সেলিম এস এইচ চৌধুরী, সংবাদপত্রসেবী, নাট্যজন ও সাংস্কৃতিক সংগঠক, কানাডা।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী প্রজন্মের স্বর্ণযুগ প্রায় শেষ, ইতোমধ্যে আমাদের সংস্কৃতি চর্চা অনেক দূর এগিয়েছে। পাকিস্থানী বা পরাধীনতার জগদ্দল পাথর সরে যাবার পর আমাদের সংস্কৃতি মুক্ত বায়ধুতে নিঃশ্বাস নেয়া শুরু করে। ঘাত প্রতিঘাত অতিক্রম করে তা অনেক দূর এগিয়ে গেছে। যার শক্ত ভীত রচনা করে দিয়ে গেছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান, ১৯৭৪ সালে এক অর্ডিনেন্স এর মাধ্যমে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি প্রতিষ্ঠা করে। যাকে কেন্দ্র করে আমরা
সাংস্কৃতিক কর্মীরা বাংলাদেশ সংস্কৃতির দৃঢ় ভিত রচনা করে চলেছি। সেদিন বাংলাদেশ স্বাধীন না হলে আজকের যারা আমাদের সংস্কৃতির ধারক বাহক তাঁরা কে কোথায় কোন অবস্থানে থাকতেন তা বলা মুশকিল হত।
সংস্কৃতির বিভিন্ন ধারার মধ্যে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে দৃষ্টি গোচর হওয়ার মত ত্বরিৎ উন্নয়ন দেখেছি আমরা নাট্যাঙ্গনে। এটা সম্ভব হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের কল্যাণে, আমাদের তৎকালীন নবপ্রজন্ম যারা বিদেশে বিশেষ করে ভারতের অগ্রসরমান সংস্কৃতির সংষ্পর্শে আসার সুযোগ পেয়েছিলেন তাঁদেরই নেতৃত্বে। ঐ সময়ে যৌবন উদ্দীপ্ত সংস্কৃতিবান একদল মুক্তিযোদ্ধা দেশে ফিরে এসে নব সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তুলতে স¶ম হন। যে হাতে অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করেছিলেন সে হাতে আধুনিক নাট্যমঞ্চ গড়েছিলেন। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ অনেক গ্রুপ থিয়েটারেরও জন্ম হয়। আইটিআই বাংলাদেশ কেন্দ্রের মাধ্যমে আর্ন্তজাতিক অঙ্গনেও বাংলাদেশের নাটক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন প্রচুর সুনাম কুড়িয়ে চলছে। আমাদের সাংস্কৃতিক অভিবাবক রামেন্দু মজুমদার পরপর কয়েকবার আইটিআই আন্তর্জাতিক কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন যা বাংলাদেশকে অনেক সম্মানের আসনে প্রতিষ্ঠিত করে।
এভাবে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গন বেগবান হয়ে গতি প্রাপ্ত হয়েছে, তবে স্বাধীনতার এত বছরে যে গতিতে বহমান হওয়া উচিত ছিল তা হয়নি। কারণ স্বাধীনদেশে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে যে সাংস্কৃতিক চর্চা আরম্ভ হয়েছিল তা মাঝপথে বারবার স্বাধীনতা বিরোধী ও সৈরাচারের কালো হাতের থাবায় ছিন্নবিছিন্ন হয়েছে। কিন্তু তরুন উদ্যোমী আদর্শবান সাংস্কৃতিককর্মী ও তাদের নেতৃত্বদানকারীদের দৃঢ়তার কাছে তা সফল হয়নি। সাংস্কৃতিক আন্দোলনের বিভিন্ন ফোরাম বিশেষ করে বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান, বাংলাদেশ পথনাটক পরিষদ, সঙ্গীত সংগঠন সম্বয় পরিষদ, গণসঙ্গীত সংগঠন সমš^য় পরিষদ, নৃত্য শিল্পী সংসদ, চারু শিল্পী