মরণবাহী জীবানু ঘুরছে অবাদে এখনো হাতের তালুতে মৃত্যু, হাত মেলানো যাবে না। যমদূত দাঁড়িয়ে দরজার ওপারে মানুষের কোন ভূলের অপেক্ষায়। তাই ভূল করা চলবেনা, তবে জীবন চলবে, যাপন অতিবাহিত হবে অনিশ্চয়তার ঘড়ির কাটার সাথে টিক টক, টিক টক। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়ে রেখেছে, সামাজিক দুরত্বে আর সন্তুষ্ট থাকা যাচ্ছে না তাই এখন শারীরিক দুরত্ব সয়ে যাওয়া ঝুঁকি এড়াতে। একটা উষ্ণ আলিঙ্গনের জন্য আরো অনেকদিক অপেক্ষা করতে হবে যতদিন না বিজ্ঞান জিতে যাবে আর জীবানু মারা পড়বে।
স্তব্ধতা কে দেহে নিয়ে শুয়ে আছে পৃথিবী যেন শক্তি সেল বুকে নিথর দেহের লক্ষ্মণ। হনুমান গেছেন বিশল্যকরণীর খুঁজে গন্ধ মাধব পর্বতে; মহৌষধী ছাড়া কিছুতেই দেহে প্রাণ ফেরানো সম্ভব নয়। কানাডা জুড়ে ছিয়ানব্বই জন গবেষক কাজ করে চলেছেন ট্রান্সমিশন কে ধীরলয়ে আনতে এবং ভেক্সিন তৈরি করতে যার জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে ৫২.৬ মিলিয়ন ডলার। সমাধান চাই রাজকোষ তথৈবচ। জান হেই তো জাহান হে।
এই ব্যের্থ চল্লিশের শেষে মন উদগ্রীব হয়ে সকাল হয়। এই বুঝি সি,বি,সি কিংবা সি,এন,এন কেউ চেঁচিয়ে বলবে পেয়েছি আর সভ্যতা দাঁড়াবে নতজানু হয়ে বিজ্ঞানের কাছে। আমার ব্যাকইয়ার্ডের বারান্দায় উঁকি দিয়ে দেখলাম লাউয়ের মাচা, সেও তৈরি হচ্ছে লতাকে বুকে জড়িয়ে সবুজ করে তুলবে একদিন আমার সকাল। আকাশের দিকে মুখ তুলে দাঁড়াতেই, খোলা চিঠির মত বেদনাবিধুর সংলাপ বলে গেল, সব কিছুই মনেরাখা হবে। যেন আমি দেখছি ইটালির লভিয়ারের হাসপাতালে অনেক বৃদ্ধের মাঝে শুয়ে থাকা যুবক পাঞ্জা লড়ছে মৃত্যুর সাথে, পাশের বেডেই ছিল ৭২ বছরের পাদ্রী যুসেপ্পি বেড়ারডেলি। রেসপিরেটর নিয়ে ও যখন তিনি বুঝতে পারলেন টিকে থাকার মত অনাক্রমতার শক্তি তাঁর জিনে নেই, তাঁর রিসপিরেটর পাশের বেডের তরুণ ছেলেটির জীবন বাঁচাতে পারে। বেড়ারডেলি জীবন কে সেক্রিফাইস করে গেলেন, অন্যকে বাঁচার সুযোগ দিয়ে। চলে গেলেন একটা আত্মবিশ্বাস নিয়ে যে সভ্যতা তাঁরা গড়ে তুলেছেন তিলে তিলে, ঐ তরুন ছেলেটি বেঁচে উঠবে,যেন আমরা সবাই মিলে পৃথিবীকে ভালো রাখতে পারি। এর জন্য বাঁচতে হবে আমাদের, মানুষের হাতে মারণব্যাধির ধ্বংস লেখা পর্যন্ত।
