় মড় করে। একটানা শো শো শব্দ শোনা যাচ্ছে। হারিকেনটা নিভু নিভু করছে। একটা ভৌতিক পরিবেশ ঘরটার মধ্যে। হারিকেনের রহস্যময় আলোটা লাফালাফি করছে। বিকট শব্দে আগুনের ফুলকি ছুটছে আকাশ লাল করে। একটি কাঠের বিছানায় শুয়ে আছেন রহমত আলী। তিনি কয়েকদিন ধরে অসুস্থ্য। ডাক্তার দেখােেনা হয়েছে, ওষুধ পত্রও চলছে কিন্তু অবস্থার উন্নতির লক্ষন নাই। বরং ক্রমেই খারাপের দিকে যাচ্ছে। তার সজ্জাপাশে বিমর্ষ মুখে বসে আছেন রহমত আলীর স্ত্রী ফাতেমা বেগম। দুপুরেও একজন ডাক্তার দেখে গেছেন রহমত আলীকে। কিছু পথ্য দিয়েছেন নতুন করে।
রহমত আলীর বয়স এখন ষাট বছর। ছোট সন্তানের বয়স মাত্র চার বছর বছর। অনেক দেরি করে তার এই সন্তানটি হয়েছে। তিন ছেলে দুই মেয়ে। আগের দুই স্ত্রী মারা যান। তাদের ঘরে কোনো সন্তানাদি হয়নি। তাই একটু বেশি বয়সে ফাতেমা বেগমকে বিয়ে করেন। রহমত আলী তার সব সন্তানদের জায়গা সম্পত্তি ভাগ করে দিয়েছেন আগেই। সম্ভবতঃ তিনি বুঝতে পেরেছেন তার দিন শেষ হয়ে আসছে। তিনি খুব দুরদর্শী মানুষ। সবার শ্রদ্ধেয় মানুষ। এলাকার সবাই খুব শ্রদ্ধা করে। তিনি ফাতেমা বেগমকে কাছে ডাকলেন। বললেন. ছেলেটাকে রেখে গেলাম। দেখে রেখো।
ফাতেমা বেগম কাঁদো কাঁদো হয়ে বললেন, এসব আপনি কি বলছেন!
ঠিকই বলছি বউ। আমার সময় বেশি বাকি নাই।
এসব বলবেন না। আপনি না থাকলে আমার কি হবে! এতোগুলো ছোট ছোট সন্তান নিয়ে আমি কি করব!
আল্লাহ দেখবে। তোমার ছোট ছেলে আর মেয়েটার জন্য আমি চিন্তা করি। তোমার আর তিন সন্তানতো একটু বড় হয়েছে।
বড় হলেই বা কি। কত আর বড় হয়েছে।
চিন্তা কইরো না। আল্লাহর উপর ভরসা রাখো।
আপনার কিছু হবে না। আপনি ভাল হয়ে যাবেন।
তাই যেনো হয়। কিন্তু মন বলছে সময় শেষ।
ফাতেমা বেগম মুখে আঁচল চাপা দিয়ে কাঁদতে বসে যায়।
কাঁদবা না। নিজেকে শক্ত রাখ। তুমি ভেঙ্গে পরলে চলবে না। তোমাকে অনেক দ্বায়িত্ব নিতে হবে।
আমি কি এতো কিছু পারব!
