এ বি এম সালেহ উদ্দীন,লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। উপমহাদেশের রাজনীতিতে একজন আলোচিত নাম। বাংলাদেশ স্বাধীনের আগে অর্থাৎ পাকিস্তান আমলেই ভারতবর্ষের একজন আলোচিত রাজনীতিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন।এই প্রতিষ্ঠালাভের অন্যতম কারণ হচ্ছে গণমানুষ। গণমানুষের স্বাধীনতা, মুক্তি ও অধিকার আদায়ের জন্য তিনি রাজনীতিতে যোগ
দিয়েছিলেন। তিনি অবিভক্ত বাংলার সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী ভারতের কণ্ঠস্বর শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের নীতিতে গণমানুষের স্বার্থে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে উঠেছিলেন।গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর একজন বিশ্বাসী ও নিবেদিতপ্রাণ অন্যতম অনুজপ্রতিম বিশ্বাসী
নেতা ছিলেন। সোহরাওয়ার্দী যেমন তাঁর প্রভাবপ্রতিপত্তি জমিদারিসহ সমস্ত অর্থ-সম্পদ সাধারণ মানুষের স্বার্থে বিলীন করে দিয়ে রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেছেন। বঙ্গবন্ধুও তেমনই সাধারণ মানুষের কাতারে চলে এসেছিলেন।
তিনি মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর সঙ্গেও একনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন।
বঙ্গবন্ধুর দুই মহান দুই রাজনৈতিক গুরু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মওলানা ভাসানীর আন্তর্জাতিক পরিচিতি ছিল। তবে পরে দূরদর্শিতা ও বিচক্ষণ রাজনীতির ধারবাহিকতায় আন্তর্জাতিক বিশ্বে বঙ্গবন্ধুর পরিচিতি অনেকগুণ বেড়ে গেছে।
পূর্বসূরি নেতাদ্বয়ের মতো বঙ্গবন্ধুও তাঁর সমগ্রজীবন গণমানুষের স্বার্থে ব্যয় করেছেন ।
জনগণের মাঝে স্বস্তি-শান্তি ও তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আজীবন সংগ্রাম করেছেন। প্রতিটি সংগ্রামের(রাজনৈতিক ) মাঠে বঙ্গবন্ধুকে অনেক প্রতিবন্ধকতা ও বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে।পাকিস্তান আমলে (১৯৬৬)গণ-অধিকারমূলক একটি যুগান্তকারী ৬ দফা কর্মসূচি উপস্থাপনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু রাজনীতির শীর্ষে উঠে আসেন।জনগণের মৌলিক অধিকারের আন্দোলন ও সংগ্রামে সম্পৃক্ত থাকার কারণে সমগ্র রাজনৈতিক জীবনে বহুবার জেল খেটেছেন।একসময় আন্দোলনের ক্ষীপ্রতা এমন পর্যায়ে উপনীত হয়েছিল যে তাঁকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামালায় এক নম্বর আসামির তালিকায় অভিযুক্ত করা হয়। একপর্যায়ে কোর্ট তাঁর বিরুদ্ধে ফাঁসির অর্ডার দেয়। কিন্তু গণমানুষের আন্দোলন ও আন্তর্জাতিক দাবির মুখে তৎকালীন পাকিস্তানি সরকার পরাজিত হয়। বঙ্গবন্ধু বেকসুর
খালাস পেয়ে যান।
কশোর মুজিব ও প্রথম জেল
১৯৩৮ সাল। প্রথম মহাযুদ্ধের ঘনঘটায় যখন ভারতবর্ষের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের হিন্দুত্ববাদী মৌলবাদের পদলেহন তখন ভারতের কিছু কিছু মুসলিম সাহসী যোদ্ধা সতত সক্রিয়ভূমিকায়। তারা যেকোনো কট্টরপন্থার চেয়ে সুশীল সমাজ মুক্তবুদ্ধির কথা বলে। মনন চেতনায় আধুনিক মুসলিম ও প্রগতিশীলতার উষ্ণতায় সেই সময়ে পূর্ববাংলার আনাচে কানাচে কতিপয় মুসলিম কিশোর, তরুণ যোদ্ধা শিক্ষা, সামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের আকাশকে আলোকিত ও ঝলকিত করে রাখে।
বাংলার বিভিন্ন এলাকার মধ্যে ফরিদপুরের টুঙ্গিপাড়ায় এক প্রতিবাদী চেতনার স্কুলপড়ুয়া কিশোর পড়াশুনার পাশাপাশি সামাজিক কাজে সক্রিয়। এরই মধ্যে বাবা শেখ লুৎফর রহমান গোপালগঞ্জে (পরিবারসহ) বদলি হলেন। বঙ্গবন্ধুকে ভর্তি করানো হলো মিশন স্কুলে।এপ্রিল মাস। সন্ধ্যায় ফুটবল খেলে বাড়ি ফিরেছেন তিনি। এমন সময় গোপালগঞ্জের খন্দকার শামসুল হুদা এসে জানালেন, বঙ্গবন্ধুর সহপাঠী আবদুল মালেককে হিন্দু মহাসভার সভাপতি সুরেন ব্যানার্জির বাড়িতে ধরে নিয়ে গিয়ে মারধর করা হচ্ছে।
খবর পেয়ে বঙ্গবন্ধু এক মুহূর্ত দেরি করলেন না। তাঁর এক ছাত্রবন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে ছুটে গেলেন সুরেন ব্যানার্জির বাড়ি। সেখানে গিয়ে মালেককে ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ করলেন। বন্ধুকে ছেড়ে দেওয়া দূরের কথা, উল্টো গালাগাল খেতে হলো! কিশোর শেখ মুজিব প্রতিবাদ জানালেন। খবর পাঠিয়ে ডেকে আনলেন দলের ছেলেদের।
