মিলি সুলতানা
১৯৭৮ সালের ১৮ এপ্রিল ঢাকার মালিবাগে সালেহাকে নৃশংসভাবে খুন করেন তার চিকিৎসক স্বামী এহতেশামুদ্দিন ইকবাল। গৃহপরিচারিকা মনোয়ারার সঙ্গে অবৈধ গড়ে ওঠে ডা. ইকবালের। এই অনৈতিক সম্পর্কের পরিণতিতে ডা. ইকবাল খুন করেন তার স্ত্রী সালেহাকে। একদিন মধ্যরাতে সালেহা আপত্তিকর অবস্থায় দেখে ফেলেন ইকবাল এবং মনোয়ারাকে। তিনি চিৎকার করে কান্নাকাটি করতে থাকেন। সেই সাথে স্বামীর অনৈতিক কর্মকাণ্ডের তীব্র বিরোধিতা করেন। রগচটা ইকবাল ক্ষিপ্ত হয়ে দরোজার ডাঁসা দিয়ে সালেহার মাথায় আঘাত করেন। সালেহার মৃত্যু হয়। এখানেই যদি থেমে থাকতেন নরপিশাচ ইকবাল, তাহলে হয়ত নিষ্ঠুরতার নজীর সৃষ্টি হতোনা। মৃত স্ত্রীর গলায় পেটে হাতে ধারালো ব্লেড দিয়ে কচাকচ কাটতে থাকেন।
খুনের দায় থেকে ডা. ইকবাল নিজেকে রক্ষার চেষ্টা করেছেন বার বার। কিন্তু সফল হননি। এই ঘটনায় দুবারের ময়নাতদন্তেই মৃত্যুর কারণ আত্মহত্যা বলে প্রতিবেদন দেওয়া হয়। তৃতীয়বারে ভিন্ন কথা। সেই প্রতিবেদনে বলা হয়, নিহতের গলা ও শরীরে যেসব স্থানে ধারালো ব্লেডের আঘাত রয়েছে তা নিজের হাতে করা সম্ভব নয়। শরীরে সূক্ষ্মভাবে যে পোচ দেওয়া হয়েছে তা কিছুটা বাঁকাভাবে ক্ষতের সৃষ্টি হয়। খুনি যেই হোক বাম হাত ব্যবহার করেছে। এই প্রতিবেদনের পর পুলিশি তদন্তে নতুন মোড় নেয়। পুলিশ বাম হাতের বিষয়টি মাথায় রেখে তদন্ত করে। আবিষ্কার করে খুনি তাদের সামনেই রয়েছে। কারণ হতভাগ্য সালেহার স্বামী ডা. ইকবাল একজন বাঁ-হাতি। সালেহা ছিলেন বিত্তবান বাবার একমাত্র কন্যা। ধনী ব্যবসায়ী পরিবারের সাত ভাইয়ের এক বোন ছিলেন সালেহা। সালেহার ধনাঢ্য বাবা মেয়ের শিক্ষার্জনের বিষয়টিকে খুব একটা পাত্তা দেননি। যার ফলশ্রুতিতে সালেহা শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পাননি। ধনী ব্যবসায়ী পরিবারের সাত ভাইয়ের এক বোন ছিলেন সালেহা। সালেহার ধনাঢ্য বাবা মেয়ের শিক্ষার্জনের বিষয়টিকে খুব একটা পাত্তা দেননি। তিনি বিত্তবান ছিলেন। ভেবেছিলেন বিত্তের জোরেই মেয়েকে ভালো একটা পাত্রের হাতে তুলে দেবেন। আর সে লক্ষ্যেই মেয়েকে সুখী করার সঠিক উপায় হিসেবে শিক্ষিত জামাই খুঁজতে শুরু করলেন। এক পর্যায়ে পেয়েও গেলেন টাকার বিনিময়ে শিক্ষিত মেয়েজামাই।
১৯৭৮ সালের ১৮ এপ্রিল। দুপুরের পর কাজের মেয়ে মনোয়ারার সঙ্গে এক লজ্জাকর পরিস্থিতিতে ধরা পড়ে যান সালেহার কাছে। প্রতিবাদ করতেই ডা. ইকবাল সালেহার চুল ধরে আছড়াতে থাকেন। এ সময় সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন কাজের মেয়ে মনোয়ারাও। একপর্যায়ে দরজার ডাঁসা দিয়ে সালেহার মাথায় আঘাত করেন। ঘটনাস্থলেই মারা যান সালেহা। ভারী এই বস্তু দিয়ে সালেহার মাথায় আঘাত করার কারণে তার মাথার মগজ গলে যায়।