শরীফ হাসান
পনেরোই অগাস্ট পার হয়েছে এক সপ্তাহ হলো। বাঙ্গালির মহানায়ক বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এখনও দেশে-বিদেশে বিভিন্ন রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করছে, কবি-সাহিত্যিকরা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লিখছেন, শিল্পীরা আবৃত্তি করছেন, গান করছেন। শিশুরা এ মহান নেতার জীবন ও আদর্শ সম্পর্কে জানছে। নিঃসন্দেহে এটি দারুণ ব্যাপার। কিন্তু রাজনৈতিকভাবে বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে কতটুকু চর্চা করা হচ্ছে বা তাঁর আদর্শ বাস্তবায়নে এই মাসে আমরা আদৌ কোন অনুপ্রেরণা নিচ্ছি কিনা সে প্রশ্ন আজ অবধারিত।
বঙ্গবন্ধু তাঁর মানসপটে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের যে চিত্রকল্প এঁকেছিলেন তা ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমতার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত এক ন্যায়নিষ্ঠ সমাজব্যবস্থা যা থেকে আমরা আজ যোজন যোজন দূরে। বিশেষ করে, ধর্মনিরপেক্ষতার বিষয়টি বর্তমানে চরমভাবে উপেক্ষিত। অবশ্য ধর্মনিরপেক্ষতা বা সেক্যুলারিজম শব্দটির সংজ্ঞা ও ব্যবহার নিয়ে এখনও অযাচিত তর্ক বিতর্ক রয়েছে। কেউ বলেন, ধর্মনিরপেক্ষতা হল ধর্মহীনতা আবার কেউ কেউ বলেন ধর্মনিরপেক্ষতা হল সকল ধর্মের প্রতি সমান শ্রদ্ধা। Merriam-Webster ডিকশনারিতে সেক্যুলারিজমের সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে এভাবে- “The belief that religion should not play a role in government, education, or other public parts of society.”
সহজভাবে বললে, শব্দটি একটি মতবাদ যা বিশ্বাস করে ধর্মকে সকল রাষ্ট্রীর নীতি ও কর্মকান্ড থেকে পৃথক করা উচিত যাতে রাষ্ট্রের জনগণ যারা বিভিন্ন ধর্মের অনুসারী তাদের সকলের অধিকার সমুন্নত থাকে। তাই বলে এতে ধর্মকে অস্বীকার করা হয়না, স্রেফ ধর্মকে ব্যক্তিগত পর্যায়ে সীমাবদ্ধ করতে উৎসাহিত করা হয়। ১৯৭২ সালের ৭ জুন, রেসকোর্স ময়দানের ভাষণে বঙ্গবন্ধু এমনটিই বলেছিলেন।
“বাংলাদেশ হবে ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র। ধর্ম নিরপেক্ষ মানে ধর্মহীনতা নয়। মুসলমান মুসলমানের ধর্ম পালন করবে। হিন্দু তার ধর্ম পালন করবে। খ্রিস্টান তার ধর্ম পালন করবে। বৌদ্ধও তার নিজের ধর্ম পালন করবে। এ মাটিতে ধর্মহীনতা নাই, ধর্ম নিরপেক্ষতা আছে। এর একটা মানে আছে। এখানে ধর্মের নামে ব্যবসা চলবে না। ধর্মের নামে মানুষকে লুট করে খাওয়া চলবে না। ধর্মের নামে রাজনীতি করে রাজাকার, আল বদর পয়দা করা বাংলার বুকে আর চলবে না। সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করতে দেওয়া হবে না।” এই কথাগুলো উচ্চারণ করার মাধ্যমে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রকাঠামোতে বঙ্গবন্ধু ধর্মের অবস্থান পরিষ্কার করেন। এরপর বিতর্কের কোন সুযোগ থাকার কথা নয়।
পৃথিবীর প্রায় সকল উন্নত দেশ তাই রাষ্ট্রীয় মূল নীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতাকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া এবং ইউরোপের অধিকাংশ দেশ অনেক আগে থেকেই এই নীতিতে বিশ্বাসী। স্বাধীনতার পর ভারতও ধর্মনিরপেক্ষতাকে তাদের রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসাবে ঘোষণা করেছিল। সেই একই ধারায় মহান মুক্তিযুদ্ধের পর বাঙ্গালির স্বাধীনতা আন্দোলনের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সুযোগ্য সহযোদ্ধাদের আদর্শের প্রতিফলন হিসাবে বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়।
