এমনিতেই মানুষজন করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে বিপর্যস্ত। এর পাশাপাশি ফ্লু ও অন্যান্য ভাইরাসের সংক্রমণও ব্যাপক হারে ছড়াচ্ছে বলে বর্তমানে পরিস্থিতি আরো নাজুক। করোনাকালের আগে ফ্লু বা ঠাণ্ডাজ্বর তেমন দুশ্চিন্তার কারণ ছিল না, উপসর্গ দেখে সহজেই ফ্লু শনাক্ত করা যেত। কিন্তু কোভিড মহামারিতে এই চিত্র বদলে গেছে। এখন অনেকেই উপসর্গ নিয়ে বিভ্রান্তিতে পড়ছেন। এই বিভ্রান্তির কারণ হলো- কোভিড-১৯ ও ফ্লু/ঠান্ডাজ্বরের উপসর্গগত মিল। যার ফলে কোভিড-১৯ ও ফ্লুর পার্থক্য করা বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে। একারণে দুশ্চিন্তাও বেড়েছে।
করোনাকালে ফ্লুর সংক্রমণ বাড়ছে কেন?
কোভিড মহামারিতে মানুষজনের শারীরিক স্বাস্থ্য ও মানসিক সুস্থতা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। এরই মধ্যে গবেষকরা আরেকটি উদ্বেগজনক সংবাদ দিয়েছেন- বিশ্বব্যাপী ফ্লুর সংক্রমণ বাড়তে শুরু করেছে। ইতোমধ্যে অনেকেই ফ্লুতে মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হয়েছেন। গতবছর ফ্লুর সংক্রমণ পরিমিত ছিল। এর মূল কারণ হলো-লকডাউন। এছাড়া মাস্কের ব্যবহার, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা ও অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধির ব্যাপক প্রচলনও ছিল। কিন্তু বর্তমানে এসবে শিথিলতা চলে এসেছে, বিশেষ করে যারা করোনার টিকা নিয়েছেন তাদের অনেকেই নিজেদেরকে ঝুঁকিমুক্ত ভাবছেন। তাই মাস্কের ব্যবহার, নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান ও অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধিকে পাত্তা দিতে চাচ্ছেন না। বিশেষজ্ঞরা এটাকেও করোনাকালে ফ্লুর সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার কারণ বলছেন।
কোভিড বনাম ফ্লু: পার্থক্য কী?
ফ্লু ও কোভিড-১৯ উভয়েই শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ। এসব সংক্রমণ ঝুঁকির মাত্রায় ভিন্ন হতে পারে, তবে ছড়ানোর প্রক্রিয়া প্রায় একই। প্রধানত শ্বাসতন্ত্র থেকে নির্গত তরলকণার মাধ্যমে ছড়ায়, যা সাধারণত কাশি-হাঁচির সঙ্গে বের হয়। এছাড়া ভাইরাসযুক্ত কিছু ধরার পর মুখমণ্ডল স্পর্শ করলেও এসব সংক্রমণ ছড়াতে পারে।
কোভিড-১৯ ও ফ্লুর মধ্যে বড় পার্থক্য হলো তীব্রতার মাত্রা ও ছড়ানোর গতি। বিশেষজ্ঞদের মতে, কোভিড-১৯ ফ্লুর চেয়ে সহজে ছড়াতে পারে এবং করোনায় আক্রান্তদের ভয়ানক পরিণতি বা মৃত্যুর ঝুঁকিও ফ্লু রোগীদের তুলনায় বেশি। উভয় সংক্রমণের নিরাময় সময়েও পার্থক্য দেখা গেছে। সাধারণত ৫-৭ দিনে ফ্লুর উপসর্গ চলে যায়। অন্যদিকে মৃদু কোভিড-১৯ থেকে সুস্থ হতে ২ সপ্তাহ লাগতে পারে। তীব্র কোভিড-১৯ থেকে নিরাময় পেতে ৬ সপ্তাহ লাগতে পারে। করোনা রোগীর অবস্থা সংকটজনক হলে সময়ের দৈর্ঘ্য আরো বাড়তে পারে। উভয় সংক্রমণেই রোগীর বয়স ও স্বাস্থ্য বিবেচনায় নিরাময় সময় এর কমবেশি হতে পারে।
উভয় সংক্রমণের উপসর্গে যেমন অনেক মিল আছে, তেমনি কিছু পার্থক্যও আছে। কোভিড-১৯ এর দুটি প্রধান উপসর্গ হলো, শ্বাসকষ্ট ও ঘ্রাণশক্তি বিলোপ। স্বাদেও পরিবর্তন আসতে পারে। কিন্তু ফ্লু সংক্রমণে এসবের প্রচলন তেমন নেই। অন্যদিকে মাথাব্যথা ও বমি হলো ফ্লুর প্রচলিত উপসর্গ, যা করোনা সংক্রমণে উল্লখযোগ্য হারে পরিলক্ষিত হয়নি। সময় পরিক্রমায় কোভিড-১৯ এর উপসর্গে পরিবর্তন দেখা গেছে, বিশেষত ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের আবির্ভাবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, উপসর্গে আরো পরিবর্তন নিয়ে করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্টের আগমন ঘটতে পারে। অপরদিকে ফ্লু সংক্রমণের ক্ষেত্রে বছরের পর বছর একই ধরনের উপসর্গ দেখা গেছে।
- কোভিড ও ফ্লুর মধ্যে পার্থক্য করা কঠিন কেন?
