(১৯২০-১৯৭৫)
এবিএম সালেহ উদ্দীন
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান । উপমহাদেশের রাজনীতিতে একজন আলোচিত নাম । বাংলাদেশ স্বাধীনের আগে অর্থ্যাৎ পাকিস্তান আমলেই তিনি ভারতবর্ষের একজন আলোচিত রাজনীতিক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হন । গণমানুষের স্বার্থে রাজনীতিতে আত্মনিবেদনের মধ্যদিয়ে তিনি ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন ।এই প্রতিষ্ঠালাভের অন্যতম কারণ হচ্ছে গণমানুষ । গণমানুষের স্বাধীনতা,মুক্তি ও অধিকার আদায়ের জন্য তিনি রাজনীতিতে যোগ দিয়েছিলেন । তিনি অবিভক্ত বাংলার সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী অখন্ড ভারতের কন্ঠস্বর শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের নীতিতে গণমানুষের স্বার্থে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে উঠেছিলেন। গণতন্ত্রের মানসপূত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দির একজন বিশ্বাসী ও নিবেদিতপ্রাণ অন্যতম অনুজপ্রতিম বিশ্বাসী নেতা ছিলেন। সোহরাওয়ার্দি যেমন তাঁর প্রভাবপ্রত্তি জমিদারিসহ সমস্ত অর্থ-সম্পদ সাধারণ মানুষের স্বার্থে বিলীন করে দিয়ে রাজনীতিতে অংশ করেছেন । বঙ্গবন্ধুও তেমনই সাধারণ মানুষের কাতারে চলে এসেছিলেন ।
তিনি মজলুম জননেতা মাওলানা ভাসানীর সঙ্গেও একনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন ।বঙ্গবন্ধুর মহান দুই রাজনৈতিকগুরু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মাওলানা ভাসানী । উভয়ের ছিল আন্তর্জাতিক পরিচিতি । তবে পরবর্তীতে দূরদর্শিতা ও বিচক্ষণ রাজনীতির ধারবাহিকতায় আন্তর্জাতিক বিশ্বে বঙ্গবন্ধুর পরিচিতি অনেকগুণ বেড়ে গিয়েছে । সুদীর্ঘ রাজনৈতিক প্রজ্ঞাবোধের মধ্যদিয়ে বঙ্গবন্ধু স্বার্থকভাবে সাফল্য অর্জন করেন ।পূর্বসূরী নেতাদ্বয়ের মতো বঙ্গবন্ধুও তাঁর সমগ্রজীবন গণমানুষের স্বার্থে ব্যয় করেছেন । বঙ্গবন্ধুর বর্ণাঢ্য জীবনের বহু চড়াই-উৎড়াইয়ের মধ্যে রাজনৈতিক জীবনই তাঁকে একজন সত্যিকার সংগ্রামী মানুষরূপে প্রতিষ্ঠিত করেছে । গণমানুষের মুক্তি ও অধিকারের জন্য লড়াই করা ছিল তাঁর জীবনের প্রধান আকর্ষন । তিনি ছিলেন একজন চৌকষ বুদ্ধিমতাসম্পন্ন ও বিচক্ষণ রাজনীতিবিদ । জনগণের স্বার্থে রাজনীতি করার ফলে তিনি বহুবার গ্রেফতার হয়েছেন, জেল খেঁটেছেন এবং নিপীড়নের শিকার হয়েছেন।
জনগণের মাঝে স্বস্তি- শান্তি এবং গণ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি আজীবন সংগ্রাম করেছেন । প্রতিটি সংগ্রামের (রাজনৈতিক ) মাঠে বঙ্গবন্ধুকে অনেক প্রতিবন্ধকতা ও বাধার সম্মূখিন হতে হয়েছে ।জনগণের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তিনি ছয় দফা স্বায়ত্তশাসন পরিকল্পনা প্রস্তাব করেন । সেটিকে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী পরিকল্পনা হিসেবে ঘোষণার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে দোষী সাব্যস্ত করা হয় । ছয় দফা দাবির প্রধান লক্ষ্য ছিল প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন । যার কারণে তিনি তৎকালীন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের অন্যতম বিরোধী পক্ষে পরিণত হন । ১৯৬৮ সালে ভারত সরকারের সাথে যোগসাজশ ও ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এনে তাকে প্রধান আসামি করে আগরতলা মামলা দায়ের করা হয় । তাঁর বিরুদ্ধে ফাঁসির অর্ডার হয় । কিন্তু গণমানুষের আন্দোলন ও আন্তর্জাতিক দাবির মুখে তৎকালীন পাকিস্তানী সরকার পরাজিত হয় । বঙ্গবন্ধু বেকসুর খালাস পেয়ে যান।