জিন্নাহর দ্বিজাতি তত্ত্বের পাকিস্তানি ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদকে কবর দিয়ে বহু সংগ্রামের পর লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে, রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে এই ভূখণ্ডের মানুষ স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছিল, উপড়ে ফেলেছিল বৈষম্য, ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িকতার বিষবৃক্ষ। মুক্তিযুদ্ধের সেই মহান চেতনার আলোকে দেশ পরিচালনার মূল নীতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র। মধ্যযুগীয় চিন্তা চেতনার ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক শোষণ নিপীড়নের মধ্যে দিয়ে পুঞ্জিভূত গণক্রোধ যে অবিস্মরণীয় নেতার হাত ধরে মুক্তির পথ দেখেছিলো সে পর্বতসম ব্যক্তিত্বের নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
আর ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে উপড়ে ফেলা সাম্প্রদায়িকতার সেই বিষবৃক্ষের রয়ে যাওয়া শেকড় থেকে আবার গজায় মধ্যযুগীয় ধর্মান্ধতার চারাগাছ। পরবর্তী সময়ে সেনা ছাউনি থেকে আসা শাসকরা সেই গাছের গোড়ায় পানি ঢেলে, পরিচর্যা করে তাকে বাংলার বুকে শক্তিশালী মহীরুহ করে তোলে। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা কেবল স্বাধীনতা আন্দোলনের মহানায়ককে হত্যাতেই সীমিত থাকেনি বরং সেটি মুক্তিযুদ্ধে জয়ী সাম্যবাদী শক্তি ন্যায় রাষ্ট্র বাংলাদেশ হত্যার নামান্তর।
ইতিহাসের বর্বরতম হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে ক্ষমতার পটপরিবর্তন এনে দেশের সামরিক বাহিনীকে ব্যবহার করে পাকিস্তানি ধারায় প্রত্যাবর্তনের প্রক্রিয়া জোরদার করে কুচক্রী মহল। এই পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ সুবিধাভোগী সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রীয় চার নীতি বদল, এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতির ওপর সাংবিধানিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করার মাধ্যমে হাজার বছরের অসাম্প্রদায়িক বাংলার বেদীমূলে প্রথম ফাটল ধরান।
এ অপশক্তি ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের বিভ্রান্ত করার জন্য ‘পরম দয়ালু আল্লাহর নামে’ এবং সংবিধানের প্রস্তাবনায় ধর্মনিরপেক্ষতার স্থলে ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস হইবে যাবতীয় কার্যাবলির ভিত্তি।’ শব্দগুলো সংবিধানে সন্নিবেশ করে। সেনাশাসক জিয়া কর্তৃক সংবিধানের উক্ত ৫ম সংশোধনীর পর আরেক সামরিক শাসক এরশাদ ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করে ৮ম সংশোধনী এনে মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশকে কার্যত পাকিস্তানি সাম্প্রদায়িক ধারায় প্রত্যাবর্তন সম্পন্ন করেন।
এই দুই সংশোধনীর ফলে মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সকল সম্প্রদায়ের ইতিহাস ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ বাঙ্গালি জাতিসত্ত্বা বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে কলুষিত হয় সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙ্গালি মুসলমানের মানস ও মনন, মৃত্যু ঘটে অসাম্প্রদায়িক, সর্বজনীন বাংলাদেশের। যে মুসলমানরা এত বছর ধরে হিন্দুকে ভাই বলে ডেকেছে, ঈদ ও পূজার আনন্দ ভাগাভাগি করেছে তারাই আজ সংখ্যালঘুত্বের সুযোগ নিয়ে আপন পড়শির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে, নির্বিচারে নির্যাতন করছে ধর্মের দোহাই দিয়ে।
সাম্প্রদায়িক অত্যাচার আর অনাচারে ভিন্ন মত ও সম্প্রদায়ের মানুষ আজ অন্য যে কোন সময়ের চেয়ে অনেক বেশি আক্রান্ত, জর্জরিত। পত্রিকার পাতা খুললেই ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের উপর অত্যাচার নির্যাতনের খবর আর সোশ্যাল মিডিয়া খুললেই দেখা যায়, ধর্মীয় গোঁড়ামিতে পূর্ণরা সেখানে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়াচ্ছে। ধর্ম পালনের চেয়ে ধর্মানুভূতিতে এদের বেশি আগ্রহ। ধর্মীয় অনুশাসন পালনের চেয়ে ধর্মের শাসনে এর ঢের উৎসাহী। রাসূলের তরিকা জানার চাইতে রাসূলকে কে অবমাননা করল তা জানতে তাদের বেশি আগ্রহ। ধর্ম অবমাননা এবং এ সংক্রান্ত অনুভূতি নিয়েই এদের সব মাথাব্যথা। এ মাথাব্যথা এতটাই প্রবল যে এরা অন্যের মাথা নামিয়ে ফেলতে কুণ্ঠিত হয়না।
