আব্দুল্লাহ আল শাহীন,মধ্যপ্রাচ্যে।
আমরা কঠিন সময়ের মধ্যে পবিত্র রমজান মাস অতিক্রম করে এসেছি। সময় যতই কঠিন হয় মানুষ ততই বেশি আল্লাহ’র সান্নিধ্য লাভের প্রয়াস চালায়। ছোটবেলা কুশিয়ারা নদীতে লঞ্চ বা নৌকা করে যখন যাতায়াত করতাম তখন লঞ্চ ও নৌকার ভেতরে একটি লিখা চোখে পড়তো। ‘বিপদে বেশি বেশি করে আল্লাহকে ডাকুন’ লিখাটা যথাসম্ভব এমনই ছিল। একটা সময় কুশিয়ারা নদীতে অনেক টেউ আসতো, যদিও এখন আর তা নেই। লঞ্চে এই বাক্যটি লেখার উদ্দেশ্য ছিল, টেউ আসলে কিংবা ঝড়বৃষ্টির ফলে সমস্যায় পড়লে যেন সবাই বেশি বেশি করে আল্লাহকে ডাকে। আল্লাহ ছাড়া বিপদ থেকে রক্ষা করার কোন উপায় নেই।
বিপদের মধ্যে পবিত্র রমজান হওয়ায় মানুষ রোজার পবিত্রতা রক্ষায় সর্বদা সচেষ্ট ছিল। বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসে জনজীবনে নেমে এসেছে অকল্পনীয় বিপর্যয়। ব্যস্ত পৃথিবীটা আজ থমকে দাঁড়িয়েছে। দেশে-দেশে চলছে লকডাউন। জনসাধারণকে ঘরে থাকার পরামর্শ ও নির্দেশনা দিচ্ছে বিশ্বের শতভাগ রাষ্ট্র। ঘরে না থাকলে হচ্ছে জরিমানা ও শাস্তি। এই জরিমানা আর শাস্তি জনসাধারণের কল্যাণের জন্য। বর্তমান সময়ে মানুষের কল্যাণে আইন প্রয়োগ অনেকাংশেই কমে আসছিল। কিন্তু করোনার সংক্রমণ প্রতিরোধে আইন প্রয়োগ হচ্ছে খুবই শক্তভাবে। আর এটা সম্পূর্ণ সাধারণ মানুষের কল্যাণে।
সারাবিশ্বে করোনাভাইরসে আক্রান্তের সংখ্যা ৫২ লাখ ও মৃতের সংখ্যা ৩ লাখ ছাড়িয়ে গিয়েছে। উক্ত ভাইরাসটির উৎপত্তি নিয়ে চলছে নানা আলোচনা। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট সরাসরি ভাইরাসটির নাম দিয়েছেনে ‘চীনা ভাইরাস’। বিশ্ব মিডিয়ায় এ নিয়ে বেশ আলোচনা হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ অনেকেই উৎপত্তি নিয়ে তদন্ত চাচ্ছেন। চীনের শহর উহান থেকে ছড়িয়ে পড়া ভাইরাসটির উৎপত্তি নিয়ে ভার্চুয়াল বিশ্ব স্বাস্থ্য সভায় যোগ দিয়ে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং তদন্তে সম্মতি জানিয়ে সহযোগিতার কথা জানান। ভাইরাসটির উৎপত্তি নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি এখনো বাংলাদেশসহ অনেক দেশে মানব দেহে করোনা টেস্টের কিট নিয়ে চলছে অনেক নাটকীয়তা।
এ দিকে সারাবিশ্বের মানুষ কোভিড-১৯ রোগের টিকা আবিষ্কারের অপেক্ষায় প্রহর গুনছে। ভ্যাকসিন আবিষ্কারের জন্য চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের দিনরাত চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যমতে এ পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে ১১০টি ভ্যাকসিন প্রকল্প নিয়ে বিশ্বের প্রধান প্রধান ভ্যাকসিন কোম্পানিগুলো কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডাব্লুএইচও) প্রধান বিজ্ঞানী সৌম্য স্বামীনাথন গত সপ্তাহে করোনা নিয়ে একটি আশাহত হওয়ার পূর্বাভাস দিয়েছেন।
তিনি বলেছেন, ‘করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে আসতে চার বা পাঁচ বছর সময় লাগবে।’ অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা ভ্যাকসিন তৈরিতে দিনরাত পরিশ্রম করছেন। গতকাল ২২ মে এক সংবাদে দেখা গেল তারা ক্লিনিক্যাল পরীক্ষায় ফল পাচ্ছে।
করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা চালালেও এখনো অনিশ্চয়তার মধ্যে আছে সারা বিশ্ব। অনেক দেশে বিভিন্ন পদ্ধতিতে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা সেবা দেওয়া হচ্ছে।
এই রকম কঠিন পরিস্থিতিতে রাত পোহালে মধ্যপ্রাচ্যসহ ইউরোপ আমেরিকার বেশ কয়েকটি দেশে পবিত্র ঈদুল ফিতর। ঈদের পবিত্রতা রক্ষায় ঈমানী প্রেরণা ও ধৈর্য্য এখন বড় হাতিয়ার। বাংলাদেশের নাগরিক জীবিকার তাগিদে বিশ্বের নানা দেশে বসবাস করছেন। দৈনিক প্রথম আলোর রিপোর্ট অনুযায়ী এ পর্যন্ত সারাবিশ্বে ৬ শতাধিকের বেশি বাংলাদেশি প্রবাসী করোনায় মৃত্যুবরণ করেছেন। আক্রান্ত হয়েছেন হাজারো প্রবাসী।
মধ্যপ্রাচ্যের বর্তমান অবস্থা বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতোই নাজুক। বাংলাদেশি প্রবাসীরা করোনার আঘাতে দিশেহারা। কর্মহীন অবস্থায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন লাখো প্রবাসী। আমিরাতেও তার ব্যতিক্রম নয়। হাজার হাজার প্রবাসীর ব্যবসা বানিজ্যে লসে পড়েছে। কর্মহীন হয়ে ফুপিয়ে কাঁদছেন চাকুরীজীবি প্রবাসীরা। মাস তিনেক আগের নিজ নিজ কর্মস্থলে ব্যস্ত থাকা প্রবাসীরাও আজ ত্রাণের অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে। প্রবাসীদের বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা দিচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর শাসকরা, প্রকাশ্যে বা গোপনে পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন বহু সচ্ছল প্রবাসীরা। মহামারী করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে না পারলে আজ যারা সহযোগিতা করছেন কাল তাদের অবস্থাও এমন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। দেশ থেকে রাষ্ট্রীয় ত্রাণ আসার খবরও পাওয়া গিয়েছে। কিন্তু এসব বিপর্যস্ত প্রবাসীদের জন্য পর্যাপ্ত নয়।
প্রবাসীরা বিপর্যয়ে পড়ার কারণে দেশেও টাকা দিরে পারছে না। দেশে অবস্থানরত প্রবাসীরা তাদের পরিবার নিয়ে চিন্তিত। আর্থিক সংকটের কারণে অসংখ্য প্রবাসীর পরিবার দিশেহারা। পরিবারের সদস্যদের মুখে হাসি না থাকলে দূর প্রবাসে কোন ব্যক্তিই ভালো থাকতে পারে না।
ভিজিটে এসে সংযুক্ত আরব আমিরাতে আটকা পড়েছে হাজারো যুবক। এমনিতেই আমিরাতে ভিজিটে এসে অবৈধ হলে কাজ পাওয়া যায় না উপরন্তু এখন বৈশ্বিক মহামারী; বলা যায় উভয় সংকটের মধ্যে পবিত্র ঈদ উদযাপন করতে যাচ্ছে ভিজিটে আসা অসংখ্য যুবক। আমিরাতে নারী কর্মীরাও রয়েছেন মহা সংকটে। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে করোনার সংক্রমণ প্রতিরোধের কারণে গৃহকর্মী নারীরা কর্মহীন হয়ে কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন।
অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবেশের মধ্যেও ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময়ে পিছিয়ে নেই প্রবাসীরা। হৃদয়ের সকল কষ্ট চাপা দিয়ে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ায় ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করছেন। করোনার কারণে মসজিদের পরিবর্তে ঘরে নামাজ আদায়ের প্রস্তুতি চলছে।