পারবা। তোমাকে সব শিখিয়েছি আমি। ভেঙ্গে পরার কিছু নাই বউ।
২. ফাতেমা বেগম লক্ষ্য করলেন তার স্বামীকে খুউব সুন্দর লাগছে। উজ্জল হয়ে আছে চেহারা। যেনো আলোকরশ্মি বিচ্ছুরিত হচ্ছে। তিন বুঝতে পারলেন তার দিন ফুরিয়ে আসছে। ফাতেমা বেগম বিমর্ষ মুখে বসে থাকেন। বাইরের ঝড় জলোচ্ছাস তাকে স্পর্শ করছে না। ফাতেমা বেগম কি এক অজানা ভয়ে নীল হয়ে আছেন। রহমত আলী বুঝতে পারেন সব। তিনি তার স্ত্রীকে অথৈ সাগরে ফেলে যাচ্ছেন নাতো।
সে চলে গেলে এতোগুলো ছেলে মেয়ে নিয়ে সে কিভাবে চলবে! ছোট দ্ইু ছেলে মেয়ে নিয়েই বেশি চিন্তা তার। মেয়েটা ছেলেটার চেয়ে ছয় বছরের বড়। সে অনেক কিছুই বুঝে। কিন্তু দুই বছরের অবোধ এক শিশুকে রেখে সে বিদায় নিতে যাচ্ছে। তিনি আবার তার প্রিয়তমা স্ত্রীকে বললেন, সন্তানদের জন্য যে সম্পতি রেখে গেছি তাতে ওদের কোনো অসুবিধা হবে না। তোমার জন্যও রেখে গেছি। ছেলেদের মুখাপেক্ষি হতে হবে না তোমাকে।
মেয়েদের জন্যতো কিছু দিয়ে গেলেন না। কাঁদো কাঁদোভাবে বললেন ফাতেমা।
ওদের ভাইরা দেখবে।
যদি না দেখে!
দেখবে। আমার সন্তনারা ওরকম না। ছোটোটা দেখো অন্যদের মতো হবে না। ও সবার চেয়ে আলাদা হবে।
কেমনে জানেন।
আমি জানি। আমি দেখে যেতে পারলাম না কিন্তু আমার দোয়া সবসময় তার সাথে সাথে থাকবে। সব বিপদ আপদ থেকে আল্লাহ তাকে বাঁচাবে।
কেমন চঞ্চল দেখেছেন এখনই। কোথায় স্থির থাকতে পারে না।
শান্ত হয়ে যাবে। যারা ছোটবেলায় চঞ্চল হয় তারা বড় হলে শান্ত হয়। ওকে নিয়ে ভেবো না। তবে লেখাপড়া শিখাবে।
যদি না শিখতে চায়।
শিখবে। একটু অভিমানী তুমি খেয়াল করেছো!
আমি কি অত বুঝি!
খুব জেদি হবে। ওদের কারো মতো হবে না। উন্নতি করবে দেইখো তুমি।
আপনি শুধু দোয়া কইরেন।
আমি দোয়া করি। সবার জন্য দোয়া করি। তোমার জন্য দোয়া করি।
শেষ রাতের দিকে রহমত আলীর শ^াসের টান উঠল। বাইরে তখনও ঝড়বৃষ্টি। তার অন্য সব সন্তানরা চারপাশে বসে কান্নাকাটি করছে। অন্য ঘরে মৌলভী সাহেব কোরান পাঠ করছেন। আত্মীয় স্বজনরাও এসেছেন। ফজরের আজানের ঠিক আগে আগে চোখ বন্ধ করলেন রহমত আলী। শান্তির এক ঘুম দিলেন, যে ঘুম আর কখনো ভাঙ্গবে না। পাশেই ঘুমন্ত দুই বছরের শিশু কিছুই জানতে পারল না। সবার কান্নার আওয়াজে তার ঘুম ভাঙ্গলো না। সে একলা এক ঘরে ঘুমে কাতর তখন।
৩. পরদিন দুপুর নাগাদ রহমত আলীর দাফন সম্পন্ন হয়ে গেলো। পারিবারিক গোরস্থানে দাফন হলো। জানাজায় এলাাকার মানুষ ভেঙ্গে পড়ল। অনেকেই চোখের পানি ফেলেছে। লোকজন বলাবলি করছিল এমন মানুষ হয় না। এতো দরদী আর ভাল মানুষ আর দেখিনি। আহা মানুষটা চলে গেলো! এলাকার একজন মুরুব্বি চলে গেলো। সকালেই মাইক দিয়ে প্রচার করা হয়েছিল। যখন রহমত আলীকে খাটে করে কবরে শায়িত করতে নেয়া হয় তখনও একবার ফাতেমা বেগম জ্ঞান হারালেন। শেষ রাতে অনেকবারই জ্ঞান হারিয়েছেন। আর চার বছরের অবোধ শিশুটি ঘর ফাটিয়ে চিৎকার করে কাঁদছে। সে কিছুই বুঝল না। কিছুই জানল না। অনেক মানুষের ভীড় দেখে সে কাঁদতে লাগল।