কয়েক বছর আগে ঢাকায় হেফাজতের কয়েক লক্ষ সমর্থকের সমাবেশ, পুরো রাজধানীজুড়ে তাদের তাণ্ডব, রামুতে বৌদ্ধ স্থাপনা ও বসতি ধ্বংস, হিন্দুদের উপর অত্যাচার-নিপীড়ন, এবং নাস্তিক আখ্যা দিয়ে, ফর্দ বানিয়ে, ঘোষণা করে একের পর এক ব্লগার, লেখক, প্রকাশক ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বী মানুষ, ধর্মগুরু হত্যা সমগ্র বাংলাদেশে এক ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল। জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো দমনে সরকার বেশ সফল হলেও দেশে প্রতিক্রিয়াশীল সাম্প্রদায়িক শক্তিকে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়নি। আর এর মূল কারণ, রাষ্ট্র পরিচালনায় বঙ্গবন্ধু ঘোষিত ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি হতে বিচ্যুতি।
অতি সম্প্রতি বাংলাদেশ মাইনোরিটি সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি অশোক কুমার সাহার পাঠানো এক লিগ্যাল নোটিশের কারণে ধর্মনিরপেক্ষতার বিষয়টি আবার আলোচনায় এসেছে। গত ১৬ অগাস্ট সংবিধান থেকে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বাদ দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতা লেখার দাবিতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, মন্ত্রিপরিষদ সচিব, আইন মন্ত্রণালয়ের সচিব, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব, বিএনপি মহাসচিব, জাতীয় পার্টির মহাসচিব, গণফোরামের ড. কামাল হোসেন, বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) হাসানুল হক ইনু, ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেননকে বিবাদী করে জনাব ঘোষ লিগ্যাল নোটিশটি প্রদান করেন।
স্বাভাবিকভাবেই এতে ফুঁসে উঠেছে ধর্মান্ধরা। বক্তৃতা-বিবৃতির পাশাপাশি সোশ্যাল মিডিয়ায় চলছে হুমকি-ধামকি, সংখ্যালঘুদের মুণ্ডপাত। এমনকি আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের অনেকেই অনলাইনে এই ন্যায্য দাবির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। এ থেকেই বোঝা যায়, বর্তমান আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে কতখানি ধারণ করে।
যাহোক, সর্বশেষ খবর হলো, বাংলাদেশের সংবিধান থেকে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বাদ দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতার দাবি জানিয়ে পাঠানো আইনি নোটিশ প্রত্যাহার করা হয়েছে। গত ১৯ অগাস্ট নোটিশ প্রদানকারি অশোক কুমার ঘোষের পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। জনাব ঘোষ জানান, ভবিষ্যতে রাজনৈতিকভাবে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনা করে বিষয়টি সমাধান করা হবে।
আমিও বিশ্বাস করি, এই বিষয়টির সুরাহা রাজনৈতিকভাবেই হওয়া উচিৎ। রাজনৈতিক কূটকৌশলে ধর্মনিরপেক্ষতাকে নির্বাসনে পাঠানো হয়েছিল। তাই রাজনৈতিকভাবেই তা ফিরিয়ে আনতে হবে। আর এতে নেতৃত্ব দিতে হবে বঙ্গবন্ধুর দল আওয়ামী লীগকে, বঙ্গবন্ধু কন্যাকে। বঙ্গবন্ধু যে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা আজ থেকে কয়েক দশক আগে বলেছেন তা মাথায় নিয়েই বর্তমান নেতৃবৃন্দকে দেশ পরিচালনার নীতি পুনঃনির্ধারণ করতে হবে। বঙ্গবন্ধুর ধর্ম নিরপেক্ষতা নীতিকে অন্তরে ধারণ এবং রাষ্ট্রযন্ত্রে এর পুনঃস্থাপনের প্রতিজ্ঞা হতে পারে এই শোকের মাসে বঙ্গবন্ধুর প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা। নয়তো যে আদর্শের জন্য বঙ্গবন্ধু তাঁর সমগ্র জীবন উৎসর্গ করেছেন, যে আদর্শে বাঙ্গালির রাষ্ট্র বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তার সাথে প্রতারণা করা হবে, বাংলাদেশ হয়ে থাকবে একটি দীর্ঘশ্বাস, একটি সুন্দর স্বপ্নের করুণ মৃত্যু।