শাকুর মজিদ, লেখক, নাট্যকার, চলচ্চিত্র নির্মাতা, ঢাকা
দেশের সীমানা ছেড়ে বিদেশ পা রাখা মাত্রই বুঝে ফেলি, এটা অন্য দেশ, কারণ প্রথম যে লোকটার সাথে কথা হয়, তাঁর ভাষা শুনে বুঝি, এটা আমার না, তাঁর ভাষা। বুঝে যাই, মানচিত্র ভেদে মানুষের মুখের ভাষা আলাদা আলাদা।
এই বোধ থেকে আলাদা পুলক পাই দুইবার- সড়ক পথে ইমিগ্রেশনের বেড়া পার হয়ে ভারতের বেলুনিয়া নেমেই দেখি ইমিগ্রেশনের পুলিশ খাস নোয়াখাইল্যা ভাষায় কথা বলছে, ভারতের আরেক সীমান্ত সুতারকান্দি বর্ডার পেরুতেই করিমগঞ্জের লোকের ভাষাও দেখি আমার গ্রামের ভাষা, সিলেটী। এবার এও বুঝি, কেবল মানচিত্রের কারণেই ভাষার পরিবর্তন হয় না। সীমানা প্রাচীর দিয়ে দেশকে আলাদা করলেও ভাষাটা যার যার মতো রয়ে যায় কোথাও কোথাও।
মাঝে মাঝে ভাবি, এতো জাতের মানুষের এতো আলাদা রকমের ভাষা হলো কী করে? নিশ্চয়ই একই উৎস থেকে সব মানুষের জন্ম ও বিস্তার হয়নি। হলে তো এক রকমেই সবাই কথা বলতো, একই ভাষায়। সে যেখানে যেতো তাঁর ভাষাটাও নিয়ে যেতো, যেমন নিয়েছে অলন্দাজ নাবিক উত্তর-দক্ষিণ আমেরিকায় বা সিলেটীরা নিয়েছে লন্ডনে।
প্রথম বিদেশ ভ্রমণে ভাষা নিয়ে সংকট হয়নি আমার মধ্যপ্রাচ্যে। আরবী না জেনেও আমি দুসপ্তাহ কাটিয়ে এসেছি আরাম করে। কারণ, আমার সঙ্গি যখন যিনি ছিলেন, তিনি দোভাষির কাজ করেছিলেন। আর অল্প-সল্প যতটুকু ইংরেজী আমি জানি, তা দিয়ে যেকোন ইংরেজী জানা লোকদের সাথে আমি চালিয়ে নিতে পারি, তা পৃথিবীর যে প্রান্তেই হোক।
তবে, দক্ষিণ আমেরিকা সফরে গিয়ে ভালোভাবেই বিপাকে পড়ে যাই। ব্রাজিলের এয়ারপোর্টে আমাদের ভাষা বোঝার জন্য সবচেয়ে ভালো ইংরেজী জানা যে লোকটাকে নিয়ে আসা হলো, তিনিও দেখি পূর্ণ একটি বাক্যও বলতে পারেন না। ‘সে এলে তুমি যাবে’ এটুকু বোঝানোর জন্য তাঁকে বলতে হয় হি কাম, ইউ গো। আমার তখনো ধারণা ছিলো মার্কিন ডলারের মতো ইংরেজী ভাষাটাও পৃথিবীর সব জায়গায় চলে । কিন্তু ব্রাজিল ছেড়ে চিলিতে গিয়ে টের পেলামÑ সেসব অঞ্চলে চারটি ভাষা যিনি জানেন, তাঁর চতুর্থ ভাষাটি ইংরেজী। সান্তিয়াগো শহরে ৭ দিন কাটিয়ে দিলাম, দুই-তিনটা মাত্র স্প্যানিশ শব্দ দিয়ে। এবং টের পেলাম, মুখের ভাষা ছাড়াই রেখার ভাষা আর শরীরের ভাষা মুখের থেকে একটুও কম নয়। ভাব বোঝানোর জন্য কথা বলা ছাড়াও মানুষকে সব বুঝিয়ে দেয়া যায়। হাতের ভাষায় মুরগির ডিম যখন বোঝাতে গিয়ে গোল করে দেখানোর পর খাবার টেবিলে প্রথমে টমেটো সিদ্ধ, পরে গোল আলু সিদ্ধ নিয়ে আসা হলোÑ বুঝলাম এটাও খুব কার্যকরী নয়। তখন আবার রেস্টুরেন্টের টিস্যু পেপারে একটা মুরগীর ছবি এঁকে নীচে গোলক বানিয়ে দেয়ার পর দেখি সত্যি সত্যি ডিম এসে হাজির হয়ে যায়।