প্রকাশ থাকে যে,উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান তথা সমগ্র পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি পাল্টে দেয় । মূলত: সেই গণঅভ্যুত্থানই পরবর্তীতেস্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আন্দোলন ক্ষীপ্রতর হয়ে ওঠে। এমতাবস্থায় পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয় । সেটিও তাঁর রাজনৈতিকজীবনের এবং ঐতিহাসিক মুক্তি সংগ্রামের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। শেষ পর্যন্ত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় চেপে থাকা আইয়ুব খান সরকারের পতন ঘটে সেই গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে; কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁকে সরকার গঠনের সুযোগ দেয়া হয়নি। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে,পাকিস্তান আমলে (১৯৬৬) গণঅধিকার মূলক একটি যুগান্তকারী ৬ দফা কর্মসূচি উপস্থাপনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু রাজনীতির শীর্ষে উঠে আসেন।
কিশোর মুজিব ও তাঁর প্রথম জেল:১৯৩৮ সাল। প্রথম মহাযুদ্ধের ঘনঘটায় যখন ভারতবর্ষের বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের হিন্দুত্ববাদী মৌলবাদের পদলেহন চলছিল । তখন অখন্ড ভারতের কিছু কিছু মুসলিম সাহসী যোদ্ধা ছিলেন সক্রিয়ভূমিকায় । তারও আগে শেরে বাংলা একে ফজলুল হক,কাজী নজরুল ইসলামের মত অনেক ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অগ্রসৈনিকদের সংগ্রামী আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে তাঁদের পদাঙ্ক অনুসরণ করতে শুরু এই সাহসী যুবকরা । তারা যেকোন কট্টরপন্থার চেয়ে সুশীল সমাজ বিনির্মাণ ও মুক্তবুদ্ধির কথা বলে । মনন চেতনায় আধুনিক মুসলিম ও প্রগতিশীলতার উষ্ণতায় সেই সময় পূর্ববাংলার আনাচে কানাচে কতিপয় মুসলিম কিশোর,তরুণ সংগ্রামী যোদ্ধাগণ ভারতবর্ষের বিভিন্ন জেলা এবং এলাকায় শিক্ষা, সামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলের আকাশকে আলোকিত ও ঝলকিত করে রাখে ।সেইসময় পূর্ববাংলার বিভিন্ন এলাকার মধ্যে বরিশাল ও ফরিদপুর ছিল অন্যতম । ফরিদপুর জেলার টুঙ্গিপাড়ায় তখন এক প্রতিবাদী চেতনার স্কুলপড়ুয়া কিশোর পড়াশুনার পাশাপাশি সামাজিক কাজে সক্রিয় । এরই মধ্যে বাবা শেখ লুৎফর রহমান গোপালগন্জে (পরিবারসহ)বদলি হলেন। সেই কিশোরকে (বঙ্গবন্ধু) ভর্তি করানো হল গোপালগন্জের মিশন স্কুলে ।এপ্রিল মাস। সন্ধ্যায় ফুটবল খেলে বাড়ি ফিরেছেন তিনি। এমন সময় গোপালগঞ্জের খন্দকার শামসুল হুদা এসে জানালেন, হিন্দু মহাসভার সভাপতি সুরেন ব্যানার্জির বাড়িতে কতিপয় হিন্দুলোক বঙ্গবন্ধুর সহপাঠী আবদুল মালেককে ধরে নিয়ে গিয়ে মারধর করা হচ্ছে। খবরটি শুনে কিশোর মুজিব (বঙ্গবন্ধু)এক মুহূর্ত দেরি করলেন না । তিনি তাঁর এক ছাত্রবন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে সুরেন ব্যানার্জির বাড়িতে ছুটে গেলেন । সেখানে গিয়ে তিনি আবদুল মালেককে ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ জানালেন । বন্ধুকে ছেড়ে দেওয়া দূরের কথা, তাকে উল্টো গালি-গালাজ খেতে হলো ! কিশোর শেখ মুজিব প্রতিবাদ জানালেন । খবর পাঠিয়ে ডেকে আনলেন দলের ছেলেদের । সেই খবরটি পেয়ে বঙ্গবন্ধুর দুই মামা শেখ সিরাজুল হক ও শেখ জাফর সাদেক লোকজন নিয়ে ছুটে এলেন । শুরু হয়ে গেল দুই পক্ষের মধ্যে মারামারি । কিশোর মুজিব (বঙ্গবন্ধু)তাঁর বন্ধুদের নিয়ে দরজা ভেঙ্গে আব্দুল মালেককে মুক্ত করে আনলেন । তখনকার সামাজিক অবস্থা ধর্মান্ধ হিন্দু জমিদারদের করায়ত্বে ছিল । তাদের একচ্ছত্র প্রভাবে সাধারণ জনগণ প্রায়শ:ই ভীতসন্ত্রস্ত থাকতেন । বর্ণবাদী হিন্দুদের মধ্যে সামাজিক কুসংস্কার ছিল ।