আজকের তারিখ পর্যন্ত এক লক্ষ তেতাল্লিশ হাজার লোক চিকিৎসা পরিষেবা নিয়ে ভাইরাস মুক্ত তবে এখনো পর্যন্ত আক্রান্ত ছয় লক্ষ বাইশ হাজার দুশো ছাব্বিশ। এই আক্রান্তের সংখ্যা স্লথ গতি করতে আমরাই আমাদের সহায় সামাজিক ও শারিরীক দুরত্ব মেনে চলে। এর জন্য আমার-আপনার স্বাধীনতা কে একটু সেক্রিফাইস করতেই হবে। নিরাপদে থেকে যে কাজটি আপনার সাধ্যের ভিতরে সেটিই করুণ। অনেক স্টুডেন্ট আছেন এই দুর্যোগে অনলাইন কোর্স করছেন, যা দৃষ্টান্ত।
কেউ করোনা নিয়ে যত রকমের পথ্য-টুটকা ভাসছে তা শেয়ার দিয়ে যাচ্ছেন, তারাও জানেন প্রত্যেকটি দেশই বিশ্ব স্বাস্থ সংস্থার পার্টনার হয়ে কাজ করছে, প্রতিটি দেশের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর তা প্রচার করছে কেবল তাদের এবং তাদের কেই শোনা উচিৎ। টরোন্টতে সিটির দায়িত্বরত অত্যন্ত কাবিল এবং ইতিমধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয় স্বাস্থ্য অফিসার আইলিন ডি ভেলা ব্রিফ করছেন প্রতিদিন। আমরা যদি ডাক্তার, নার্স সহ সমস্থ ফ্রন্ট লাইনারদের এফর্ট কে সত্যিকার সম্মান করি তবে নির্ভরযোগ্য তথ্য নেই এমন ভি,ডি,ও ও রেসেপি ভাইরাল থেকে বিরত থাকা উচিৎ।
যারা পথ্য- টুটকা শেয়ার করে চলছেন, আপনি ইনফোডেমিক দ্বারা আক্রান্ত এর থেকে ও বের হওয়া খুব সহজ কাজ নয়। মানুষ অভ্যাসের দাস সেটা ছিলো আমাদের মায়ের জীবনে, এখন আমরা অভ্যাসের গোলাম। তবে তা পজেটিভ ওয়েতে ও করা যায়। মহামারি কে পুঁজি করে যদি কেউ ক্ষমতার অপব্যাবহার করে, কোন দরিদ্র মজুর মাস্ক বিহিন ভ্যানে বসে থাকার আপরাধে, তাকে কান ধরিয়ে ছবি তুলে পোষ্ট দেয় কোন আমলা, ভাইরাল করুন এইসব অমার্জনীয় ধৃষ্টতা যতক্ষণ না দায়িত্বশীলদের নজরে আসে। এই অফুরন্ত সময়, আমদের বদভ্যাস কে সঠিক রাস্তার দিশা দিতে পারেন আপনিই। এই সদিচ্ছা জাগ্রত হলে কাজের নিশানা অনেক, আর অলসতা আর অভ্যাসের গোলামি করতে চাইলে বাহানা অনেক।
যে বা যারা মানুষের ধর্মিয় বিশ্বাস, ট্রেডিশান দেখে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠি তারা কি বুঝি যে অন্ধবিশ্বাস আপনার-আমার তির্যক মন্তব্যে একঝটকায় বিজ্ঞানের কাছে আত্মসমর্পণ করবে না, বরং ঘৃণা ছুঁড়া-ছুঁড়িই হবে। একটা রাতের শেষ দেখতে ও ভোর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। তাহলে কি কিছু বলা যাবে না? অবশ্যই বলা যাবে তবে রিয়েক্ট না রেসপন্ড করি চলুন। ইতি টানি প্রবাস থেকে বাংলাদেশে যাওয়া আমার এক বন্ধুর সাথে কথোপকথনের অভিজ্ঞতা দিয়ে।.