এরপর ধারালো ব্লেড দিয়ে তার গলা সাত ইঞ্চি কেটে ফেলেন। সে সময় গ্রেফতার হওয়া কাজের মেয়ে মনোয়ারার ভাষ্যমতে, সে নিজেও দেখেছে গলা কাটতে। বাধাও দিয়েছে। কিন্তু ইকবাল তাকেই উল্টো কয়েকটা চড় দিয়েছেন। সালেহার গলা কেটে তারা সবাই বারান্দায় গিয়ে চিৎকার করতে থাকেন। বলতে থাকেন, সালেহা আত্মহত্যা করেছেন। কে কোথায় আছো আসো। এসব নাটক ইকবাল সাজিয়ে দিয়েছিলেন বাসার সবাইকে। জবাই করে ইকবাল প্রচার চালান সালেহা আত্মহত্যা করেছেন। লাশ ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে পাঠানো হয়।
সেখানে ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়। পরদিন ভোর ৬টায় লাশ মর্গ থেকে ইকবালের কাছেই হস্তান্তর করা হয়। রিপোর্টে আত্মহত্যাজনিত মৃত্যু বলে চিকিৎসকরা রিপোর্ট দেন। রিপোর্টটি ছিল ভুয়া, যা পরে প্রমাণিত হয়। ডা. ইকবাল ছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক। ময়নাতদন্তকারী ডাক্তার তার বন্ধু। আগে থেকে সবকিছু তারা ঠিক করে রেখেছিল। তাই সালেহার ময়নাতদন্ত করা ছিল শুধু আনুষ্ঠানিকতা। ডাক্তাররা বললেন, সালেহা আত্মহত্যাই করেছে। এটি কোনো হত্যাকাণ্ড নয়। লাশের দাফন হয়। কিন্তু সাংবাদিকদের কাছে ঘটনাটি অত্যন্ত সন্দেহজনক মনে হতে থাকে। সন্দেহ হয় বিদেশে অবস্থানরত সালেহার এক ভাইয়ের। পত্রিকায় অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ হতে থাকে। সালেহার পরিবার আবারও ময়নাতদন্তের অনুরোধ জানান। দ্বিতীয় দফায় ময়নাতদন্ত হয়। সেখানে আবারও মৃত্যুর কারণ আত্মহত্যা বলা হয়। তৃতীয়বার আবারও ময়নাতদন্তের আবেদন জানানো হলে তা গ্রহণ হয় না। কিন্তু অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তার পরিবারের সঙ্গে তখন সালেহার পরিবারের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। যে কারণে আবারও ময়নাতদন্ত করার আবেদনটি গ্রহণ করার ব্যবস্থা হয়। কবর থেকে লাশ উত্তোলন করে এবার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মর্গে ময়নাতদন্ত হয়। এবার বেরিয়ে আসে আসল রহস্য। প্রতিবেদনে বলা হয়, এটি হত্যা। মাথায় আঘাত করেই সালেহাকে হত্যার পর গলায় পোঁচ দেওয়া হয়েছে।
ওই সময়ে সালেহা হত্যাকাণ্ডটি ছিল স্মরণকালের সেরা চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ড। এ ঘটনায় দেশের মানুষ নিন্দা ও ক্ষোভ প্রকাশে সোচ্চার হয়েছিল। পত্রিকায় তাদের অনুসন্ধানীমূলক প্রতিবেদন না হলে হয়তো সালেহা খুনের ঘটনাটি প্রকাশ পেত না। অপমৃত্যু হিসেবেই থাকত। পত্রিকায় প্রতিবেদন হওয়ার কারণেই তৃতীয় দফা ময়নাতদন্ত হয় যাতে খুনের ঘটনাটি প্রকাশ পায়। এ কারণে ইকবালের পরিবার তাদের ওপর এমন ক্ষুব্ধ হয়েছিল যে, ফাঁসির রায় কার্যকরের পর ইকবালের বাসায় গেলে সাংবাদিকদের দা নিয়ে ধাওয়া করেছিল ইকবালের স্বজনরা।