সেজান মাহমুদ
লেখক পরিচিতি:সেজান মাহমুদ একজন স্বনামধন্য কথাসাহিত্যিক, গীতিকার, ছড়াকার। পেশাগতভাবে চিকিৎসা বিজ্ঞানী এবং শিক্ষক। আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অব সেন্ট্রাল ফ্লোরিডা কলেজ অব মেডিসিনের সহকারী ডিন এবং প্রফেসর হিসাবে কর্মরত।
বর্ণবাদ নিয়ে ছোট বড় অনেক লেখাই লিখেছি। নিজের কাজের মধ্যেও বর্ণবাদের নানান তত্ত্ব পড়াই যেমন রেসিজম ও হেলথ, বা স্বাস্থের সামাজিক নির্ধারক ( সোশ্যাল ডিটারমিনেন্ট অব হেলথ), এরকম অনেক কিছু। সেইসব তত্ত্বকথায় না গিয়ে কয়েকটা সাধারণ পয়েন্ট উল্লেখ করি।
এক। রেস বা বর্ণভিত্তিক জাতির বিষয়টি একটি মানুষ-সৃষ্ট সামাজিক ধারণা। এর কোন বায়োলজিক্যাল বা জৈবিক ভিত্তি নেই। তারমানে মানুষের শাদা বা কালো বা বাদামি জাতি হবার জন্যে আলাদা কোন জৈবিক ভিত্তি নেই। একজন শাদাতম এবং একজন কালোতম মানুষের মধ্যে জিনেটিক পার্থক্য শতকরা একভাগেরও কম। বরং কালোতে কালোতে বা কালোতে ও বাদামিতে এই পার্থক্য বেশি শাদার তুলনায়। যা বলতে চাচ্ছি তা হলো মানুষ শাদা বা কালো হয় খুব সামান্য জৈবিক পার্থক্যের কারনে।
দুই। তবু মানুষ শাদা কালো জাতির ধারণা তৈরি করেছে নিজেদের সুবিধার জন্যে, নিজের সুবিধার জন্যে ককেশিয়ান, নিগ্রোয়েড ইত্যাদি জাতি বা রেইস বানিয়েছে। ইউরোপীয়রা শাদা হয়েছে বিবর্তনের কারণে। কিন্তু কলোনি বা উপনিবেশ তৈরির সময়ে অন্য জাতিদের আয়ত্বে রাখতে তারা এই ধারণা দেয়া শুরু করলো যে শাদারা অগ্রগামী জাতি। কালো বা বাদামিরা তাদের কে মান্য করো।
তিন। এই উপনিবেশবাদের সঙ্গে সুবিধা মতো যুক্ত হলো ধর্ম। প্রচার শুরু হলো শাদারা ঈশ্বরের পছন্দের জাতি। তা কোন কোন ক্ষেত্রে হিটলারের মতো নেতার জন্ম দিয়েছে- এমনকি দার্শনিক-বুদ্ধিজীবীদের দিয়ে বলানো হয়েছে যে শাদারা ব্লু-ব্লাড বা নীল রক্তের উচ্চ ক্ষমতার মানুষ। দাসপ্রথার জন্যে রীতিমতো বাইবেলের ধর্মীয় আয়াত বা ভার্স ব্যবহার করা হয়েছে যে কালোরা তোমাদের শাদা কর্তার কথা শোনো। শাদারা এমনকি কালোদের শাস্তি দিতে ধর্মীয় অধিকার রাখে। গির্জাগুলো জেসাসের কোন কালো প্রতিকৃতি বানাতো না, বরং সোনালি চুলের শাদা জিসাস বানিয়েছে সেই সময়ে।
চার। ষোড়শ ও সপ্তম শতাব্দীতে ইসলাম প্রচারে শাদা ও কালোর পার্থক্য না থাকার কথা জোরালোভাবে জানায় বলেই প্রচুর মানুষ ইসলাম গ্রহণ করে সেই সময়। এখনো কালোদের মধ্যে ইসলাম গ্রহণের হার বেশি হবার কারণ এটি।
পাঁচ। তারপরও ইসলাম যেমন দাসপ্রথাকে নিষিদ্ধ করতে পারেনি, তেমনি পারেনি বর্ণবাদ কে পুরোপুরি উৎখাত করতে। কোরানে উল্লেখ্য ২৫ জন রাসুল ও নবীর কেউ কি কালো ছিল? না। নবীর চেহারার বর্ণনা করতে নূর কিন্তু আলোকিত, শাদার। এমনকি হুরদের বর্ণনা করতেও সেই ফর্সা নারী, অক্ষত-যোনী, উন্নত, সুডৌল স্তন বলে নারী কে অবজেক্টিফাই বা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুরূপে উপস্থাপিত করা হয়েছে।
ছয়। এইসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রভাব দীর্ঘ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের মধ্য দিয়ে মানুষকে বর্ণবাদী করেছে। এখনও লেখক লেখেন ফর্সা পরীর মতো সুন্দর। পাত্রী খুঁজি ফর্সা, মুখের ক্রিম মাখা হয় ফর্সা হবার জন্যে।
আমার প্রতিটি কথাই প্রমাণ দিয়ে লেখা। রেফারেন্স চাইলে খুঁজে নেন। খামোখা গালিগালাজের লোকের অভাব নেই তাই আগাম বলছি। সচেতনভাবেই বর্ণবাদ এড়াতে না পারলে আমাদের মনের মধ্যে গ্রথিত দীর্ঘদিনের সামাজিক এই ব্যাধী সহজে যাবে না। তা যতোই “কালো, তবু সুন্দর” কে নিন্দা জানাই না কেন!