এ বি এম সালেহ উদ্দীন, নিউইয়র্ক
জন্মভূমি তথা মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসা মানুষের একটা স্বভাবজাত প্রক্রিয়া। প্রত্যেকেই নিজের মাতৃভূমিকে ভালোবাসে। নিজের জন্মভূমি,আপন মাটি ও মানুষকে ভালোবাসে।
সকলের মাঝেই থাকে আসল অস্তিত্ব ও শেঁকড়ের দিকে ফিরে যাওয়ার ইচছা ও প্রবল বাসনা। জন্মভূমির প্রতি নির্মোহ মমত্ববোধ ও ভালোবাসার মাধ্যমে প্রত্যেক মানুষের হৃদয়ের আকুতি হলো নিজের ঐতিহ্য ও স্বকীয়তার সাথে নিজেকে জড়িয়ে রাখার আকাঙ্খা। এই আকাঙ্খার প্রতিফলনের চেষ্টা সবার মাঝেই কম-বেশি থাকে। আপন মাটি, মানুষ ও মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসা নিজের সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাবোধ হচ্ছে একজন প্রকৃত দেশপ্রেমিক মানুষের মূল বৈশিষ্ট্য।
এখানে উল্লেখ করবার একটা বিষয় হচ্ছেÑ নিজ দেশে বসে থেকে নিজের জন্মভূমির প্রতি ভালোবাসার প্রকাশ যতটা না দেখা যায় তার চেয়ে অধিক পরিমাণ অনুভব ও উপলব্ধির বহি:প্রকাশ ঘটে প্রবাসে অবস্থানরত: লোকদের মাঝে। প্রবাসের নিঃসঙ্গতার গ্লানিতে স্বদেশের প্রতি তাদের হৃদয়ের টান ও গভীর মমত্ববোধ যেন সবচেয়ে বেশি প্রবল ও প্রকট হয়ে দেখা দেয়। এটা ঠিক যে, বিদেশ-বিভূঁইয়ে অবস্থানকারীদের মাঝে দেশের প্রতি যতটা মায়া ও গভীর টান থাকে, স্বদেশে অবস্থানকারীদের উপলব্ধিতে ততটা আসার কথা নয়।
উদাহরণ স্বরূপ কিছু মনীষী ও মহা মানবের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে।
বিশ্বনবী (স:) আপন জন্মভূমিকে হৃদয় দিয়ে ভালোবাসতেন। তাঁর জন্মভূমি ছিল মক্কা। কিন্তু জীবনের কঠিন বাস্তবতায় জন্মভূমি থেকে মহানবী (স:) কে মদিনায় চলে যেতে হলো। কেননা কাফেরদের অত্যাচারের এক চরম পর্যায়ে মহান আল্লাহর নির্দেশেই তিনে দেশ ছেড়েছিলেন।
তিনি ছিলেন সর্বদা সত্যের পক্ষে। কোন অন্যায় ও অসত্যের সাথে কখনো আপোষ করেননি বলেই তাঁকে মাতৃভূমি ছেড়ে অন্যত্র পাড়ি দিতে হয়েছিল।
মক্কা ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় আপন জন্মভূমির উদ্দেশ্যে তাঁর একটি হৃদয় স্পর্শী উক্তি ছিলÑ“হে মক্কা! আমি যে তোমায় কত ভালোবাসি, তা পৃথিবী-প্রকৃতি এবং তুমি জানো। কিন্তু দুর্ভাগ্য, মক্কার কিছু লোক তা বুঝলো না এবং আমাকে আমার প্রিয়
মাতৃভূমিতে থাকতে দিলো না।”
তিনি নিজের জন্মভূমি ছেড়ে চলে গেলেন। যদিও মদিনায় তাঁকে অভুতপূর্ব সম্মান দেয়া হয়েছিল। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম মর্যাদায় ভূষিত হয়েছিলেন। সঙ্গী-সাথীদের মাধ্যমে পরম যতœ পাওয়ার পরও তিনি আপন জন্মভূমির মায়া কখনো ভুলে থাকতে পারেননি। তিনি প্রায়ই বলতেন কেউ যেন আপন মানুষ ও নিজের