খবর পেয়ে বঙ্গবন্ধুর দুই মামা শেখ সিরাজুল হক ও শেখ জাফর সাদেক লোকজন নিয়ে ছুটে এলেন। দুই পক্ষের মধ্যে মারামারি শুরু হয়ে গেল । বঙ্গবন্ধু তার বন্ধুদের নিয়ে দরজা ভেঙে আব্দুল মালেককে মুক্ত করে আনলেন।
তখনকার সামাজিক অবস্থা ধর্মান্ধ হিন্দু জমিদারদের করায়ত্বে ছিল। মুসলিম কোনো কোনো পরিবারের মধ্যেও সামাজিক অবক্ষয় ছিল।এক দিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডামাঢোল, অন্য দিকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের শোষণ, তোষণে বলা যায় পুরো হিন্দু
প্রভাবান্বিত কট্টপন্থীদের হাতে সমাজ ব্যবস্থা। সেই সময় বঙ্গবন্ধুর কিশোরোত্তীর্ণ প্রতিবাদী চেতনার বিষয়টি ছিল অনেকটা বিস্ময়ের ব্যাপার। সেই ঘটনায় পুরো শহরে তোলপাড়। হিন্দু নেতারা মুসলিম ছেলেদের বিরুদ্ধে থানায় মামলা করলেন। খন্দকার শামসুল হককে করা হলো হুকুমের আসামি। এ দিকে তরুণ মুজিবের বিরুদ্ধেও খুনের গুরুতর অভিযোগে মামলা দায়ের করা হলো।
মামলার আসামির মধ্যে বঙ্গবন্ধুর দুই মামাসহ বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
বঙ্গবন্ধুর সাথের কোনো কোনো বন্ধুকে আত্মগোপন করে থাকতে হল। কিন্তু কিশোর মুজিব পালালেন না। একদিন পুলিশ বাড়ি এসে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা দেখায়ে গেল। জানা যায় যে, বঙ্গবন্ধুর বাবা এলাকায় সম্মানি লোক।সেই কারণে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার না করে, দারোগা খাওয়া-দাওয়া করে তৈরি হয়ে থানায় আসতে বললেন।বঙ্গবন্ধু পালিয়ে থাকেননি। অতঃপর থানায় গিয়ে নিজেই ধরা দিয়েছিলেন কিশোর শেখ মুজিব। সাত দিন পর
জামিন পেয়ে তিনি বাড়ি ফিরেছিলেন। অন্যায়ের প্রতিবাদে সোচ্চার কিশোর মুজিব ছিলেন ক্ষীপ্র ও তেজস্বী সেই ছোটবেলা থেকেই মানুষের মুক্তি ও অধিকার আদায়ের সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর মাঝে যে, প্রতিবাদী চেতনার উদ্ভব ঘটেছিল, তা তিনি সমাজ, রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে কাজে লাগিয়েছেন। তিনি সর্বদা সাহসের সাথে অন্যায়ের বিরুদ্ধে
রুখে দাঁড়াতেন। গণমানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে গেলে অনেক সময় রাষ্ট্রপুঞ্জের অসঙ্গতি ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলতে হয়। ফলে, শাসকদের পথের কাঁটা সরাতে জেল-জুলুম ও নিপীড়নের শিকার হতে হয়। জীবন বিপন্ন হয়। বঙ্গবন্ধুর বেলায়ও সে রকম হয়েছে।গণমানুষের মুক্তি ও কল্যাণে তাঁকে বহুবার জেল খাটতে হয়েছে। তাঁর এই জেল জীবনের কারণেও তিনি বিখ্যাত হয়ে আছেন।
মহান ভাষা আন্দোলনের আগে ও পরে থেকে শুরু করে, দেশ স্বাধীনের পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত জনগণের জন্য বঙ্গবন্ধুর মতো এত বৈচিত্র্যময় চড়াই-উৎরাইয়ের মধ্যে এত বেশি জেল খাটার নজির উপ-মহাদেশের রাজনীতি ও বিশ্বের ইতিহাসে বিরল।পাকিস্তান সরকারের শোষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে তিনি সর্বদা সোচ্চার ও প্রতিবাদী ভূমিকায় ছিলেন। উনিশ শো
একাত্তুর সালের পঁচিশে মার্চের কালোরাতে পাকহানাদার বাহিনীর গণহত্যা শুরু করার কিছুক্ষণ আগে এবং পরের দিন ২৬শে মার্চ বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে তিনি গ্রেফতার হয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে স্থানান্তরিত হন। পাকিস্তানের কারাগারে (বাংলাদেশে ফিরে আসার পূর্ব পর্যš ) তিনি বন্দিজীবন কাটান। সেটি ছিল তাঁর জীবনের শেষ জেলখাটা। পরে (১৯৭২) স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসার মধ্য দিয়ে তাঁর সর্বশেষ
জেলজীবনের যবনিকা টানা হয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। উপ-মহাদেশের রাজনীতির চড়াই-উৎরাইয়ে স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা হিসেবে বঙ্গবন্ধুর যেমন চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। তেমনই রাষ্ট্রক্ষমতায় আরোহণের আগে ও পরে তাঁর বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনে গণমানুষের মুক্তি ও অধিকার আদায়ের প্রতিবাদী চেতনাই তাঁকে উত্তঙ্গ জনপ্রিয়তার শীর্ষে তুলেছিল। তাঁর রাজনৈতিক ও তথা সমগ্র জীবনটাই মূলত একটি অবিস্মরণীয় ইতিহাস।