আকতার হোসেন
কুমু দৌড়ে এসে বলল মা একজন লোক এসেছে।
কুমুর মা জানতে চাইলো মগরিবের নামাজের পর আবার কে এলো?
এরপর কোথাও কুমুকে পাওয়া গেল না। খবরটা দিয়েই সে উধাও। দিনের অসমাপ্ত খেলা খেলতে সে চলে যায় বাড়ির বাইরে।
কুমুর মা ঘরের ভেতর থেকে উঠানে এসে দেখে একজন দিনমজুর দাঁড়িয়ে আছে। অপরিচিত লোকটির কাছে সে জানতে চাইল, কে আপনি?
আমি বদলি খাদক।
মানে কি?
আপনাদের বাড়িতে যে লোকটা সারাদিন কামলা দিছে সে আজ অন্য বাড়িতে খাবার খাইতে গেছে। আমারে সে পাঠাইছে তার মজুরীর খাবার খাইতে।
তা একটু আগে আসতে পারলেন না। সব কিছু উঠিয়ে রেখেছি। আচ্ছা দাঁড়ান দেখি কী আছে!
একটু পর কুমুর মা এক থালা ভাত আর লবণের বাটি নিয়ে এসে লোকটির সামনে রাখল। গ্লাস থেকে পানি ঢেলে হাত ভিজিয়ে ভাত নাড়াচাড়া করতে শুরু করে দিল বদলি খাদক।
ততক্ষণে কুমু এসে হাজির। ভাতের উপর সাদা লবণ ছিটিয়ে লোকটি খেতে শুরু করেছে। লবণের স্বাদ শেষ হতেই কিছুক্ষণ পরপর আরও লবণ যোগ করে নেয়। গলায় আঁকে গেলে পানি খায়। শুধু মাঝখানে একবার একটা কাঁচা মরিচ চেয়েছিল। কুমুকে তার মা বলল যাতো রান্নাঘর থেকে একটা কাঁচা মরিচ নিয়ে আয়। কুমু ফিরে এসে বলল, মরিচ নাই মা।
কাঁচা মরিচ নেই, এদিকে লবণও প্রায় শেষের দিকে। একটু লবণ হলে ভাল হতো কিন্তু গৃহকত্র্রীকে বিরক্ত করতে চাইল না সে। একজন বদলি খাদক পেট ভরে খেতে পেয়েছে এইতো বেশি।
কুমু এমন আশ্চর্য জিনিস আর কখনো দেখে নি। সে জানে খাবারের সময় নিত্যদিনের ঘটনা হলোÑ ডাইলে এতো পানি ক্যান
লবণ দিয়া সব তিতা কইরা ফালাইছো
একটু বেশি বেশি ঝাল দিতে পারো না
কাজের মধ্যে শুধু রান্নাবান্না তাও ঠিক মু করতে পার না, আমার মায়ের হাতের রান্না শিখবা কবে…
যে লোকটা ওদের বাড়িতে এসে খেয়ে গেল সে কি খাবারের নিয়মকানুন কিছুই জানে না? কি চুপচাপ নিঃশব্দ পরিবেশ। কোন উচ্চবাচ্য নেই। খাবার থালায় লাথি নেই। ভাঙাচুরার শব্দ নেই। কুমু ভীষণ আশ্চর্য হয় এই ভেবে যে খাবার পরিবেশ এরকমও হয়?
এরপর থেকে খাবার খেতে গেলেই কুমুর ভাতের থালার ওপর লোকটির চেহারা ভেসে উঠত। পেট ভরে গেলেও বসে বসে সে আরও ভাত খেত। ভাত শেষ হয়ে গেলে বলতো আরো ভাত দাও মা।
আসলে কুমু ভাত খেত না অন্যকিছু খেত সেদিকে তার খেয়াল থাকতো না। শুধু ভাবতো লোকটা তার পাশেই বসে আছে। তার থালা থেকেই ভাত উঠিয়ে উঠিয়ে সেও খাচ্ছে।
কিছুদিনের মধ্যে কুমুর নাম হয়ে গেল পেটুক কুমু। কুমু তার পেটুক হবার আসল গল্প কাউকে বলে না। শুধু মাঝে মাঝে মজা করে বলতো, আমারতো দুইটা পেট।
কুমু এখন বড় হয়ে গেছে। শুধু বয়সে না, নাম ডাকেও সে অনেক বড়। গল্পটা সে কদিন আগে এক খাবারের পরিবেশে বলল। বন্ধুর বাসায় এসেছিল নিমন্ত্রণ খেতে। টেবিল ভর্তি সাজানো খাবার ও পরিবেশনার ছবি তোলা নিয়ে তখন সবাই ব্যস্ত। ওয়াও ওয়াও করতে করতে ছবিগুলো ফেসবুকে আপলোড করে দিয়েছে কেউ কেউ। ইতিমধ্যে লাইকও আসতে শুরু করেছে। এক কোনায় বসে চুপচাপ সাজানো টেবিল আর অতিথিদের উল্লাস দেখছে কুমু। এখনি তাকে টেবিলে ডাকা হবে। সে আজকের প্রধান অতিথি। জাতিসঙ্ঘের উচ্চ পদে চাকুরী করার কারণে লোকে তাকে যথেষ্ট সম্মান করে। দেশি বিদেশি নানা পত্রিকায় তার ছবি ছাপা হয়। কাজেই তার সাথেও ছবি তুলতে আগ্রহী অনেকে।
যে লোকটির নাম কুমু এখনো জানে না। কিংবা কখনো জানবে না। তার কারণে কুমু এখনো অতিরিক্ত একমুঠো ভাত পাতে তুলে নেয়। লোকটি আজও খাবারের সময় চুপচাপ কুমুর পাশে বসে থাকে। কুমু বিশ্বের কোটি কোটি অভুক্তদের বদলি খাদক হয়ে স্বর্গীয় সুখ অনুভব করে। যে সুখের জন্মদাতা তারই গ্রামের এক গরীব মজুর।