চিলিতে গিয়ে আসল চিলিয়ানের প্রতি আমার মায়া জাগে। স্প্যানিস ডাকাতেরা তাদের জায়গা দখল করে তাদেরকে ধর্মান্তরিত করে এক সময় তাদের হটিয়ে নিজেরাই ক্ষমতা দখল করে নেয়। ক্ষমতাবানের দখল বড় কঠিন হয়। তারা একসময় তাদের নিজেদের ভাষা আরোপ করিয়ে দেয় অধীনস্তদের উপর। মূল ভাষাটা ধীরে ধীরে তাদের নিজের অঞ্চল থেকেই নির্বাসিত হয়ে অপরের ভাষাটা নিজের হয়ে যায়।
এই যেমন আমার মায়ের ভাষা সিলটী। আমি জাতীয় ভাবে বাঙ্গালী। আমার মায়ের ভাষাটি প্রমিত ভাষার চেয়ে আলাদা। এটা আমার জাতীয় ভাষা। আবার এই ভাষারও নিজের তেমন মূল শব্দ নাই। প্রায় সবই আমাদের বিদেশী ভাষা। পাশের ভারত-পাকিস্তান থেকে এসেছে সংস্কৃত আর উর্দু, তার আগে পর্তূগীজ, মঙ্গোলীয়, পার্শিয়ান, ইংরেজরা ধাপে ধাপে এসেছে আমাদের ভূখ-ে। লুট করতে আসুক বা বেসাতীতে আসুক, এক সময় তারাও ক্ষমতা নিয়ে নেয় আমাদের থেকে। যারা আসে তারাই তাদের ভাষা আমাদের উপর চাপায়, শেখায়, বলতে বা লিখতে বাধ্য করে। আমরাও তাদের কাছ থেকে শিখে-শুনে আমাদের একটা ভাষা তৈরি করে ফেলি, যার সাথে আমাদের আদি পুরুষের ভাষার তেমন মিলই নাই। একটা সময় পর্যন্ত, মানে ১৯৫২ সালের আগে পর্যন্ত হয়তো আমাদের সেই রেজিস্ট্যান্স তৈরি ছিলো না, যেমনটা ছিলো অষ্টম শতকের পার্সিয়ানদের।
ইসলাম ধর্মের বানী নিয়ে আরবরা যখন অগ্নিপূজারক পারস্যবাসীদের জয় করে নিলো, তারা কিন্তু শর্ত দিয়েছিলো আরবদেরকে। শর্তটা ছিলো এমন যে, আমরা তোমাদের ধর্ম নিলাম, কিন্তু তোমাদের ভাষা নিবো না, আমাদের ভাষায়ই আমরা তোমাদের আল্লাহকে ডাকবো। তারা ডেকেছিলো, ডাকছেও। আর আমরা যেহেতু আরবদের নয়, পারস্য হয়ে আসা মুঘলদের কাছ থেকে ধর্মাচার শিখেছি, তাই আমরাও ‘আল্লাহ’ কে ‘খোদা’, ‘সালাত’ কে ‘নামাজ’, ‘সিয়াম’ কে ‘রোজা’ এসব বলি।
নিজেদের ভাষা নিয়ে অহংকার তারাই বেশি করে যাদের ভেতর তাঁর স্বজাত্যবোধ বেশি। বার্লিন বা প্যারিসে দেখেছি, ইংরেজী জানা থাকলেও খুব ঠেকায় না পড়লে কোন জার্মান বা ফরাসী ইংরেজিতে কথা বলে না। আমাদের কাছে ইংরেজি যেমন একটা অভিজাত বিদেশি ভাষা, ইংরেজরা শাসন করেনি এমন দেশের মানুষের কাছে তা নয়। আমার কাছে হিন্দি যেমন (খানিকটা বুঝি, ঠেকায় পড়লে বলি) ইউরোপীয়দের কাছে ইংরেজীও তেমন।
যে সকল জাতীর কাছে অন্য জাতী এসে শাষন করে গেছে, তাদের ভাষা মিশ্রিত হয়েছে সর্বত্র। আমার দেখা দুইটা দেশ পেয়েছি, চীন আর জাপান এই দুই দেশের ভাষায় অন্য কোন ভাষার ছোয়া নাই। এ ক্ষেত্রে চীনের অবস্থান উপরে। চীনা ভাষায় কোন বর্ণমালা নাই। উচ্চারনের সুবিধার জন্য ১০ হাজার চিহ্ন দিয়ে তারা তাদের সব কথা প্রকাশ করতে পারে। তবে আধুনিক চীনে ৭-৮০০ চিহ্ন দিয়েই সব কথা প্রকাশ করা যায়। চীনা ভাষায় কোন বিদেশি শব্দ তো নাইই, বরং বিদেশীদেরকেও তারা নিজের দেয়া নামে ডাকে। বাংলাদেশকে বলে মুঞ্জালা, ইন্ডিয়া কে ইংজালা, এমন। আমরা চীনাদেরকে যে চীনা বলি, তারা নিজেদেরকে বলে পিনিন, আমরা বলি বেইজিং তারা ডাকে পিকিং। বিদেশীরা এসে দেশের নামও বদলে দিয়েছে কোথাও কোথাও। আড়াই হাজার বছর আগে গ্রিক পর্যটক হিরোডিটাস ‘মিশর’ সফর শেষে দেশে গিয়ে ‘ইজিপ্ট’ নামক দেশের কথা লিখলেন। সেই থেকে দেশের নামও বদল হয়ে গেলো। মিশরীরা এখনো নিজের দেশের নাম অপরের কাছে ইজিপ্টই বলে, নিজেরা বলে মিশর।
মিশর সফর করে আমার মনে হয়েছে, মৃত ভাষারা আর জাগে না। সাড়ে তিন হাজার বছর আগে মিশরে লিখিত ভাষা ছিল হায়ারোগ্লিফি। ফারাওদের আমলে এই ভাষায় তাদের রাজাদের জন্ম-মুত্যুর, যুদ্ধে জয়-পরাজয়ের কাহিনী লিখে রাখতো পাথরের দেয়ালে। তাদের বর্ণমালাও ছিল সাংকেতিক চিহ্ন, রেখায়। ফারাওদের পতনের পর পারস্য, গ্রিক, রোমানরা এসে তাদের দেশ দখল করে, তাদের ভাষা বিস্তৃত করে। সপ্তম শতাব্দীতে আরব থেকে মুসলমানরা এসে দেশ দখল আর ধর্ম বিস্তার করলে তাদের আগের সব ভাষা মরে গিয়ে আরবী তাদের ভাষা হয়ে যায়। উনিশ শতকে এসে হায়ারোগ্লিফি নতুন করে আবিস্কৃত হলেও মিশরের কেউ আর হায়ারোগ্লিফি শিখে না, পড়েও না, লিখেও না।
আমাদের সিলেট অঞ্চলের একটা আদী ভাষা ছিলো। সিলটী ভাষা, লেখা হলো নাগরী লিপিতে। প্রায় একই সঙ্গে বাংলা লিপি ও নাগরী লিপির মুদ্রণ শুরু হয়। প্রমিত সাধু রীতির বাংলা লেখা হয় বাংলা লিপি দিয়ে আর সিলটি ভাষা লেখা হয় নাগরী লিপি দিয়ে। কিন্তু কালের ধারায় নাগরীলিপি লুপ্ত হয়ে যায়। সিলটি ভাষার লিখিত রূপের প্রয়োজন থাকে না। ১৯৪৭ সালে দেশভাগ হলে সিলেট চলে আসে আসাম ছেড়ে বাংলার সাথে। আর ধীরে ধীরে লুপ্ত হয়ে যায় নাগরী লিপি। এখন এইসব ভাষা কেবলই যাদুঘরের উপকরণ।
আদি ভাষার চল উঠে গেলেও ভাষাকে যত করে রাখার একটা জায়গা দেখেছিলাম চীনের নাশিপাড়া লিজিয়াং-এ। সেখানে একটা দুংগা যাদুঘর আছে। দুংগা সম্প্রদায়ের ভাষা কেমন ছিলো, কোন প্রতীক দিয়ে কী কথা কীভাবে প্রকাশ পেতো তাও দেখানো জন্য এখনো দুংগা ভাষায় যারা পারদর্শী আছে, তাদের রেখে দিয়ে শিখানো হয়। চীনারা চিঙ্কু ভাষায় লিখে, পড়ে। দুঙ্গার চিত্রভাষা তাদের কাছে এখন শুধুই যাদুঘরে প্রদর্শণীর বিষয়।
নানা দেশে নানা ভাষার মানুষের কথা শুনে মনে হয়েছে, ভাষাও খুব ধীরে পরিবর্তনশীল একটা প্রকাশ মাধ্যম। ইংল্যান্ডে শেক্সপিয়ারের আমলে যে ইংরেজী ছিলো এখনকার ইংরেজ সে ভাষায় কথা বলে না। বঙ্কিম বা রবীন্দ্রনাথের আমলে কলকাতার লোকেরা যে ভাষায় কথা বলতো আজকের কোলকাতীয় কাওকে অনেকটা ভিন্ন ভাবে কথা বলতে দেখি। শুধু কী তাইÑ সিলেটের গ্রামে আমার সুদুর শৈশবে, ধরেন গেলো শতকের সত্তরের দশকে আমি যে গ্রামের মানুষদের যে সকল শব্দ বলতে শুনতাম, এখন আর সেসবের ব্যবহার উঠে গিয়ে প্রমিত বাংলার অপভ্রংশের আঞ্চলিক রূপে প্রকাশ পাচ্ছে। মানুষ যতই বাইরে যায় ততই বাহির থেকে অনেক কিছু নিয়ে আসে, তাঁর সাথে থাকে সেখানকার ভাষাও।
মানুষের মুখের ভাষাটা অনেক সহজ। মনের ভাষাটা বেশ কঠিন। যার মনে থাকে সেই কেবল পড়তে পারে, অন্যরা কেবলই অনুমান করে। এ কারণে কবিতার ভাষা কবির কাছে যেমন তাঁর পাঠকের কাছে অন্যরকম বোধ নিয়ে আসে, যেটা কবি হয়তো কখনো ভাবেনইনি।
তবে আমি বিদেশে বেশ কয়েক জায়গায়, যেখানে আমার জানা ইংরেজীটুকু দিয়েও অপর পক্ষকে বোঝাতে সমর্থ হইনি সেখানে স্রেফ বাংলায় কথা বলে পার পেয়ে এসেছি। এ কাজটা অনেক দেশেই করেছি একেবারে গভীর আত্মবিশ্বাসের সাথে। কিন্তু খেয়াল করেছি, যাকে আমি আমার ভাষা বোঝাতে চেয়েছি, সে আমাকে ঠিকমতো দেখতে পাচ্ছে কী না। দেখতে পেলেই কাজ হয়ে যায়। কারণ মুখ থেকে শব্দ বেরুনোর সময় আমার শরীদের নানা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ- আমার হাত, আঙ্গুল, চোখ, মুখ, গ্রিবা- এরা আরেক ধরনের ভাষা প্রকাশ করে। মানুষের এই দেহভাষাটি পৃথিবীর সব দেশের সব জাতির সব মানুষের কাছে একই অর্থ বহন করে, যার কাছে মানুষের মুখের ভাষাও অনেক অসহায়।