আক্তার হোসেন, নাট্যকার, কলামিস্ট, টরন্টো, কানাডা।
আসুন সকলের জন্য ভাবি, সকলের কথা বলি। সকলে মিলেমিশে একটি দিন উদযাপন করি। পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেনি বটে, তবে কোন দিনটিকে কেন্দ্র করে সে সূর্য দেখা যাবে সেটা খুঁজে পাওয়া গেছে।
বেশ কয়েক বছর থেকে বলে আসছি কানাডা সরকার যেন একুশে ফেব্রুয়ারিকে সরকারী ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা করে। মন্থর গতিতে হলেও এ প্রসঙ্গে কানাডার একাধিক প্রধানমন্ত্রীসহ বিভিন্ন সময়ের হেরিটেজ মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, প্রাদেশিক পরিষদের সংসদ সদস্যসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগাযোগ চালিয়ে যাচ্ছি। বাংলাদেশের বাইরে যদি অন্য কোন দেশ থেকে সরকারী ছুটি পাওয়া যায় তবে, ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’র গোটা চিত্রই বদলে যাবে। তারপর ধীরে ধীরে আমরা এগিয়ে যেতে পারবো ‘একুশে ফেব্রুয়ারিকে ঘিরে একটি ‘বিশ্ব ছুটি দিবসে’র দিকে।
যেদিন কানাডা বা বিশ্বের অন্য কোন দেশ একুশে ফেব্রুয়ারিকে মানে আন্তর্জাতিক
মাতৃভাষা দিবসকে ছুটির দিন ঘোষণা করবে সেদিন থেকেই গড়াতে থাকবে বিশ্ব ছুটি দিবসের চাকা। মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার আদায় করতে গিয়ে ১৯৫২ সালে বাংলাদেশের সন্তানদের জীবন দিতে হয়েছিল। নজির বিহীন সেই ঘটনার উৎস ভ‚মি বাংলাদেশের দিকে এখন বিশ্বের নিপীড়িত, নির্যাতিত, উৎপীড়িত জনগোষ্ঠীর দৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে অধিকার বঞ্চিত মানুষগুলো আজ প্রেরণা পাচ্ছে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের কথা এখন পুরো দুনিয়ায় বলাবলি হচ্ছে। কাজেই আন্তর্জাতিক
মাতৃভাষা দিবসের প্রাপ্তির অংশগুলো আজ অন্যদের মধ্যে বিলিয়ে দেবার কিংবা অধিক প্রচার করার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে।
‘ভাষা আন্দোলন’ এবং তারই ধারাবাহিকতায় ‘ভাষা দিবস’ বাংলাদেশের নিজ¯^ একটা ঘটনা সে কারণে বাংলাদেশ সরকার মাতৃভাষা দিবসকে কেন্দ্র করে একটি ছুটির দিন ঘোষণা করেছে সেটা ¯^াভাবিক পরিক্রমার মধ্যেই পরে। তাই বলে অন্য দেশ বিশেষ করে পুঁজিবাদী কোন দেশ কোটি কোটি টাকা লোকসান দিতে অতিরিক্ত একটি কর্ম বিহীন দিনের কথা কেন চিন্তা ভাবনা করবে? কথা হল, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের সুফল বিশ্বের সমগ্র মানব জাতির মাঝে ছড়িয়ে দিতে হলে বাংলাদেশের বাইরের অন্য কোন জাতিকেও এগিয়ে আসতে হবে। শুধু এগিয়ে এলেই চলবে না, স্পষ্ট করে বলতে হবে মানব সভ্যতার সব চেয়ে বড় সম্পদ ‘মানব ভাষা’ যা কিনা অন্যান্য প্রাণী জগত থেকে আমাদের আলাদা হতে সাহায্য করেছে, সেই ভাষার বিপদ কালে মানবগোষ্ঠী প¶ থেকে সব জাতির প্রতিনিধি হয়ে বাঙালিরা যে মহানুভবতা দেখিয়েছিল সেটা ছিল দৃষ্টান্তমূলক ঘটনা। তার থেকে প্রাপ্ত মুনাফা গোটা মানব জাতির কল্যাণে লাগাতে হবে। রক্তের দামে অর্জিত মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার আদায়ের প্রতীক মাতৃভাষা দিবসকে সরকারি ছুটির দিন ঘোষণা করে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশই পারে বিশ্বে মানব ভাষার অস্তিত্ব লড়াইয়ে সাথি হতে।
সভ্যতা কারো একার হাতে গড়ে উঠেনি। মানব জাতির এগিয়ে চলার সংগ্রামে কেউ কখনো হয়তো আবিষ্কার করেছে নতুন নতুন পদ্ধতি, কেউ করেছে নির্মাণ কাজ, কিংবা দিয়েছি প্রযুক্তি। কেউ বা কোন কিছু না গড়ে বুকের রক্ত দিয়ে করে গেছে প্রতির¶ার কাজ। অথচ সভ্যতার প্রতিটি প্রাপ্তিতে রয়েছে সকলের সমান অংশ। ১৯৫২ সালের এক মহান ঘটনা বিশ্ব তাৎ¶নিকভাবে কিছুই জানতে পারেনি। এমন কি আশপাশের দেশগুলোর কাছেও কথাটা ছড়িয়ে পড়েনি। হিরোশিমা নাগাসাকি কিংবা শিকাগো শহরের শ্রমিকদের আত্মাহুতির কথা যেমন করে ছড়িয়ে পরেছিল ঠিক তেমন করে বিশ্বের সর্বত্র সালাম, রফিক, বরকতদের রক্ত ঝরানো দিন এবং ভাষার গানও কণ্ঠে তুলে দেয়া খুব প্রয়োজন ছিল। যেমন বিশ্বের সব দেশেই কণ্ঠে তুলে নিয়েছিলাম ‘আমরা করবো জয়’ গানটি। তাতে যে লাভটা হত তাহলো, মানব জাতির আরো কিছু ভাষা হয়তো ধ্বংসের হাত থেকে বেঁচে যেত পারত। ভাষা সংগ্রাম বলে একটা বিপ্লব আছে সেটাও প্রথিত হতো।
