শওকত মিল্টন
সেল নম্বর ২০২০। সেন্ট্রাল জেল অব আর্থ। জেল খানার আর্কটিক এলাকার শাখা উত্তর মেরুর কাছাকাছি। এখানেই আছি একমাসেরও বেশী সময় ধরে। জেল কর্তৃপক্ষের দয়ায় মোটা রুটি আর ডালের বদলে বাড়ীর খাবারটা খেতে পারছি। জেলের সেলে বসেই বা শুয়ে ভার্চুয়াল জগত দেখি। দেখি কত দ্রুত মানুষ পাল্টে যাচ্ছে। দেখি কত দ্রুত আমাদের শহরের মিলুর কথাগুলো ফলে যাচ্ছে। আধুনিক মানুষ যে একা, নিঃসঙ্গ এবং এক অজানা চরম স্বাধীনতার মনোজগতে বসবাস করে সে কথা তো তাঁর মতো আর কে বুঝেছিলো বাংলা সাহিত্যে।
না ভয়ের কোন কারন নেই। সাহিত্য-টাহিত্য আমি ঠিক বুঝি না। সে যোগ্যতা আমার কস্মিনকালেও ছিলো না। এ শুধুই গরীবের বাড়ীতে ত্রান দেবার মতো মনের খোরাকের কথাবার্তা। এই যেমন ধরুন, মিলুর মা কুসুম কুমারী দেবী স্বপ্নেও কি ভেবেছিলেন তার আপাতঃ গোবেচারা সমাজে অচল ছেলেটাকে নিয়েই কীর্তনখোলার জলের মতো চলমান থাকবে আলোচনা? কিভাবে যেন মিলু বুঝেছিলেন মানুষের ভেতরের মানুষকে, তার সব পাওয়ার পরও একটা না পাওয়ার বেদনা থাকে অথবা বেদনার মধ্যেও একটা আনন্দ থাকে। সাঁজের মায়া ছাড়া উত্তরের এই নগরীর সাঁজবেলায় খুব করে আমাদের মিলুর কথা, আমাদের আধা শহর আধা গ্রামের বরিশালের কথা, রাজা রায়বাহাদুর সড়কের মেঘ শিরীষ, কৃষ্ণচুড়া, রাধাচুড়া, সুনাইলের কথা, বলাকার নাস্তার কথা, নিখিলের সিঙ্গাড়া, নিতাইর মিষ্টি, আলতাফের হোটেলের দুধ কলা ভাত আর বিসমিল্লাহর ভর্তা ভাতের কথা মনে পড়ছে। মনে পড়ছে দধি ঘরের অনেক পুরোনো রেডিও, বুকভিলার নতুন বইয়ের গন্ধ আর বান্দ রোডের হারিয়ে যেতে থাকা বোতল পামের কান্না। আজ খুব বরিশালকে মনে পড়ছে, গভীর হতে থাকা এই রাতে কীর্তনখোলাকে মনে পড়ছে।
গৌতম মিত্র নামে এক গোর খোদক, যিনি কিনা সময়ের কবর খুঁড়ে বের করছেন মিলুর অস্থি মজ্জা, তিনি আমাকে কড়া নেড়েছিলেন এই অবেলায়। কোলকাতার কবর খুঁড়ে বের করে এনেছেন আমারও কিছু দেহাবশেষ। গোর খোদকরা যেমন হয়, তাদের শাবলের কোপে আমি বরিশাল মহাশম্মশানে গনেশের মায়ের শেষকৃত্য করতে গিয়ে শোনা কীর্তনের সুর শুনতে থাকি। জাতিস্মরের মতো ফিরে যাই আজ থেকে ২২/২৩ বছর আগের বরিশালে। তখন আমার বরিশাল ছিলো আমাদের। আমাদের বাসা মানে আমার বাসা নয়। একটা যৌথ বাড়ীর একান্নবর্তী পরিবারের সদস্যরা, যারা কখনও রক্তের বন্ধনে না, আত্মিক বন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন। কখনও অশ্বিনী কুমার হলের পেছনের এক চালা টিনের ঘরের এক কক্ষে আবার কখনও বা বিবির মহল্লা বা প্যারারা রোডের আধুনিক ইমারতের দুই কক্ষে। আমরা তখন আনন্দে উড়ি, কস্টে কাঁদি। ইলিশে রবীন্দ্রনাথ, ধলপহরে জীবনানন্দ দাশ কিংবা মঙ্গল শোভাযাত্রার রাখী বন্ধনে ছিন্ন ভিন্ন হই ভালবাসায়। আমরা তখনও মানুষ হয়ে ওঠার ভাবনায় কাতর।