মাতৃভূমিকে ভুলে না যায়। তিনি সর্বদাই জন্মভূমির প্রতি ভালোবাসার গুরুত্ব দিয়েছেন। অর্থাৎ আপন মানুষ ও মাতৃভূমিকে বিস্মৃত না হওয়ার কথা বলেছেন।
মাইকেল মধুসূদন দত্ত ছিলেন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম কবি। তিনি অনেক উচ্চাশা নিয়ে সুখের সন্ধানে বিদেশে গিয়েছিলেন। কিন্তু সুখি হতে পারেননি। বিদেশে অবস্থানকালীন সময়ে নিদারুণ যন্ত্রণা ও কষ্টে তিনি যেসব কবিতা ও সনেট লিখেছিলেন; তা আজ বাংলা সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ। প্রবাসে গিয়ে হতাশ হয়ে তার স্বপ্নভঙ্গের কথা এভাবে ব্যক্ত হয়েছেÑ
“হে বঙ্গ ভান্ডারে তব বিবিধ রতন;/তা সবে (অবোধ আমি) অবহেলা করি,/ পর-ধন-লোভে মত্ত করিনু ভ্রমণ/ পরদেশে, ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি।”
তিনি আরও লিখেছেন-“বহু দেশে দেখিয়াছি বহু নদ-দলে/কিন্তু এ ¯েœহের তৃষ্ণা মিটে কার জলে?/দুগ্ধ স্রোতরূপী তুমি
জন্ম-ভূমি-স্তনে।”
মাইকেল নিজের দেশে ফিরে আর কখনো বিদেশে যাননি। পৃথিবীতে এরকম অনেকে দেশান্ত্রী হয়ে আবার আপন জন্মভূমির টানে প্রত্যাবর্তন করেছেন। কিন্তু যারা কখনো নিজের দেশে ফিরতে পারেন নি কিংবা যেতে পারেন নি। তাদের মাঝে কষ্টবোধ ও কত বেদনার কান্না বহে, তা ভূক্তভোগি ছাড়া অন্য কারো পক্ষে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়।
মহা মনীষাগণ আপন মাতৃভূমি তথা জন্মভূমির প্রতি ভালোবাসার প্রাধান্য দিয়েছেন।
আমাদের জাতীয় চেতনার কবি কাজী নজরুল ইসলাম একবার অনেক স্বপ্ন ও উচ্চাসে নিয়ে বিদেশে গিয়েছিলেন। রেঙ্গুনে তার গ্রামফোনের ব্যবসা ছিল। একটি
ছোঁ-খাঁটো গাড়িও ছিল। কিন্তু কবি বিদেশের মাটিতে টিকতে পারেন নি। মাতৃভূমির টানে আবার স্বদেশের বুকে ফিরে এসেছিলেন।
মাতৃভূমি তথা স্বদেশের ললাটে নিজেকে একীভূত করেছিলেন। মানবতার কল্যাণে সর্বোপরি মানুষের মাঝেই লীন হয়ে গিয়েছিলেন।
ইহাই মানুষের স্বভাবজাত প্রবৃত্তি। মানুষ যেখানে যতদূরে থাকুক না কেন জন্মভূমি তাকে ডাকবেই। আপন মাতৃভূমির প্রতি টান থাকবেই। জন্মভূমিকে ভুলে থাকা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। প্রেম-প্রীতি ও ভালোবাসার বন্ধনে নিজের সত্তা, মাতৃভূমি তথা জন্মভূমিকে আঁকড়ে থাকার নামই দেশপ্রেম। মানুষ নিজের মাতৃভূমিকে ভালোবাসার মধ্য দিয়ে এবং সবার উপরে মানুষের মর্যাদা দিয়েই জীবনের মহত্ত্ব প্রকাশ পায়। এ জন্য মহামনীষদের কাছে স্বদেশই সবচেয়ে বড় এবং সবার উপরে মানুষকেই ভালোবাসার প্রাধান্য দিয়েছেন।