১৯৫২ সালে খোদ ঢাকা শহরের কিছু কিছু মানুষ ভেবেছিল ২১শে ফেব্রæয়ারির ঘটনাটা ছিল নেহায়েত ছাত্র-পুলিশের দ্ব›দ্ব। অথচ দেখুন, ১৯৫২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গুলি ও হত্যার ঘটনাকে কেন্দ্র করে আজ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলে ফুল নিয়ে স্থায়ী-অস্থায়ী শহিদ মিনারে যাচ্ছে। বাঙালি না হয়েও কেউ কেউ কণ্ঠ মিলিয়ে গাইছে “আমি কি ভুলিতে পারি”।
এবার বলছি বিশ্ব ছুটি দিবস প্রসঙ্গে। এখন পর্যন্ত একটি নির্দিষ্ট দিনকে কেন্দ্র করে বিশ্বের সকল রাষ্ট্র একত্রে ছুটি উপভোগ করে না। কিছুকিছু দিন আছে যেমন ক্রিস্টমাস, ১ জানুয়ারি বা শ্রমিক দিবস এগুলোসহ ধর্ম
সংস্কৃতি জাতীয়তাবাদসহ বিভিন্ন সময়ে বিশ্ববাসী বিভিন্ন দিনে ছুটি কাটায়। বিশেষ দিনের ছুটির সুবিধা হল, সরকারি ছুটিকে উপল¶ করে ঢালাওভাবে সেই দিনের মহিমা ও তাৎপর্য প্রচার করা হয়। ছুটিকে কেন্দ্র করে উৎসব-আনন্দ, আলোচনা-সচেতনতা বৃদ্ধি পায়। ফলে আমরা সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো নিয়ে সস্পৃক্ত হয়ে উঠি। এ ভাবেই তৈরি হয় একতা ও শক্তি।
একটাই যদি বিশ্ব হয়, একটাই যদি জাতিগোষ্ঠী হয়, আর তার নাম হয় মানবগোষ্ঠী। তবে সেই মানুষগুলোকে সম্মিলিত মানব অনুভ‚তি দিয়ে কি বাঁধতে পারবে না বিশ্ব ছুটি দিবস? প্রশ্ন উঠতেই পারে, বিশ্ব ছুটি দিবস কিসের উপর ভিত্তি করে উদযাপিত হবে। এর উত্তর হলো, নানান বর্ণের, নানান জাতির এবং বৈচিত্র্য ভরা পৃথিবীতে একটি জিনিষই ঘাটি, আর সেটা হল মানব ভাষা। যে ভাষা না থাকলে আমরা যোগাযোগের উন্নয়ন ঘটাতে পারতাম না। একই সাথে কোন উন্নয়ন ও অর্জন ভাগাভাগিও করতে পারতাম না। বৃ¶ের হয়তো ভাষা আছে, তেমনি প্রাণীকুলেরও ভাষা থাকতে পারে তবে তা মানব ভাষার মত যোগাযোগ স্থাপন ও বিতরণের সহায়ক নয়। এই সুবিধার কারণেই আজ মানব জাতি শ্রেষ্ঠতম পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। তাই ভাষাকে কেন্দ্র করেই আসতে পারে একটি সম্মিলিত ছুটির দিন। সব জাতি, সব দেশের মানুষ চায় তার মাতৃভাষা যেন অ¶ত থাকুক। ধ্বংসের হাত থেকে বেঁচে থাকুক। তাই আশা করি ভাষা দিবসকে কেন্দ্র করে একটি সম্মিলিত বিশ্ব ছুটি দিবসের ডাকে সবাই সাড়া দিবে।
আসুন আমরা যে যার জায়গা থেকে চেষ্টা করে যাই যাতে, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসকে কেন্দ্র করে একটি বিশ্ব ছুটি দিবস প্রতিষ্ঠা করা যায়। ইতিহাসের সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলে দেখা যাবে অতীতে মানবতার ¯^প¶ে যে সমস্ত কাজ করা হয়েছিল দেরিতে হলেও তার প্রায় সবগুলো আলোর মুখ দেখেছে। তাই আজ কিংবা কাল ‘বিশ্ব ছুটি দিবস’ও আলোর মুখ দেখবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
বৃহত্তর মানব সভ্যতাকে গড়ার পেছনে বাংলাদেশের জনগণ হয়তো তেমন কোন উল্লেখযোগ্য আবিষ্কার করতে পারেনি। হয়তো তেমন নির্মাণ তাদের হাত দিয়ে গড়ে উঠেনি। তবে, মানব জাতীর সবচেয়ে বড় সম্পদ
মাতৃভাষার বিপদের দিনে বাংলাদেশের মানুষ এগিয়ে এসেছিল বুক উঁচিয়ে। তারপর মাতৃভাষা দিবসের আন্তর্জাতিকীকরণেও বাংলাদেশের নেতৃত্ব রয়েছে। এখন বিশ্ব ছুটি দিবসকে বাস্তবতা দিতে বিশ্বের সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। একজন বাঙালিই পারে তার নেতৃত্ব দিতে এবং সে ব্যক্তিটি আপনিও হতে পারেন। কথাটি ভেবে দেখুন।