কোভিড-১৯ ও ফ্লু উভয়েই একই ধরনের উপসর্গ সৃষ্টি করতে পারে। একারণে উপসর্গ দেখে কোভিড-১৯ নাকি ফ্লু হয়েছে তা বোঝা কঠিন হয়ে পড়েছে। উভয় সংক্রমণের সাদৃশ্যযুক্ত উপসর্গগুলো হলো- জ্বর, শীতশীত অনুভূতি, কাশি, শরীর ব্যথা, ক্লান্তি বা দুর্বলতা, সর্দি ও গলা ব্যথা। দুই বা ততোধিক সংক্রমণের বেশকিছু উপসর্গ একইরকম হলে ঠিক কী হয়েছে তা ধারণা করা কঠিনই বটে।প্রকৃতপক্ষে, উপসর্গের সাদৃশ্যতায় রোগীরা কিছুসময় বিভ্রান্তিতে অতিবাহিত করে ফেলে। এর ফলে অনেক ক্ষেত্রে উপযুক্ত সময়ে সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হয় না। উদাহরণস্বরূপ, যার কোভিড-১৯ হয়েছে তিনি নিজেকে ফ্লু রোগী ভেবে বেপরোয়া চলাফেরা করলে আরো অনেকেই করোনায় আক্রান্ত হবেন- এমনকি তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে উপযুক্ত চিকিৎসা থেকেও বঞ্চিত হতে পারেন।
- ব্রেকথ্রো ইনফেকশনও বিভ্রান্ত করছে
কোভিড-১৯ থেকে সুরক্ষা পেতে করোনার টিকা হলো গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। গবেষণায় দেখা গেছে, করোনার টিকা মূল কোভিড-১৯ ও এর ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে কার্যকর। সম্প্রতি গবেষকরা জানান, জটিল রোগীদের সুরক্ষায় মডার্নার টিকা বেশি কার্যকর হতে পারে। সিনোফার্মেও দীর্ঘমেয়াদি সুরক্ষার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে যে, যারা বিভিন্ন কোম্পানির করোনার টিকা সম্পূর্ণ নিয়েছেন তাদের অনেকেরই কোভিড-১৯ হয়েছে। কোনো সংক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য যে টিকা নেওয়া হয়, তা গ্রহণের পরও ওই সংক্রমণ হলে তাকে ব্রেকথ্রো ইনফেকশন বলে। করোনার ব্রেকথ্রো ইনফেকশনের সংখ্যা গুরুত্ব দেওয়ার মতোই। এসব সংক্রমণ আমাদেরকে এটা জানাচ্ছে যে, টিকা গ্রহণের পরও মাস্ক পরা-নিরাপদ দূরত্বে থাকা থেকে শুরু করে যাবতীয় স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। এখনো ইচ্ছেমত চলার সময় আসেনি।
করোনার ব্রেকথ্রো ইনফেকশনের জন্য বিশেষজ্ঞরা ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টকে প্রধান দায়ী করেছেন। এই সংক্রমণের উপসর্গও ফ্লু শনাক্তকরণে বিভ্রান্ত করছে। জো কোভিড সিমটম স্টাডি অ্যাপের উপাত্ত অনুসারে, করোনার টিকা সম্পূর্ণ গ্রহণের পরও যাদের কোভিড-১৯ হয়েছে তারা অন্যান্য উপসর্গের পাশাপাশি এসব উপসর্গেও ভুগেছেন-
মাথাব্যথা
সর্দি
হাঁচি
গলা ব্যথা
ঘ্রাণ হারানো
স্বাদে পরিবর্তন।
করোনার টিকা নিলে ফ্লু শট নেওয়া যাবে?
চলমান মহামারিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, করোনার টিকা নেওয়া। তাই এখুনি টিকার জন্য নিবন্ধন করে নিন। যারা ইতোমধ্যে করোনার টিকা নিয়েছেন তাদের এটা ভাবার কারণ নেই যে, ফ্লু থেকেও সুরক্ষিত। ফ্লু এড়াতে যথাসময়ে ফ্লু শট-ই নিতে হবে। এখন প্রশ্ন হলো, করোনার টিকা গ্রহণ করলে ফ্লু শট নেওয়া যাবে?
প্রথমদিকে বিশেষজ্ঞরা করোনার টিকা গ্রহীতাদেরকে অন্যান্য টিকা নিতে নিষেধ করেছেন। এমনকি ফ্লু শটেও অনুৎসাহিত করেছেন। কিন্তু অনেক গবেষণার পর তারা এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের রোগনিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্রের মতে, করোনার টিকা গ্রহণের পর ফ্লু শট নেওয়া সম্পূর্ণ নিরাপদ। উভয় টিকা গ্রহণের পরও মাস্ক পরা, নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান, সাবান পানিতে হাত ধোয়া ও অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা উত্তম।