দেলওয়ার এলাহী
এমন একটি দেশ আর কোথাও নেই৷ এমন একটি দৃঢ়চিত্ত জাতি-রাষ্ট্র আর জন্ম নেয়নি পৃথিবীতে। এমন নদী বিধৌত সবুজ ভূমি, এমন সারিবদ্ধ বলাকা উড়ে যাওয়া সুনীল আকাশ, এমন পানি থৈথৈ হাওর ঘেরা গ্রাম, এমন কাশবনের পাশ দিয়ে যাওয়া ট্রেনের হুইসেল; আর কোথাও নেই! এ আমাদেরই ৫৭ হাজার বর্গমাইলের দেশ। বাংলাদেশ। আমাদের সোনার বাংলা।
যে দেশের মানুষ ‘আমার সোনার বাংলা / আমি তোমায় ভালোবাসি’ জাতীয় সংগীতটি গাইতে গাইতে চোখের পানিতে বুক ভাসায়। যে দেশের মানুষ তাদের মাতৃভাষা রক্ষা ও প্রতিষ্ঠার জন্য অকাতরে প্রাণ উৎসর্গ করে। যে দেশের মানুষ শহিদ স্মৃতিতে- ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশের ফেব্রুয়ারী, আমি কি ভুলিতে পারি’- গাইতে গাইতে ধর্ম বর্ণ ভুলে এক কাতারে দাঁড়ায়।
ভাষা শহিদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এ এমন একটি সুর, এমন একটি গান, যা শোনামাত্র রাঙালি তার আত্মপরিচয়ের দৃঢ়চিত্ত ভাবনায় গৌরবদীপ্ত হয়ে উঠে। তিরিশ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের স্বাধীনতার বিরোধীরা বাংলাদেশের স্থিতিশীলতাকে ক্রমে ক্রমে বিঘ্নিত করেছে। স্বাধীনতার মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করেছে। স্বাধীনতার বিরোধী ঘাতক দালালদের হাতে ক্ষমতাকে বন্টন করে দিয়েছে। তবু, এইসব কালো হাতের থাবাকে ছিন্ন করে বাংলাদেশ তার নির্ধারিত পথে সমুখে এগিয়ে গিয়েছে।এমনকি বাংলাদেশের মানুষ বিশ্বের নানা দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন। তাদের বুকেও লালন করা আছে আব্দুল গাফফার চৌধুরী লিখিত ও শহীদ আলতাফ মাহমুদকৃত সুরে বাঙালির গৌরবময় অবিস্মরণীয় ঠিকানা। শহিদ মিনার আমাদের এমন একটি সত্যিকার অসাম্প্রদায়িক ঠিকানা, যেখানে সকলে একই ভাবনায় দেশপ্রেমের প্রেরণায় বলিয়ান হয়ে উঠি।
টরন্টো প্রবাসী বাংলাদেশী কমিউনিটি দীর্ঘদিনের লালন করা একটা স্বপ্ন আজ বাস্তবায়নের দ্বারপ্রান্তে। বাঙালির অসাম্প্রদায়িক দেশপ্রেমের গৌরবময় ঠিকানা শহীদ মিনার এখন টরন্টোর ডেন্টোনিয়া পার্ক সংলগ্ন মাঠের কিনারে নির্মাণাধীন। দুই হাজার একুশ সালে বাংলাদেশের পঞ্চাশ বছর পূর্তিকালীন অমর একুশের প্রথম প্রহরে টরন্টো প্রবাসী বাঙালিরা শহিদ বেদীতে ফুল দেবেন৷ শহিদদের স্মরণে শ্রদ্ধা জানাবেন। বাঙালি জাতির ঐতিহ্য-সংস্কৃতি রক্ষা করে ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক স্বাধীন বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার যার যা কিছু করার সংকল্পে দৃঢ় হবেন। আজকের এই সাফল্যে আমি টরন্টোয় শহিদ মিনার স্থাপনার জন্য নিরন্তর কাজ করে যাওয়া সংগঠন Organisation Of Toronto International Mother Language Day Monument Inc. কমিটিকে অভিনন্দন জানাই। ধন্যবাদ জানাই। কৃতজ্ঞতা জানাই। ধন্যবাদ জানাই কমিটির সঙ্গে যুক্ত সবাইকে কমিটির সবাইকে। কমিটির বা এই প্রকল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতিও আমার অভিনন্দন। অভিবাদন। অভিবাদন ও অভিনন্দন জানাই সমগ্র টরন্টোবাসীকে। এই সাফল্য সমগ্র টরন্টো কমিউনিটির। অভিনন্দন জানাতে আমি OTIMLDM-এর প্রেসিডেন্ট ম্যাক আজাদের সঙ্গে যোগাযোগ করি।
ধন্যবাদ জানিয়ে ম্যাক আজাদ বলেন- ‘এই সাফল্য সমগ্র টরন্টো কমিউনিটির। সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা আমাদেরকে উৎসাহদাতার। দশ বছরের শিশু থেকে অশীতিপর বৃদ্ধের। কানাডা থেকে বাংলাদেশ পর্যন্ত। দশ হাজার ডলার থেকে শুরু করে বিশ ডলার দিয়ে যারা এই মহতী কাজে অংশগ্রহণ করেছেন, এই সাফল্য তাদের। আমরা সবাইকে অভিনন্দন জানাই, শুভেচ্ছা জানাই, কৃতজ্ঞতা জানাই। ম্যাক আজাদ আরো বলেন – বাঙালির গৌরবময় ঠিকানা শহিদ মিনারকে সামনে রেখে বাংলাদেশী কমিউনিটির ভাইবোনেরা, আমরা যেন এক থাকতে পারি৷ আমাদের মধ্যে ছোটখাটো বিষয় নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি হলেও কমিউনিটির স্বার্থে যেন আমরা সকলে মিলে একসাথে কাজ করি।’
২. একুশের প্রথম প্রহরে তীব্র শীত উপেক্ষা করে যখন টরন্টোয় আমার ভাই বোনেরা শহিদ মিনারে ফুল দিতে যাবেন, আমি তখন থাকবো বাংলাদেশে। মাতৃভূমিতে। মুমূর্ষু মায়ের কাছে। এই শহরে স্থাপিত শহিদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাবেন আমার বন্ধুরা। শারীরিকভাবে না থাকলেও আমি থাকবো তাদের সাথেই। দেশপ্রেমের প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে যেমন থাকি, একসাথে। গতকাল শেষ বিকেলে ডেন্টোরিয়া পার্ক সংলগ্ন মাঠের পশ্চিম পার্শ্বে নির্মাণাধীন শহিদ মিনার দেখত গিয়েছিলাম। ডিসেম্বরের ১১ তারিখ হলেও শীতের তীব্রতা ছিল না। আকাশ ছিল মেঘমুক্ত। পরিস্কার। পশ্চিম আকাশে হেলে পড়া সূর্যের কিরণ এসে রাঙিয়ে দিচ্ছিল মিনারের চূড়া। মিনারের বাহুর ফাঁক গলিয়ে আলো এসে পড়েছে আমার চোখে মুখে। আগামীদিনের সূর্য রাঙা সাফল্যমণ্ডিত বিশ্ব বাঙালির অগ্রিম বার্তার রশ্মি যেন এই সূর্যের আলো। ‘৫২ ও ‘৭১ এর স্টেথোস্কোপ লাগিয়ে বুকের গভীরে থাকা বিশ্বাসের কথাগুলো একবার শুনুন; আপনিও বুঝতে পারবেন।
ছবি : দেলওয়ার এলাহী