এমনই একটা সময়ে ওপার বাংলা থেকে আর এক গোর খোদক সুদীপ্ত সেনগুপ্ত এসেছিলেন আমাদের শহরে। বিখ্যাত মানুষ। আনন্দবাজার পত্রিকার বিশেষ প্রতিনিধি।সে সময়েই তালেবান প্রধানের সাক্ষাতকার নিয়ে দারুন আলোচিত। কি দরকাররে বাবা আমাদের শহরে? তালেবানতো দূরে গেলমানও নেই। না তিনি এসেছেন আমাদের মিলু মানে জীবনানন্দ দাশের জন্মশত বার্ষিকী উপলক্ষে একটা কাজ করতে। আনিসুর রহমান স্বপন, বরিশালের বই খাদক, তিনিই বোধহয় বাতলে দিয়েছিলেন কলকাতা থেকে আসা কোন তারবাহককে, আমার নাম। কি বিষয়? এই যেমনটা হয় মফস্বলের সাংবাদিকদের, ফিক্সচারের কাজ করা। সুদীপ্ত সেনগুপ্তর জন্য তাই করলাম।আসলে তখন কেউ বরিশালে নিউজ করতে এলে তাকে আমার সহায়তা কোন কোন ভাবে লাগতোই। এর একটা কারন আমার একটা ব্যক্তিগত আর্কাইভ ছিলো।
তাছাড়া বরিশালে আমাদের মানে আমার আর বীথির স্বাধীন সংসার ছিলো। তখন আমরা দুজনেই চাকরী করি, সংগঠন, আন্দোলন সংগ্রাম করি। বিয়ের সাত/আট বছর পেড়িয়ে। তখন আমাদের উড়ে চলা। যা হোক সুদীপ্তকে লঞ্চ থেকে নামিয়ে আলী হোটেলে তুলে দিয়েছিলাম। তারপর জীবনানন্দ দাশের বাড়ী নামের ধাঁনসিড়ি ভবন- মানে নূরজাহান খালাদের বাসা, ব্রজমোহন কলেজ, ব্রজমোহন স্কুল, অশ্বিনী কুমারের ভেঙ্গে ফেলা বাড়ীর চিহ্নের তমাল গাছ, কালীবাড়ী রোড, শীতলাখোলা, বান্দ রোড চরকির মতো ঘুরেছি। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের কাছেও যাওয়া হলো। কথা বলিয়ে দিয়েছিলাম প্রয়াত দেবেন দাদু,প্রয়াত মোশারেফ হোসেন নান্নু ভাইসহ আরো অনেকের সাথে। প্রথমদিন সন্ধ্যা নাগাদ সুদীপ্ত বলছিলেন, চলুন আপনাদের প্রেসক্লাবে যাই। নিয়ে গেলাম। আধা কাপ চা খেয়ে সবার সাথে কথা বলে বের হয়ে এলেন।
পথে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন এখানে কোন ড্রিংক পাওয়া যায় কিনা। আমি হেসে উঠলাম। বললাম, দাদা আন্ডারহ্যান্ডে পাওয়া যায় তবে ওপেনে নয়। তবে শহরের আন্ডারগ্রাউন্ডেও এখন আকাল চলছে, ঠিকমতো মিলছে না। বেচারা নিরাশ হলো। তো তার অবস্থা দেখে বললাম চলুন আমার বাসায়? নিমরাজি হয়ে গেলেন। আমার বিবির মহল্লার বাসায় তখন সান্ধ্যকালীন আড্ডা জমে উঠতে শুরু করেছে। বীথি অফিস শেষ করে বরিশাল নাটকে নাটকের রিহার্সাল শেষে মানিক, পার্থদা, দেবুদা, ছবি আকাঁর ঝাঁপ বন্ধ করে বাদল, সারাদিন নিজের সাথে যুদ্ধ করা