আঠারো শতকের কবি শেখ ফজলুল করিম বলেছেন; “প্রীতি-প্রেমের পূণ্য-বাঁধনে যবে মিলি পরস্পরে/ স্বর্গ আসিয়া দাঁড়ায় তখন আমাদেরই কুঁড়ে ঘরে।” ইবনে আহমদের একটা উক্তি;Ñ “মাটিকে ভালোবাসো, মাটি তোমাকে ভালোবাসবে।” নিজের দেশকে,আপন মাটিকে ভালোবাসাতো ঈমানেরই অঙ্গ।
অতএব আমরা পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকি না কেন জন্মভূমির প্রতি ভালোবাসার উচ্ছ্বাসে আমাদের বেঁচে থাকতে হবে। প্রিয় স্বদেশ, মাটিও মানুষকে ভালোবাসার মাধ্যমেই আমাদের পরিতৃপ্তি। একে অপরের প্রতি সৌহার্দ প্রেম-প্রীতি আর ভালোবাসার সোপানে আমাদের জীবনকে সফল-সার্থক করে তুলতে হবে। মানুষ আর মানুষের প্রতি ভালোবাসা, সহযোগিতা ও সহমর্মিতার মাধ্যমে একজন মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ মিলে। মহান আল্লাহর চিরন্তন আহ্বান হলোÑ “মানুষ এবং মানুষকে ভালোবাসার মাধ্যমেই জীবনকে স্বার্থক করো।”
আমাদের চারপাশে অসংখ্য দু:খী মানুষ আছে। সেইসব সহায়-সম্বলহীন মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে। বিশ্বনবী (স:) বলেছেনÑ“দুঃখী মানুষ ক্ষুর্ধাতের অন্নদান হচ্ছে সর্বোত্তম কাজ।”
মহানবী (স:) মানুষের প্রতি সম্মানবোধ ও মহানুভবতা প্রকাশের মাধ্যমে মানব সেবায় সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়েই তিনি পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষে পরিণত হয়েছিলেন। সাধারণ মানুষের মাঝে লীন হয়ে গিয়ে পরিণত হয়েছিলেন অসাধরণ মহামানবে।
সত্যিকার প্রেম ও ভালোবাসার কোন পরিমাপ কিংবা সীমা-পরিসীমা নেই। ভালোবাসার বিষয়টি অন্তহীন। পালায় ওজন করে কিংবা পরিসংখ্যানের মধ্য দিয়ে তাকে নির্ণয় করা যায় না। উপলব্ধি ও অনুভবের মধ্য দিয়ে প্রেম ও ভালোবাসাকে কিছুটা নির্ণয় করা যায়। মানুষের মধ্যে যে, প্রবল প্রেমশক্তি ও দৈবী প্রেরণা আছে পৃথিবীতে মানুষের মাঝে তার উৎকৃষ্ট বহিঃপ্রকাশ দেখা যায়। পৃথিবীতে অনেক মনীষীগণ নিষ্ঠাবান চিত্তদিয়ে নিঃস্বার্থ ভালোবাসার মধ্য দিয়ে মহামানবে পরিণত হয়েছেন। প্রেম-প্রীতি ভালোবাসার জন্যে অনেকে দেশান্তুী হয়েছেন।
অনেক মনীষী নিজের মাতৃভূমি ছেড়ে অন্য দেশে গিয়ে সত্য ও সুন্দরের জন্য কাজ করেছেন। মানুষের কল্যাণার্থে নিজেদেরকে নিয়োজিত করেছেন।
পৃথিবীর সভ্যতা ও সংস্কৃতির ইতিহাসে সেরকম মানবের অনেক উদ্বৃতি দেয়া যায়। যারা দেশান্ত্রী হয়ে অন্য ভূখন্ড ও দেশে মানব কল্যাণের কাজে নিয়োজিত হয়েছিলেন। কুসংস্কারের অন্ধকার থেকে মানুষকে সভ্যতা শিখিয়েছেন। সত্য-সুন্দর আলোর পথ দেখিয়েছেন। সেইসব মহামানবদের কথা উদ্বৃতি টানতে হয় এজন্যে যে আমরা যেনো তাঁদের উৎকৃষ্ট পথের অনুসারী হয়ে মানুষের মঙ্গল ও কল্যাণের পথে পা বাড়াই। কেননা তাঁদের পথই সুন্দর ও স্রষ্টার পথ।