ফেইসবুকের কল্যাণে জানলাম মাঈনুল(ছদ্মনাম) এখন কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে। ইট-কাঠ-পাথরের বিলাত থেকে ফিরেছে সপ্তাহ দুই আগে, নিয়েছে স্বেচ্ছাবন্দীত্ব। সৌভাগ্যক্রমে পেয়ে গেলাম হোয়াটসঅ্যাপে। বললো দীর্ঘ তেরো বছর পর তাঁর ঘুম ভাঙে এখন আজানের সুরে। বাড়ির পেছনে সর্শে ক্ষেত কখনো বাড়ির সিমানা পর্যন্ত দু-কদম এগিয়ে যায়, বাতাসে এলিয়ে আসা সর্শে ক্ষেতের ঢেউয়ের সাথে আলিঙ্গন করে আসে। ফেরার পথে মা তখনো দাওয়ায় বসে, করছেন কোরান তেলওয়াত। মা আর সন্তানের তের বছরের বিচ্ছেদ আমনে সামনে কিন্তু মমতার এই দুরত্বটুকুতে ছেদ পড়েছে। লক্ষ্মণ রেখা এঁকে দিয়েছে মরণব্যাধি জীবানু। হাসি চোখে মা তাকায় ঠিক বুঝেন ও না কি হচ্ছে পৃথিবীতে, শুধু এটুকু বোঝেন পরিবার সমাজের ভালো আর ছেলের কল্যাণে এই বিচ্ছেদ মেনে নিতে হবে। ১৪ দিন অশৌচ পেড়িয়ে ছেলেকে কুলে তুলে নেবেন পরম মমতায়। তাই মাঈনুল মায়ের মুখ দেখে দুর থেকেই। দুজনের ভালবাসা বাসি এখন মৌনতায় খুঁজাখুঁজি আর আয়াতের সুরের ইঙ্গিতে বুঝা-বুঝি। ঘরে বসে জানলা দিয়ে, সুপাড়ি বাগানের ফাঁকে দেখা রুপালি চাঁদ তার উদাসিতায় কোন দাওয়া দিতে পারে না। শত মানা করেও তাঁর ছোট ভাইকে শুক্রবার মসজিদে যাওয়া থেকে বিরত রাখতে পারেনি, ভাই রাকিবের উত্তর মসুলমানদের এই রোগ হয় না। মাঈনুল বলেছে ইরানের কথা, নিউইয়র্কে আমাদের বাংলাদেশিদের কথা, ভাইটি সিদ্ধান্তে অবিচল থেকে জানালো এরা মসুলমান না।
আমাদের কথোপকথনে তাঁর আওয়াজ ভারি হয়ে উঠছিল, সান্ত্বনা দিয়ে বললাম বন্ধু, কেতাবি ভাষার বাইরে একটা ভাষা আছে আমাদের অঞ্চলে অঞ্চলে যে ভাষায় ওয়াজ হয়, যে ভাষায় গরু-গোবরের গল্পে মানুষ এখনো বিশ্বাস করে, কিছু কুসংস্কার তো কিছু ধর্মীয় মিথ। এ জাতিয় ভাষা ও গল্পদিয়েই তাদের বোঝাতে হবে। সে যে বিশ্বাস বা গল্পে অবিচল, গল্পের পরেও তো গল্প থাকে। আইয়ুব নবীর কুষ্ঠ হলে তাঁকে আর স্ত্রী রহিমা বিবিকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল গ্রাম থেকে যদিও তা শয়তানের প্ররোচনায়। ধর্মীয় অন্ধত্বে তলিয়ে যাওয়া মানুষ গুলিকে আইয়ুব নবীর জীবনী সচেতন করে তুলতে পারে। যেটা ভাষার তির্যকতার বিষে কখনোই কাজ হবে না অন্তত আমাদের দেশে। আর সাথে থাকতে হবে সরকারের কঠোর দিকনির্দেশনা ও কঠোর অবস্থান। ভ্যেন চালক বৃদ্ধ আর মুসুল্লির জন্য, আইনি প্রয়োগ দুইরকম হতে পারে না। কঠিন হোন তবে সহমর্মিতা নিয়ে।
“মানা হে আন্ধেরা, দিপ জ্বালানা কাহাকা মানা” আঁধার চারিধার সবার জানা, তবে বাতি জ্বালাতে নেই কোন মানা।
হিমাদ্রী রয় সঞ্জীব।