সংসদ, আবৃত্তি সমš^য় পরিষদ, লোক শিল্পী সংসদ, বাউল শিল্পী ফেডারেশনসহ তাদের নেতৃত্বদানকারী সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট এর সফল পদচারণায় আমাদের সাংস্কৃতিক অঙ্গন সরব ও সোচ্চার রয়েছে। তাই ¯^াধীনতার ফসল সাংস্কৃতিক অঙ্গনের বিশাল অর্জনকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করে এমুহূর্তে তাকে এগিয়ে নিয়ে যাবার মহান দায়িত্বটি রাষ্ট্রযন্ত্রের ও তার পরিচালকদের। সেই সাথে সুচিন্তিত পরিকল্পনা ও কর্মপরিচালনা অত্যন্ত জরুরী, না হলে এর সাথে সাথে দেশের পরিকল্পিত উন্নয়নও ব্যাহত হবে। একটি ¯^াধীন দেশে সঠিক ও সাবলীল সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডই দেশকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে সম্মন্মিত পরিকল্পনার মাধ্যমে সার্বিক উন্নয়ন অবকাঠামো কখনও তৈরি এবং বাস্তবায়ন করা হয়নি। যা গত কয়েক বছরে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর ঐকান্তিক প্রচেস্টায় ও তাঁর দূরদর্শী ভাবনায় শুরু হয়ে গেছে। জাতির জনকের আদর্শ ও ভাবনাগুলো আলোর পথে হাঁটতে আরম্ভ করেছে। শিক্ষা, যোগাযোগ, উৎপাদন, প্রশাসন, অথনৈতিক, জীবনধারা, মানবসম্পদ, প্রযুক্তি ও পরিবেশ সকল পর্যায়ে সার্বিক উন্নয়ন অবকাঠামো তৈরি ও কর্মকান্ড চলছে। এই ধারাকে সচল রেখে ২০২১ এর ল¶্যে পৌঁছানোর জন্য একটি ক্রিয়াশীল সাংস্কৃতিক বিপ্লব ঘটিয়ে সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে মানব সম্পদে পরিণত করতে হবে। বাংলাদেশের সঠিক ইতিহাস সর্বস্তরের জনগণকে জানাতে এ মুহূর্তে ব্যাপক সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড সংগঠিত করার বিকল্প নেই, যা দেশের অগ্রসরমান সাংস্কৃতিক ব্যক্তি, সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানই পারে। ২০২১ সালের ল¶্য বাস্তবায়ন করতে হলে আর কালক্ষেপণ করা যাবে না।
উন্নতদেশে নতুন কোন পরিবর্তন বা সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের শিক্ষাথীদের যারা কিছুদিন পরেই দেশের সর্বস্তরে সম্পৃক্ত হবে, তাদের মাধ্যমে সরেজমিনে জরিপ করে তা জনমত তৈরির জন্য মডেল প্রজেক্ট আকারে পরী¶া করা হয়, তার পর চ‚ড়ান্ত বাস্তবায়ন করা হয়। তাই সমগ্র জনগোষ্টীকে আধুনিক চিন্তায় সম্পৃক্ত করতে না পারলে উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদী সফলতা পাওয়া যাবে না। সর্বস্তরের জনগণের সাথে যোগাযোগের সহজ মাধ্যম সংস্কৃতি, যা তার মনের অজান্তেই গভীরে নাড়া দিতে স¶ম। ৪/৫ ঘণ্টা সমাবেশ, বক্তৃতা দিয়ে যা বোঝানো সম্ভব না তা মাত্র ৩০/৪০ মিনিটের নাটক/গান/কবিতায় দলমত নির্বিশেষে মানব মনের গভীরে গ্রোথিত করা সম্ভব। সংস্কৃতি মানুষকে উদ্দীপ্ত করে কর্মোদ্দীপনা সৃস্টি করে তাই এ মুহূর্তে গ্রাম পর্যায়ে ব্যাপক সাংস্কৃতিক অবকাঠামো তৈরী ও চর্চার মাধ্যমে ¯^ল্পতম সময়ে ল¶্যে পৌঁছানো যেতে পারে। এ জন্য অবশ্য কিছু গবেষণা প্রয়োজন যা পূর্বাহ্নেই সম্পন্ন করতে হবে।