তাদের নীতি ও আদর্শে আমরা যেনো উজ্জীবিত হই। উদ্দীপ্ত ও সন্দীপিত হই। যারা মানুষকে ভালোবেসে মানুষের মধ্যে লীন হতে পেরেছেন তাঁদের কথা যেন বিস্মৃতি না হই।
যেখানেই যে মাটিতে থাকি না কেন সে দেশটিকেও ভালোবাসতে হবে। কেননা কোন দেশ, মাটি, প্রকৃতি ও পৃথিবীর কোন অঞ্চল কারো সঙ্গে শত্রুতা করে না। যে কোনো দেশ এবং প্রকৃতির রূপ-সুন্দর কান্ত-মধুর অনেক কিছুই আমাদের হৃদয়কে স্পর্শ করতে পারে। এজন্যেই তাকে নির্মোহ ভালোবাসতে হবে। প্রকৃতি ও পৃথিবীর এই সৌন্দর্যবোধই মানুষের অন্তরকে সুসজ্জিত করে তোলে। ইহাই সত্য ইহাই সুন্দর।
মানবতার মা তেরেসাঁ মানবসেবার মধ্যদিয়েই শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে পৃথিবীতে খ্যাতিমান হয়েছিলেন। সুদূর ইউরোপ থেকে মানবপ্রেমে ভারতবর্ষে এসে থিতু হয়েছিলেন। তিনি বলেছেনÑ ‘ঞড় ধনষব ঃড় ষড়াব ঃযব ঢ়ড়ড়ৎ ধহফ শহড়ি ঃযব ঢ়ড়ড়ৎ বি সঁংঃ নব ঢ়ড়ড়ৎ ড়ঁৎ ংবষাবং’ (গরিবদের ভালোবাসতে হলে এবং তাদের জানতে হলে অবশ্যই আমাদের নিজেদের গরিব হতে হবে)। নিজের অহংবোধকে বর্জন করে গরিব মানুষ তথা সাধারণ মানুষের সাথে মিশে যেতে হবে। ধন-সম্পদের চেয়ে এখানে মানুষের মর্যাদাই মূখ্য ও সবার উপরে।
তেমনই হাজি মুহম্মদ মহসীন, ইদি সাত্তার, বাদশাহ খান, মার্গারেট নোবল অদিতিসহ ভারত বর্ষের অগনিত মহা মানব মানুষের কল্যাণে নিজেদের উৎসর্গ করে গেছেন।
শিক্ষা সংস্কার ও জ্ঞানের আলো দান করতেও পৃথিবীতে অসংখ্য মহা মনীষর আবির্ভাব ঘটেছে। যারা জ্ঞান ও শিাদানে ব্রতী ছিলেন। মানুষের মাঝে জ্ঞানের আলো ছড়িয়েছেন। অবক্ষয়ী সমাজের কুপমন্ডুকতা ও কুসংস্কারের পথ থেকে মানুষকে সত্য-সুন্দর ও আলোর পথের সন্ধান দিয়েছেন। যা সত্য তাই সুন্দর। মহৎ মানুষের সমুজ্জল হৃদয়ের উপলব্ধি থেকে সত্য ও সুন্দরেরই বহিঃপ্রকাশ ঘটে। আর এজন্যেই মহান সৃষ্টিকর্তা সর্বোতভাবে সুন্দর। একজন প্রকৃত মানুষের মাঝে পরমতম সুন্দরকে নিরাসক্ত চিত্তে ভালোবাসতে হবে।
মানুষকে ভালোবাসার মধ্য দিয়েই সামাজিক জীবনে উত্তম কাজের পরিপূর্ণতা আসে। উত্তম কাজের প্রতিদান হচ্ছে সর্বোত্তম পুরস্কার। স্রষ্টার নিকট থেকে উত্তম পুরস্কারের প্রধান মাধ্যম হলো মানবপ্রেম। মানুষকে ভালোবাসা। অতএব, দেশ, মাটি ও মানুষের প্রতি গভীর মমত্ববোধ ও ভালোবাসার মাধ্যমেই সঠিক এবং সর্বোত্তম প্রতিদানের সন্ধান করতে হবে।
মানুষকে ভালোবাসা হচ্ছে সবচেয়ে বড় মহানুভবতা। আর তিনিই মহানুভব যিনি সর্বদা মানুষের মঙ্গলচিন্তায় ব্যস্ত থাকেন।