মামলার আসামীর মধ্যে বঙ্গবন্ধুর দুইমামাসহ বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে । বঙ্গবন্ধুর সাথের কোন কোন বন্ধুকে আত্মগোপন করে থাকতে হল।কিন্তু কিশোর মুজিব পালালেন না । একদিন পুলিশ বাড়ি এসে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা দেখায়ে গেল । জানা যায় যে, বঙ্গবন্ধুর বাবা এলাকায় সন্মানি লোক । সেই কারণে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার না করে, দারোগা খাওয়া-দাওয়া করে তৈরি হয়ে থানায় আসতে বললেন । বঙ্গবন্ধু পালিয়ে থাকেন নি । অত:পর থানায় গিয়ে নিজেই ধরা দিয়েছিলেন কিশোর শেখ মুজিব । সাত দিন পর জামিন পেয়ে তিনি বাড়ি ফিরেছিলেন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার কৈশোরকালেই মুজিবের মাঝে ক্ষীপ্রতা ও তেজস্বীভাব পরিলক্ষিত হতে দেখা যায়।
সেই ছোটবেলা থেকেই মানুষের মুক্তি ও অধিকার আদায়ের সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর মাঝে যে, প্রতিবাদী চেতনার উদ্ভব ঘটেছিল, সেটি তিনি তাঁর সামিজিক,রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক জীবনে কাজে লাগিয়েছেন । যা করতেন সর্বদা সাহসের সাথেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে মোকাবিলা করতেন । গণমানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে গেলে অনেকসময় রাষ্ট্রপুন্জের অসঙ্গতি ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলতে হয় । ফলে, শাসকদের পথের কাটা সরাতে জেল-জুলুম ও নিপীড়নের শিকার হতে হয় । জীবন বিপন্ন হয় । বঙ্গবন্ধুর বেলায়ও সেরকম ঘটনা বহুবার ঘটেছে ।গণমানুষের মুক্তি ও কল্যাণে তাঁকে বহুবার জেল খাটতে হয়েছে । তাঁর এই জেল জীবনের কারণেও তিনি আরো বেশি বিখ্যাত হয়ে আছেন ।মহান ভাষা আন্দোলনের সম্পৃক্ততার আগে থেকে শুরু করে , দেশ স্বাধীনের পূর্বমুহুর্ত পর্যন্ত জনগণের জন্য বঙ্গবন্ধুর মতো এত বৈচিত্রময় চড়াই-উৎড়াইয়ের মধ্যে এত বেশি জেল খাটার নজীর উপমহাদেশের রাজনীতি ও বিশ্বের ইতিহাসে বিরল।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার রাজনৈতিক জীবনে ৪ হাজার ৬৮২ দিন কারাভোগ করেছেন । তন্মধ্যে কিশোর অবস্থায় ব্রিটিশ আমলে সর্বপ্রথম সাত দিন কারাভোগ করেন। বাকি ৪ হাজার ৬৭৫ দিন তিনি কারাভোগ করেন পাকিস্তান সরকারের আমলে। তিনি জীবনের প্রায় ১৩ বছর কারাগারে ছিলেন।
পাকিস্তান সরকারের শোষণ নিপীড়নের বিরুদ্ধে তিনি সর্বদা সোচ্চার ও প্রতিবাদী ছিলেন । উনিশ শো একাত্তুর সালের পঁচিশে মার্চের কালোরাতে পাকহানাদার বাহিনীর গণহত্যা শুরু করার কিছুক্ষণ আগে এবং পরের দিন ২৬শে মার্চ বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে তিনি গ্রেফতার হয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে স্থানান্তরিত হন । পাকিস্তানের কারাগারে( বাংলাদেশে ফিরে আসার পূর্ব পর্যন্ত )তিনি বন্দীজীবন কাটান । সেটাই ছিল তাঁর জীবনের শেষ জেলখাটা । পরবর্তীতে(১৯৭২) স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসার মধ্যদিয়ে তাঁর সর্বশেষ জেলজীবনের যবনিকা টানা হয় । বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান । ইতিহাসের একটি অবিস্মরণীয় নাম । উপমহাদেশের রাজনীতির চড়াই-উৎডাইয়ে স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা হিসেবে যেমন চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন । তেমনই রাষ্ট্রক্ষমতায় আরোহনের আগে ও পরে তাঁর বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনে গণমানুষের মুক্তি ও অধিকার আদায়ের প্রতিবাদী চেতনাই তাঁকে উত্তুঙ্গ জনপ্রিয়তার শীর্ষে তুলেছিল । তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞাবোধ ও বিচক্ষণতার দৃষ্টান্ত ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকবে ।বঙ্গবন্ধুর সমগ্র জীবনটাই মূলত: একটি অবিস্মরণীয় ইতিহাস।
—লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক ।