-ফারহানা পল্লব
[এই লেখার সব চরিত্র আর ঘটনা লেখকের মনগড়া। দৈবক্রমে কোন ঘটনার সাথে মিলে গেলে ¶মা সুন্দর চোখে দেখবেন।]
কানাডা টরোন্টোর এলাস ব্যাংকুয়েট হলেভ্যানলেন্টাইনের অনুষ্ঠান জমে উঠেছে। বাঙ্কোয়েট হল এর টেবিলগুলো ভরে উঠছে, এখন লোক আরো আসাতে আরো টেবিল যোগ করতে হচ্ছে। পিউ খুব নার্ভাস, শেষে সব এলো মেলো না হয়ে যায়। তার সাথে মমতা আপা আর শাকিলা, তারা দিব্যি পার্টিতে মজা করছে। যা ভেবেছিলো পিউ সেটাই হলো আশাতীত লোক হওয়াতে খাবার আয়োজন বেশি বেশি করেও কম পড়তে পারে। পিউ বার বার সাবধান করেছে, দরোজায় সোল্ড আউট বলে আর গেস্ট না ঢুকাতে। কিন্তু বাকি সহযোগীরা খুশিতে কাউকে মানা করেনি।
পিউ বসে বসে ভাবে, যে দেশের যে রীতি- এই সভ্য দেশে এসে পরিবর্তনগুলোর সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হিমশিম খেতে হয়। দেশে থাকতে পিউ ভ্যালেন্টাইনের এতো রমরমা দেখেনি, এখন নাকি দেশেও দারুণ আয়োজন চলে ভ্যালেন্টাইন নিয়ে। প্রথম প্রথম পশ্চিমাদের এই ভ্যালেন্টাইন উদ্বেলিত হতো ২০/২১ বছরের তরুণী পিউ। কত রাত বসে থেকেছে একটা গোলাপের আশায়, সে শুধুÑ ‘সব ফুল আজকে শেষ, পেলামনা একটাও’ এরকম মিথ্যে অজুহাতে কাটিয়ে দিয়েছে বসন্তগুলো। এই দিকে এবারের ভ্যালেন্টাইনের অনুষ্ঠানে ছোটন পুরো পরিবার মঞ্চে নিয়ে বে-তাল বে-সুরে হেরে গলায় গেয়ে চলেছেন, কে থামাবে তাকে, পিউ হন্যে হয়ে একবার দরজায় যায়, একবার মঞ্চের পেছনে, আর কিচেনে দৌড়াদৌড়ি করছে। যাক শেষ পর্যন্ত, বাচ্চাদের গীতি নাট্যটা মান বাঁচালো, দারুন করতালি, আর আনন্দ উৎসবে অতিথিরা খাওয়া দাওয়া নিয়ে কোনো অভিযোগ করেনি। কিন্তু ১২.০১ মিনিটে সকলের আনন্দের চরম সময় সবাইকে থামিয়ে দিয়ে কেক কাটা পর্ব শুরু হলো, এই বিশাল মাঠের মতো এক খানা কেক এনে রুনু আপার জন্মদিন ঘোষণা হলো, যা পিউ কিছুই জানতোনা। অতিথিদের মাঝে গুঞ্জন উঠলো, যে “পয়সা দিয়ে টিকেট কেটে এসে আরেকজনের জন্মদিন দেখতে আসিনি, আমাদের অনেকেরই জন্মদিন থাকে বিশেষ দিনগুলোতে সেগুলো ঘরে পালন করলেই হয়, এইরকম জনসমাবেশ আর ভ্যালেন্টাইন পাবলিক অনুষ্ঠানে এগুলো ন্যাকামী।” এইসব সমালোচনা হজম করে আরেক আঘাত, সেই মাঠের মতো কেক, অখাদ্য সেই কেক অবশেষে অর্গানাইজারদের ভাগ করে বাড়ি বাড়ি নিয়ে যেতে হলো এবং অনেকদিন আর কেউ কেক খেতে চায়নি। এরপর থেকে প্রতি ভ্যালেনটাইন অনুষ্ঠানেই এই জন্মদিনের আর মাঠের মতো কস্টকোর (ঈড়ংঃপড়) অখাদ্য কেকের অত্যাচার চলতে থাকলো। বিষয়টা হচ্ছে কেকটা যেহেতু পয়সা দিয়ে কেনা হয়, সেইটা তো আর ফেলে দেয়া যায় না, এখন এতবড় ¯ø্যাব কেক, খেতে যেহেতু সু¯^াদু না, কেউ খায় না, যার যার ঘরেই নেয়া হয় সবটাই পরে থাকে।
পিউ ভাবে ভ্যালেন্টাইন ডে নিয়ে এতো উচ্ছলতা তার পরেও এতো কেন ভাঙ্গন চারিদিকে? যত অশান্তি আর অত্যাচারেই
থাকুক কেউ কি সংসার ভাঙতে চায়? তারপরেও ঝন ঝন করে একের পর এক সংসার ভেঙে চলেছে, ভালোবাসা যান্ত্রিক হয়ে গেছে, এই ডিজিটাল যুগে ভালোবাসা যে টিকে আছে এই বা কম কি? আজো সন্ধ্যার ধূসর আকাশে একজোড়া হাঁস (কানাডিয়ান গুস) উড়ে গেলে পিউ এর মনটা ব্যাকুল হয়। ভ্যালেন্টাইন এলে, কপত-কপোতীর ঝগড়া ঝটি মান-অভিমান বেড়ে যায় বটে তবে ফেসবুক এ কাভার এ আর পোস্ট এ হৃদয়ের ছড়াছড়ি। নিজের জনকে হয়তো ভুলে গিয়ে যত ‘না বলা প্রেম’, ব্যর্থ প্রেম, ইত্যাদি নিয়ে খামখেয়ালি। নিজেকে না বুঝলে অন্যকে ভালোবাসবে কিভাবে? শুধু আমার আমার, এইটা চাই ঐটাও চাই, কি দিয়েছি একটু কি ভাবি? সমাজ সংসারে আমার নিজের কি অবদান সেইটা একটু ভেবে যদি অন্যের-টা আশা করতাম তাহলে মনে হয় চাওয়ার নেশা থেকে বের হওয়া যেত। ভোগ বিলাসের প্রতিযোগিতায় আয় ব্যয়ের হিসেব মেলে না, যাদের কিছুই নাই তাদের দিকে ফিরে তাকালেÑ জীবনটা অনেক পরিপূর্ণ মনে হয়। একজন আরেকজনের পাশে থাকাটা কত বড় বিষয় তা একজন পতœী হারা বা ¯^ামী হারা কে জিজ্ঞেস করে বুঝা যায়। শাড়ি গহনা, ব্র্যান্ড নেম গাড়ি প্রাসাদসম বাড়ি সবটাই বৃথা যদি সঙ্গী না থাকে পাশে। পিউ তার বাবা-মায়ের ভালোবাসা দেখেনি, দেখেছে একে অপরের প্রতি সম্মান, আস্থা আর বিশেষ দিনগুলোতে আব্বার নিয়ে আসা একগোছা বেলী ফুলের মালা। এলোমেলো ভাবনা থেকে আবার ফিরে আসে পিউ।
এরপর আরেক অনুষ্ঠানের পরে সেইরকম আরেকটা কেক নিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরে কেকের একটা হাল বের করার চেষ্টা চললোÑ রিতার বাড়ি যাওয়ার প্যান হলো, সে বলে শুঁটকি ভর্তা করে খাওয়াবো কিন্তু কেক নেয়া যাবে না, শিলু ভাবি বলে খিচুড়ি রান্না করে খাওয়াবো আসেন আড্ডা হবে কিন্তু কেক আনতে পারবেন না। কি মুশকিলÑ সবাই পিউদের ডাকে আড্ডা দিতে কিন্তু সাবধান করে দেয় সেই কেক যেন না নেয়া হয়।
অনেক বছর আর তেমন কোনো অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়নি সেই কেক পর্ব হাসি তামাশার গল্প হয়ে গেছে। এবার নিউ ইয়ার্স পার্টি হবে, আরেক বাঙ্কোয়েট হলে। যে মেনু দেয়া হলো, তাতে মিষ্টি জাতীয় খাওয়া একটা, তাই সাথে কেক দেয়া ধার্য হলো সেই উপল¶্যে শিলু ভাবি ২টা বিরাট সাইজের কেক কিনে নিয়ে নিলেন। একটাতে আবার হ্যাপি বার্থডে লিখা, কি আর করা শেষ মুহূর্তে, সেই দুইটাই তুলে নিলেন।
শিলু ভাবি পৌঁছুলেন দেরি করে আর পার্টির আনন্দে কেক নামক মাঠ দুইটি কে বেমালুম ভুলে গেলেন। গাড়িতেই রয়ে গেলো ধানমন্ডির মাঠের সমান দুইখানা বিরাট কেক। পরের দিন তিন ওয়েতে একসাথে তিন আয়োজক গবেষণায় বসে, বের হলো সেই ভুলে যাওয়া কেক দু’খানার কথা, রিতা বলে এই কেক এখন কি করা যায়, শিলু ভাবি বলেন আমার বাড়ি কেউ কেক খায় না আপনারাই নিয়ে যান। পিউ মাথা খাটিয়ে বের করলো কার কার জন্মদিন আর বিবাহ বার্ষিকী আছে, বের হলো ১লা জানুয়ারী ওই দিন-ই হেলাল ভাই আর বিলকিস ভাবীর বিয়ে বার্ষিকী। শিলু ভাবীর উপরই দায়িত্ব পড়লো হেলাল ভাই আর বিলকিস ভাবীর বাসায় ওই কেক নিয়ে গিয়ে বিবাহ বার্ষিকী আয়োজন করা হউক, যেমন কথা তেমন কাজ, শিলু ভাবি বিলকিস ভাবীকে ফোন করে সেই কেক কাজে লাগানোর আয়োজন করে ফেললেন। বিলকিস ভাবীর কাজ ছিল ১ তারিখে, বেচারি তাড়াহুড়া করে অনেক কিছু রান্না করে সবাইকে আপ্যায়ন করলেন, আড্ডা, খাওয়া সব হলো গড়ের মাঠ সম কেকখানা কাটা হলো, শিলু ভাবি, রিতা আর পিউ মিট মিট করে হাসলো।
এবারের অভিযান কেক নম্বর দুই- এই কেকখানা সাইজে বড় হলেও দেখতে সুন্দর, এইবার পিউ বের করলো টুনি ভাবীর বার্থডে আসছে দুই দিন পর, সেই কেক নিয়ে সারপ্রাইজ করার প্যান করতে করতেই টুনি ভাবীর ¯^ামী বারেক ভাই ফোন দিলেন, দিয়ে পিউকে জিজ্ঞেস করলেন, শনিবার কি করছেন, ফ্রি আছেন কিনা, বলা মাত্রই পিউ লুফে নিলো, এ যে মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি, “কি বলেন ভাই, আমরা তো টুনি ভাবীর বার্থডে সারপ্রাইজ প্যান করছিলাম।” বারেক ভাই তো মহা আনন্দিতÑ “তাই নাকি ভাবি আপনি মনে রেখেছেন? ঠিক আছে আপনারা চলে আসেন আমরা সারর্পাইজ করবো টুনি কে।”
যথাসময়ে কাজ সব ফেলে ভাবীর বার্থডে করতে চললো রিতা তার ¯^ামী, পিউ তার ¯^ামী আর শিলু ভাবি। শুধু ৭ জন মানুষ আর এতো বড় কেক দেখে বার্থডে গার্ল টুনি ভাবি বেশ অবাক হলেনÑ পিউ, রিতা আর শিলু ভাবি আবারো মিট মিট করে হাসলেন।
শিলু ভাবীর ছেলের জন্মদিনে ছোট ছোট দুইটা কেক ছিল অত্যন্ত সু¯^াদু যা নিমেষেই শেষ হয়ে গেলো। তারপরের দিন শিলু ভাবি আর পিউ এক মিটিং শেষে রিতার বাসায় গেলো সেই বিখ্যাত শুটকি খেতে। রিতা রীতিমতো আতঙ্কে ছিল বুঝিবা শিলু ভাবীর ছেলের বার্থডে তে আবার সেই মাঠের মতো কেকের শ্রাদ্ধ করতে যাচ্ছি রিতার বাড়ি। সে আমাদের হাত খালি দেখে হাফ ছেড়ে বাঁচলো।
এইবার আবারো তিনজনে প্রতিজ্ঞা বদ্ধ হলো আর কস্টকো কেক কেনা হবে না। রিতা ঘোষণা দিলো মানুষের বাসায় ও যাওয়ার সময় কেক মিষ্টি নেয়ার প্রচলন বন্ধ করা উচিত সবার ঘরেই সুগার বেশির প্রবণতা সুতরাং ¯^াস্থ্য সচেতন সবাই কেক মিষ্টি তে নয়। এখন পিউ চিন্তায় পড়লো তাহলে কি নেয়া হবে দাওয়াতে যাওয়ার সময়। তার মনে পরে গেল গ্রামের দেশে কুটুম বাড়ি যাওয়ার সময় বিড়াট বড় এক মাছ ঝুলিয়ে রওনা হতো, সেইরকম মাছ, ফল, সবজি এইসব নেয়া যায়। এই কথা শুনে রিতা মহা খুশি, সে বলে তাইতো বেড়াতে যাওয়ার সময় তিনটা ১০ ডলার এ মাছের বক নিয়ে যাওয়া যায়। সেই ধার্য হলো এখন থেকে সবার বাসায় যাওয়ার সময় মাছের বক নেয়া হবে। তারপর বেশ কয়েক বাসায় পিউ মাছের বক নিতে গিয়ে ও পারেনি, বরং বসন্তের এতো নানা রঙের ফুলসহ গাছ এখন চারিদিকে, সে সবাইকে ফুলের গাছ দেয়া শুরু করেছে, তাতে কেউ এখনো আপত্তি করেনি।
শিলু ভাবী, টুনি ভাবী, রিতা, বিলকিস ভাবী, পিউ সবাই যার যার সংসারে চড়াই উতরাই পার করে চলেছেন, ছেলে-মেয়ে বড় হয়েছে, মধ্য বয়েসের দম্পতিরা, ভ্যালেন্টাইনের অর্থ এঁদের কাছে আরেকরকম। মনের মধ্যে এক কিশোরী উঁকি দিয়ে সারপ্রাইজ চাইলেও মুখে তা বলা হয় না। জীবনসঙ্গীদের একই অবস্থা, সময়/সাধ্য অনুযায়ী সঙ্গিনীকে উপহার, ফুল দিয়ে কোথাও ডিনারে যায় পিউ তাঁর জীবনসঙ্গীর সাথে ডিনারের মোমবাতির আলো আধারিতে বসে ভাবে, বয়েস আর সময়ের সাথে সব কিভাবে বদলে যায়, সঙ্গীটি তার এতো আয়োজন করে এখানে এসেও ফোন নিয়ে বসে আছে, মাঝে মাঝে ফেস বুকটাকে খুব হিংসে হয়-এখন আর তেমন কোনো কিছু প্রত্যাশা করে না পিউ, যা না পেলে মন ভেঙে যায়। সংসার একটা সুন্দর অভ্যেস, যেখানে ¶ণিকের ভালোবাসার কোনো স্থান নেই। শুধু আছে, একের প্রতি আরেকের নির্ভরতা, আস্থা, বিশ্বাস নিয়ে দীর্ঘ পথচলার প্রতিশ্রুতি।
টরন্টো