আমরা সব সময়ে ল¶্য করেছি দেশের ক্রান্তিলগ্নে, সংকটে, দূর্যোগে সর্বশেষ ভরসা হিসেবে সাংস্কৃতিককর্মীরা সবসময় অগ্রগামী, মানুষের ভেতরের মানুষটিকে উজ্জীবিত করে প্রচন্ড কর্মোদ্দীপনা সৃস্টি করতে পারে এঁরা। তাই সামাজিক ও মানবিক উন্নয়নের জন্য সাংস্কৃতিককর্মীদের সঠিক পথে ব্যবহার করে দেশকে স্থায়ী উন্নয়নের পথে নিয়ে যাওয়া জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্ব। পবিত্র মুক্তিযুদ্ধের ফসল আমাদের অগ্রজ সাংস্কৃতিক নেতৃত্ব ও প্রিয় প্রধানমন্ত্রী যিনি দেশের জন্য নিজ জীবন উৎসর্গ করেছেন তাঁর নিকট নবীন
সাংস্কৃতিককর্মীদের অনেক প্রত্যাশা। তাদের যথাযথভাবে সম্পৃক্ত করে বাংলাদেশকে
পৃথিবীতে চলমান উন্নয়নের ঈষর্নীয় দৃস্টান্ত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা।
দেশের ধনাঢ্য ব্যক্তি ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানসমূহকেও সামাজিক দায়িত্ব হিসেবে সরকারের সাথে সমান তালে এগিয়ে আসতে হবে সাংস্কৃতিক উন্নয়নে। পাশের দেশ ভারত তার বড় দৃষ্টান্ত, তারা যেভাবে সংস্কৃতির পৃষ্টপোষকতা করে তা অনুকরণীয়। তাই সে দেশে গুণীজনের অনেক কদর।
রাজনৈতিক দেউলিপনা থেকে মুক্তি পেতে হলে সংস্কৃতির চর্চা বাড়াতে হবে। গুণীজনের সম্মান দিতে হবে, মূল্যায়ন করতে হবে রাষ্ট্রীয়ভাবে।
বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সকল শি¶া প্রতিষ্ঠানসমূহে পরিকল্পিত ও বাধ্যতামূলকভাবে সাংস্কৃতিক শি¶া ও চর্চা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন যা শি¶ার্থীমনে একবার গ্রোথিত হলে পরবর্তীতে সে আপন গতিতে ¯^শি¶িত হবে।
সকল দূতাবাসে বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক কেন্দ্র পরিচালনা করে বাংলাদেশের কৃস্টি, সংস্কৃতি, দেশের মহান নেতা ও গুণীজনদের জীবন চর্চা বর্হিবিশ্বে পরিচিত করতে হবে যা ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ তাদের দূতাবাস কেন্দ্রিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের মাধ্যমে করে থাকে। এতে প্রবাসী বাংলাদেশীরাও দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন
থাকতে পারবে না, তাদের পরবর্তী প্রজন্ম দেশীয় সংস্কৃতির রস আ¯^াধন করে নিজেদের সমৃদ্ধ করতে পারবে। প্রমিত বাংলা চর্চাও সম্ভব হবে, অন্যথায় তাদের নিকট থেকে আমাদের ভাষা হারিয়ে যাবে। এখানে কানাডা প্রবাসী ¯^ল্পদৈর্ঘ প্রমাণ্য চিত্রনির্মাতা নাদিম ইকবালের “মাদার টাং” ছবিটি উদহারণ ¯^রূপ উল্লেখ করা যেতে পারে, যা ইতোমধ্যে ৭টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার অর্জন করেছে। বিশ্বের ১৭ দেশে প্রদর্শিত হয়েছে। বাংলাদেশে সরকারী উদ্যোগে ব্যাপক প্রদর্শনী করে এর দ্বারা নতুন প্রজন্মকে মাতৃভাষার চর্চায় উদ্দীপ্ত করা যেতে পারে। ২০২১ সালকে কেন্দ্র করে নতুনদের হাতে সংস্কৃতির ঝান্ডা তুলে দেবার ও দেশের সঠিক সাংস্কৃতিক ইতিহাস রচনার উপযুক্ত সময় এখনই।