অনেক আত্মীয় স্বজনে ঘর ভরে গিয়েছিল। ফাতেমা বেগমের ভাইরা বোনরা সবাই এসেছিল। তারা রহমত আলীকে খুব পছন্দ করতেন। ফাতেমা বেগমও ভাই বোনদের জন্য পাগল সবসময়। তারা বাড়িতে এলে একটা উৎসব উৎসব ভাব এসে যেতো। ফাতেমা বেগম ভাইদের কিভাবে আপ্যায়ন করবেন সেই নিয়ে ব্যতিব্যাস্ত হয়ে যেতেন। তিন দিনের মাথায় কুলখানি হলো। অনেক লোকজন আসলেন, মিলাদ হলো দোয়া করা হলো।
তারপর আস্তে আস্তে আত্মীয় স্বজনরা যে যার মেেতা চলে গেলেন। শুধু একজন মানুষ নিঃস্ব হয়ে গেলেন। স্বামী হারিয়ে অকুল সমুদ্রে পড়ে গেলেন। তিনি হলেন ফাতেমা বেগম। চার বছরের অবোধ শিশুটিকে কোলে নিয়ে তিনি নির্বাক হয়ে বসে থাকলেন আর চোখের পানি ফেলতে লাগলেন। কিন্তু কেউ সেই দৃশ্য দেখতে পেলো না।
চল্লিশ বছরে এক নারী স্বামীহারা হয়ে গেলেন। নারীর জীবনে স্বামী অতি মূল্যবান। সে সময়ে নারীরা স্বামী ছাড়া আর কিছু ভাবেতও পারত না। ফাতেমা বেগম সোজা সরল এক নারী। কখনো নিজের কোনো স্বাধীন মতামত গড়ে ওঠেনি। নিজস্বতা বলে যে কিছু থাকতে পারে জানত না। স্বামীই সব ছিল তার জীবনে। তিনি যা বলতেন তাই শুনতেন, তাই মাথা পেতে নিতেন। স্বামী যদি বলতেন সূর্য পশ্চিম দিক থেকে উঠছে তাই বিশ^াস করতেন।
রুটিন বাঁধা জীবন ছিল ফাতেমার। পাঁচটি সন্তান আর স্বামীর দেখা শুনাই ছিল তার একমাত্র কাজ। উদয়অস্ত পরিশ্রম করতেন। জমিজমা ছিল, ধান পান হয় প্রচুর। সেগুলোর তদারকি করা, হাঁস মুরগি পালা, গরু ছাগল আছে, সেগুলোতে দুধ দেয়, কামলাদের দেখভাল, তারা কি খেলো না খেলো। গরীব গুরবারাতো ছিলই। কাচরি ঘরে মৌলিভি আছে, তার থাকা খাওয়ার তদারকি। হেনো কিছু নাই করতে হতো না। সবই করতে হতো। রহমত আলীর সংসারে এসে অল্প বয়সে সব শিখে নিতে হয়েছে।
আকস্মিক সব ওলোট পালট হয়ে গেলো। ফাতেমা বেগম চোখে অন্ধকার দেখতে লাগলেন। তিনি নাই, কে এসব সামলাবে! কার বুদ্ধিতে এখন চলবে ফাতেমা। কিছুই জানে না সে। এতো কিছু ভাবতেও তার মাথা কাজ করে না। তাকে কখনো এতোকিছু ভাবতে হয়নি। সে জানে না এখন সে কি করবে কিভাবে সব ম্যানেজ করবে। তার ভাইরা আছে। তারা অনেক ভাল। বোনকে অনেক আদর করে। ফাতেমাও ভাইদের জন্য পাগল। রহমত আলী ফাতেমার ভাইদের খুব ভালবাসতেন। তারা রহমত আলীকে শ্রদ্ধার চোখে দেখেছন সবসময়। ফাতেমার বড় সন্তান একটু বুঝদার হয়েছে। বড় মেয়েটাও। সুতরাং তার অতো ভেঙ্গে পরার মতো কিছু হয়নি। সব একসময় ঠিক হয়ে যায়। সময় সব ঠিক করে দেয়।