সুশান্ত, নিতাই চলে এসেছে। আরো যে কারা কারা ছিলো মনে নেই। আমাদের আড্ডা সুদীপ্তর খুব পছন্দ করলো। মনে আছে, সেদিন বাসায় বেশ বড় সাইজের দেশী কই মাছ বীথি তেল কই রান্না করেছিলো। সর্ষের তেলে। কোলকাতার মানুষ সুদীপ্ত খেতে বসে গেলেন এবং খেতে খেতে অনর্গল বীথির সাথে গল্প করে গেলেন। পরদিনও আমাদের সাথে। সুদীপ্ত চলে গেলেন ঢাকায়, কবি আসাদ চৌধুরীর সাথে একটা এ্যাপয়ন্টমেন্ট করে দিলাম। তারপর নাটোর ঘুরে সুদীপ্ত চলে গেলেন কোলকাতায়। তখন মোবাইল ফোনও নেই, ইন্টারনেট ঢাকাতেও মহার্ঘ! ফলে সুদীপ্তর সাথে আর যোগাযোগ হলো না। তবে জীবনানন্দ দাশ নিয়ে কি লেখে তা নিয়ে একটা আগ্রহ ছিলো।
তখনও আমাদের শহরের স্বপ্নবাজ পুরুষ নশরত আজাদ দেশান্তরী হননি। এক ভোরে আনন্দবাজার পত্রিকার রবিবাসরীয় এই সংখ্যাটা বাসার দরজার নীচ দিয়ে রেখে গেলেন। ১৯৯৯ সালের ১৭জানুয়ারী আনন্দবাজার পত্রিকার পুরো এক পাতা জুড়ে এই প্রতিবেদন দেখে আমরাতো অবাক। তারচেয়েও অবাক শিরোনাম দেখে। আরে আমরাই দেখি শিরোনাম হয়ে গেছি। ‘বীথির ঘরে চারু মজুমদারের ছবি’-লেখাটার পরে ওপার বাংলায় কিছুদিন পরে গিয়েছিলোম। দেখলাম হাবড়া-বারাসাত এলাকার বেশ কয়েক লোক যারা বরিশালের তারাতো ঘিরে ধরলো। দাদা আনন্দবাজারের লেখাটা পড়েছি!বেশ অনেক পরে কোচবিহার থেকে এক লোক এলেন আমাদের বাসায়। কি কারন সে কিছু বুঝবার আগে বললো আপনাদের বসার ঘরে চারু মজুমদারের ছবিটা আছে , আমি বললাম আছে। ঠেলে বাসায় ঢুকে একটা বিপ্লবী সালাম দিলেন ছবিটাকে। তারপর কথাবার্তায় জানলাম তিনিও চারু ভক্ত। লেখাটা পড়েছিলেন বছর খানেক আগে। বরিশালে আত্মীয় বাড়ী বেড়াতে এসে দেখতে এসেছেন আমাদের বাসা। তবে এই লেখাটার কপিটা কোথায় যেন হারিয়ে যায়।
বরিশাল থাকতে বারবার রাস্ট্রদ্রোহী মামলা, জেলে যাওয়া আর পালিয়ে থাকতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠে আবারও ঢাকা চলে আসি ২০০৪সালে। ফলে আর দশজনের মতো অতোটা স্বাভাবিক জীবন যাপন আমার কখনও ছিলো না। হারিয়ে ফেলেছি অনেক কিছুই। আজ বহু বছর পরে হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগার মতো সেই সব স্মৃতি উথলে উঠলো সেই লেখার ছবি পেয়ে। এখন কতো বদলে গেছি। এখন বরিশাল যেতে খুব ইচ্ছে করে। হলুদ স্টিমার সিটি দিয়ে ধলপহরে বরিশাল থামবে। রিক্সার টুং টাং শব্দে ছুটে যাবে ঘুমের আবেশ। শেষ রাতের হাস্নুহেনার গন্ধ ছাপিয়ে খুব করে জ্বাল দেয়া চায়ের গন্ধ চনমন করে তুলবে। আমি কীবোর্ডে লিখতে লিখেতে আমার চারপাশে বরিশাল গড়ে তুলি। আমি সেই শহর থেকে আর পালাতে পারি না।