১৯৭১ সালে মুজিবনগর সরকার যে ছয় সদস্যের উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করেছিলো, তাঁদের মধ্যে এতাদিন একমাত্র মোজাফফর আহমদই বেঁচে ছিলেন। উপদেষ্টা কমিটির অন্যান্য সদস্য ছিলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, মণি সিংহ, মনোরঞ্জন ধর ও খোন্দকার মোশতাক আহমদ। আহভায়ক ছিলেন মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। শেষোক্ত দুজন ছাড়া বাকি সবাই আওয়ামী লীগের বাইরের মানুষ এবং তিনজনই বামপন্থী। মওলানা ভাসানী ও মোজাফফর আহমদ ছিলেন ন্যাপের নিজ নিজ অংশের সভাপতি; মণি সিংহ কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান এবং মনোরঞ্জন ধর ন্যাশনাল কংগ্রেসের সভাপতি। তাজউদ্দীন আহমদ সবাইকে নিয়ে চলতে চেয়েছিলেন।
মোজাফফর আহমদের বয়স আর কয়েকবছর পরই শত বছর পূর্ণ হতো। স্ত্রী আমেনা আহমদ ন্যাপের সহসভাপতি ও সংরক্ষিত আসনে নবম ও দশম সংসদের সংসদ সদস্য।
মোজাফফর আহমদের জন্ম ১৯২২ সলের ১৪ এপ্রিল কুমিল্লা জেলার দেবীদ্বারের এলাহাবাদ গ্রামে। ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন। তার আগে ছিলেন একাধিক কলেজে। চুয়ান্নতে মাত্র ২২ বছর বয়সে মুসলিম লীগের এক মন্ত্রীকে পরাজিত করে প্রাদেশিক সভার সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। ১৯৫৭ সালের ৩ এপ্রিল পূর্ব পাকিস্তান ব্যবস্থাপক সভায় মোজাফফর আহমদ বলেছিলেন, ‘আজ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের যে প্রস্তাব আনা হয়েছে, সেটি আমাদের নেতা মওলানা ভাসানীর একক কিংবা কোনো একটি দলের দাবি নয়। এটি হলো পূর্ব পাকিস্তানের ৪ কোটি ২০ লাখ মানুষের দাবি। এটি আবেগের কিংবা ভোট লাভের স্লোগান নয়। এটি হলো প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র ও মুদ্রা ব্যতীত অভ্যন্তরীণ সব ব্যাপারে কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণমুক্ত এ অঞ্চলের পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা।’ পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধুর ছয় দফায় সেই স্বায়ত্তশাসন পূর্ণাঙ্গ রূপ পায়।
স্বাধীনতা-উত্তর রাজনীতিতে বামপন্থীদের বিচ্যুতি বা দুর্বলতা যত প্রকটই হোক না কেন, স্বাধীনতা-পূর্ব রাজনীতি তথা মুক্তিযুদ্ধে তাঁদের ভূমিকা খাটো করে দেখার উপায় নেই। ষাটের দশকের মাঝামাঝি বামপন্থীরা মস্কো ও বেইজিং এই দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়ে। মণি সিংহ, মোজাফফর আহমদ, খোকা রায়, মোহাম্মদ ফরহাদ, মতিয়া চৌধুরী, পঙ্কজ ভট্টাচার্য প্রমুখ ছিলেন মস্কো শিবিরে। আর বেইজিং শিবিরে ছিলেন মওলানা ভাসানী, কাজী জাফর আহমদ, রাশেদ খান মেনন, হায়দার আকবর খান রনো প্রমুখ। এ বিভাজন সত্তেও নিজ নিজ অবস্থান থেকে তাঁরা মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন।
মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রধান সংগঠক হিসেবে মোজাফফর আহমদ একাত্তরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে তার দল ন্যাপকে নিয়ে কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের সমন্বয়ে ২০ হাজারের বেশি মুক্তিকামী বাঙালিকে নিয়ে গড়েছিলেন বিশেষ গেরিলা বাহিনী। প্রশিক্ষণ শেষে এই বাহিনী ঢাকা, নরসিংদী, কুমিল্লা, নোয়াখালী, চট্রগ্রাম, রংপুরসহ উত্তরবঙ্গের রণক্ষেত্রগুলোতে সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। এ ছাড়া মোজাফফর আহমেদ জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে যোগদান করে স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্বজনমত গঠনেও সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিলেন।
জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ থেকে ‘আমাদের মুক্তিযুদ্ধ’ শিরোনামে প্রকাশিত বইয়ের ৪১ ও ৪২ পৃষ্ঠায় মোজাফফর আহমেদ নিজেই বলেছেন, ‘আমাদের মুুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে মার্কিন সামাজ্যবাদ, আরব মুসলিম রাষ্ট্রসমূহ প্রত্যক্ষভাবে এবং গণচীন পরোক্ষভাবে অবস্থান নিয়েছিলো। এই নাজুক পরিস্থিতিতে পরাশক্তির অন্যতম সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের জন্য অপরিহার্য হয়ে ওঠে। এই বাস্তবতা থেকে আমি এবং কমিউনিস্ট পার্টির অবিসংবাদিত নেতা কমরেড মণি সিং ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করি এবং তাকে বাংলাদেশ থেকে আগত শরণার্থীদের চাপের ভয়বহতা ও পরিণতির যথার্থতা বুঝিয়ে আন্তর্জাতিক সহায়তা, বিশেষ করে সোভিয়েত ইউনিয়নসহ সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর সহায়তা লাভে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালানোর জন্য রাজি করাতে সক্ষম হই। বিশ্বের স্বাধীনতা, মুক্তি ও শান্তিকামী মানুষের সমর্থন বাংলাদেশের পক্ষে আনার জন্য সেদিন বিশ্ব শান্তি পরিষদের সম্মেলনে যে প্রতিনিধি দল গিয়েছিলো, তার অন্যতম সদস্য ছিলেন ন্যাপ নেতা দেওয়ান মাহবুব আলী। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বাংলাদেশের পক্ষে আমি (মোজাফফর) উপস্থিত ছিলাম।