বাংলা সাহিত্যের কবি কামিনী রায়ের একটি বিখ্যাত উক্তি আছেÑ
“আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে আসে নাই কেহ অবনী পরে/সকলের তরে সকলে আমরা প্রত্যেকে আমরা পরের তরে।” এইসব বিখ্যাত উক্তিসমূহের প্রতিপাদ্য হচ্ছে মানুষ, মাতৃভূমি এবং স্বদেশ। আপন মাটির টানে স্বদেশের পানে ছুটে চলে আমাদের মন-প্রাণ। আমাদের প্রিয় মাটি ও মানুষের কাছাকাছি ফিরে যেতে মন সর্বদা ছটফট করে। কিন্তু আমরা ইচ্ছে করলেই যেতে পারি না। প্রবাসের যন্ত্রণাদিগ্ধ জীবনের আস্টে-পিষ্ঠে আমরা সবাই আঁকে আছি। ইচ্ছা করলেও চলে যাওয়ার উপায় নেই। অতএব, পৃথিবীর যেখানেই থাকি না কেন আমাদের জন্মভূমি, প্রিয় স্বদেশের প্রতি ভলোবাসা ও গভীর টান আমাদের থাকবেই।
প্রতি মুহুর্তে নিজের জন্মভূমি- স্বদেশ ও আপন মাটির কাছে ফিরে যাওয়ার জন্য আমাদের মন ব্যগ্র-ব্যাকুল। কিন্তু এই ব্যাকুলতার মাঝেও আমরা নিতান্ত বাধ্য হয়েই বিদেশে যাই ভবিষ্যত সুখের আশায়। এ মুহূর্তে কবি গুরু রবীন্দ্রনাথের দু’টি লাইন মনে পড়ছেÑ ‘সে যে মাতৃভূমি; তাই তার চয়ে বহে/ অশ্রুজলধারা, যদি দুদিনের পরে/ কেহ তারে ছেড়ে যায় দু’দ-ের তরে।’
যখন-তখোন জন্মভূমিতে যেতে না পারলেও আমাদের মনটা পরে থাকে স্বদেশের পানে। স্মৃতির আয়নায় সতত ভেসে ওঠে আমাদের দেশ, মাটি ও আপন মানুষগুলোর ছবি। কিন্তু যে দেশেই অবস্থান করি সে দেশটিকেও ভালোবাসতে হবে। সে দেশের মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ও ভালোবাসা থাকতে হবে। ইহাই স্রষ্টার শিক্ষা। প্রকৃতির শিক্ষা।
প্রকৃতির সাহায্যের উপর ভর করেই মানুষ সবকিছুকে আয়ত্ব করতে পারে। প্রেম-প্রীতি ও ভালোবাসার মাধ্যমে মানুষের অন্তর জয় করে নিতে পারে। প্রকৃতির সাহায্য ছাড়া এবং মানুষের সাহচার্য ছাড়া মানুষের বেঁচে থাকার উপায় নেই।
মানুষ সৃষ্টির সেরা। কেননা মানুষের মাঝে মনুষ্যবোধ আছে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের জ্যোতির্ময় আলো আছে। সত্যালোকের সুন্দরতম আদর্শে মানুষই শ্রেষ্ঠ।
মনুষ্যত্ববোধের শ্রেষ্ঠতম গুনাবলীর কারণেই মূলত মানুষকে সকল সৃষ্টির সেরা বলা হয়। মনুষ্যত্ববোধ না থাকলে মানুষের কোন মূল্য থাকে না। আমাদের সর্বদা মনুষ্যত্ববোধের মর্মগুলোর প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। মনুষ্যত্ববোধের অন্যতম প্রধান কাজ হলো মানবপ্রেম। নি:স্বার্থভাবে মানুষকে ভালোবাসা। আসলে পৃথিবীর যেখানেই আমরা থাকিনা কেন ভালোবাসার জোরেই মূলত: আমরা বেঁচে আছি। মানবপ্রেম ও ভালোবাসা থাকলে পৃথিবী ও প্রকৃতি সুন্দর হয়ে ওঠে। মানুষকে সেটা করতে হবে।
প্রবাসে আমরা বাংলাদেশের অনেক মানুষজন রয়েছি। পৃথিবীর সর্বত্রই আমাদের বাঙালী জনসমাজের বসবাস। বহিঃবির্শ্বের প্রান্তে প্রান্তে বাংলাদেশের মানুষ কষ্ট-ক্লেশ আর কঠোর পরিশ্রম করে অর্থ উপার্জন করছেন। জীবনবোধের উচ্ছ্বাসেই তারা নিজেদের পরিবার, সমাজ ও দেশের কল্যাণকর উন্নয়নে তারা যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এটা গৌরবের বিষয় যে, তাদের প্রেরিত অর্থেই বাংলাদেশের অর্থনীতির ভিত্তি সুপ্রতিষ্ঠিত ও শক্তিশালী হয়েছে। আমাদের ঐক্যবোধ ও সম্প্রীতির মাধ্যমে সেই গৌরবকে ধরে রাখতে হবে। বিদেশ-বিভূঁইয়ে আমাদের সাম্য-মৈত্রীর সুদৃঢ় বন্ধনকে অটুট রাখতে হবে। এজন্যে সমাজবদ্ধ জীবনের বিকল্প নেই। সমাজবদ্ধ জীবনধারায় একে অপরের মাঝে ঐকসূত্রিতা ও বন্ধন দৃঢ় করে। এভাবেই মানুষের জীবন পরিপূর্ণ ও স্বার্থক হয়ে ওঠে।
মানুষের মাঝে ঐক্যবোধ, মৈত্রী ও সাম্যবোধের মাধ্যমে অনেক অসাধ্যকে সাধন করা যায়। সমাজ ও মানুষের অনেক কল্যাণ সাধন করা যায়। প্রবাসে থেকেও অনেক বাংলাদেশী নিজ নিজ মাতৃভূমির বিভিন্ন অঞ্চলে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন এবং অসহায় মানুষের কল্যাণে অনেক কাজ করা যায়। মাটি, মানুষ ও শেঁকড়ের টানে তারা ছুটে যান আপন মানুষের কাছে। ইহাই আনন্দ-তৃপ্তি ও গৌরবের বিষয়। নিজের মাতৃভূমির প্রতি মমত্ববোধ আর ভালোবাসার মাধ্যমে আমাদের প্রিয় মানুষগুলোর হাসি-কান্না, সুখ-দু:খের সাথী হতে হবে। পৃথিবীর সর্বত্রই বাঙালীরা ছড়িয়ে আছেন। তাদের সাথে সম্পৃক্ততা, সদ্ভাব ও সুসম্পর্ক বজায় রাখাও ঈমানের অংশ। বাংলাদেশের মানুষের চিরায়ত সভ্যতা ও সংস্কৃতির সুপ্রাচীন ঐতিহ্যবোধ। এই গৌরববোধ আমাদের রা করতে হবে। তেমনই অন্যান্য জাতি কিংবা সর্বজাতির মানুষের উপলব্ধি ও অনুভবে দেশ, মাটি ও মানুষের প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শন করতে হবে। আমাদের অন্তরের ও বাহিরের সবটুকু বোধ-অনুভবে দেশপ্রেম ও মানুষকে ভালোবাসার মাধ্যমে আমরা যেন তার প্রমাণ দেখাতে পারি।
নিজেদের মধ্যকার মতবিরোধ ও দ্বন্দ্ব-বিবাদের ঊর্ধ্বে থেকে ঐক্যবদ্ধভাবে নিজ দেশের আর্থ-সামাজিক, মনস্তাত্বিক তথা সর্ব প্রকার মানবিক উন্নয়নের পথ সুগম করে তুলতে হবে। আর প্রেম হচ্ছে মানুষের চিরন্তন সঙ্গী। তাকে উপেক্ষা করা যায় না অবহেলা করা যায় না। মানুষের প্রতি মানুষের সহমর্মিতা ও হৃদয়ের ভালোবাসা সর্বোপরি প্রেমের আলোয় আমাদের ক্ষণকাল এবং অনন্তকালের পরিণতি পূণ্যময় হয়ে উঠুক। আজকের লেখাটির সারকথা তাই।
“মাটি আমার খাঁটিরে ভাই আমার জন্মভূমি
এমন মাটি পাবে নাকো কোথাও খুঁজে তুমি।”
লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক