প্রায় তিন বছর পর অচেনা মুখের ভিরে চেনা সকালের জীবনে ফিরছি। ডনল্যান্ড থেকে সাবওয়ে নিয়ে বাথার্স্ট তারপর স্ট্রিটকারে কিং ওয়েস্ট। স্ট্রিটকার আমার প্রিয় রাইড। কেউ বসে,কেউ দাঁড়িয়ে, কেউ ঝুকছে, কেউ বইয়ের পাতায় চোখ দিয়ে আছে। চোখে চোখে কুশলমঙ্গল আর হাসিতে চেনাচিনি। এভাবে প্রতি কর্মদিবসে কমিউট করতে যেয়ে কত মানুষ পরিচিত হয়েছিল পথে আবার হারিয়েও গেছে এই পথেই।
কিং ওয়েস্ট নেইবারহুডের উপর দাঁড়িয়ে আমার দীর্ঘদিনের বিশ্বস্থ বন্ধু,কর্মস্থানের ঠিকানা ৫৫০ ওয়েলিংটন স্ট্রিট।কোভিডের কঠিন সময়ের সম্ভবত শেষপ্রান্তে এসে, সময় যেমন সভ্যতার জন্য দুয়ার খুলে দিচ্ছে তেমনি আমার বন্ধুটি তার আশ্রয়ে আমাকে গ্রহণ করেছে।ষোল তলার মনোরম নক্সায় নতুন রুপে সেজে উঠা ওয়ান হোটেল।বাহিরের প্রকৃতিকে, ইট,কাঠ,পাথরের ভিতরে যাপনকারী অতিথিদের সবুজের স্নিগ্ধতা অনুভব করানোর এক কনসেপ্ট, এস,এইচ হোটেলস গ্রুপের গর্বিত অংশ। লবি থেকে রুম, তিন হাজার আটশো লাইভ প্ল্যান্ট দিয়ে সজ্জিত। কঠিন ইমারতের ভিতরটা প্রকৃতির স্নিগ্ধতায় মুড়িয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা।
কোভিড আমাদের শিখিয়ে গেছে অনেককিছু তবে কেউ কেউ শিক্ষা নিয়েছি মাত্র সবাই না। অনেকেই হয়তো ফিরবো আবার নীতিহীন রাজনৈতিক কোলাহল, ধর্মের নামে হিংসা হলাহলে,কেউ গলা ভেজাবো পানিতে,কেউ আবার জলে।পরিবেশ,প্রকৃতি নিয়ে ভাবনার অবকাশ আমাদের নেই, সবাই চেষ্টাও খুব একটা করিনা। বিশ্বাসীজন যে মহামানবের উপদেশের আলোকে জীবন গড়ার উচ্চস্বরে জ্ঞান বর্ষন করেন এনারা তাঁর এই কথাটি কিন্তু সচরাচর বলতে শুনিনা,’যদি নিশ্চিত ভাবে জানো যে কেয়ামত এসে গেছে তখন হাতে যদি একটি চারা থাকে রোপণ করতে দেরি করো না’।এই কথা গুলো তাঁরা গভীরতা থেকেই বলে গেছেন।বহুকাল আগের বড় মানুষের কথা ‘যে কুঠার গাছ কাটে অথচ বন তাকেও ছায়া দিতে কার্পণ্য করেনা। পেয়ে অভ্যস্ত বিষয়ের প্রতি আমাদের দরদ জন্মায় না। মায়ের আঁচল সে তো মমতার ছায়ার জন্যই,এই সবুজ অরণ্য এই গাছ ছায়া দিবে তার জন্য এত ভাবতে হবে কেন?
হসপিটালিটি ইন্ডাস্ট্রির পনেরো বছরের অধিক সময়ে এই প্রথম দেখলাম পরিবেশ নিয়ে কেউ আমাদের ভাবনাটাকে নেভিগেইট করছে,সবুজের দিকে সবুজের পথে।কর্মদিবসের ব্যাস্ততা, চিনেমাটির ক্রুকারিজের রুনঠনের মাঝে, দেয়ালে, সেলভে, সাইড ষ্টেশনে সবুজের সমারোহ।আমার বোবা মানে মূক বন্ধু এরা, কোন কথা নেই শুধুই শীতলতা।যেন কঠোরের প্রচ্ছন্নে মধুরিমা আর প্রশান্তির আয়োজন।
বহুজাতিক কোম্পানী মুনাফার মধ্যদিয়ে প্রতিষ্ঠানের বিকাশের পাশাপাশি পরিবেশের প্রতিদায়বদ্ধতা থেকে যে কাজটি করছে তা হয়তো অনেকের বোধ জাগাতে পারে যারা গাছ কেটে,ছেটে প্রকৃতিকে রুষ্ট করে তুলেছেন আর উন্নয়নের নামে গাছ কেটে চলেছেন।
ওয়ান হোটেল এই কানাডায় একমাত্র যারা প্রতিদিনে জমানো খাবার কমপোষ্ট করছে, অবশ্য সিটিও এতে সহায়তা করছে।ছয় সপ্তাহ পর যে জৈব সার বের হবে তা ব্যাবহার করা হবে হোটেল রুম, লবি, রেসটুরেন্টের সজ্জিত প্রতিটি গাছে।
এবার আসি কর্মস্থান থেকে বাসা বাড়ির দিকে।আমাদের নেইবারহুডের কোন একটি গাছ কাটতে গেলে সিটি থেকে পারমিশন নিতে হয়। যে বাড়ির সামনে অন্তত একটি গাছও নেই সিটি নিজ দায়িত্বে গাছ লাগিয়ে যায়।এ তো হলো কানাডিয় নাগরিক জীবনে, গাছ,ও প্রকৃতি ভালবাসার কথা।গাছ বাঁচাতে কিংবা প্রকৃতি বাঁচাতে বড় বড় আন্দোলন ভারতীয় উপমহাদেশেই হয়েছে।
রাজস্থানের যোধপুরের জলনদী গ্রামে রাজা অভয় সিং এর সৈন্যরা গাছ কেটে রাজপ্রাসাদ নির্মান করতে চাইলে ঐ গ্রামের প্রকৃতি পূজারী মানুষ অমৃতা সিং এর নেতৃত্বে রাজার সৈন্যদের কুড়ালের সামনে গাছকে আলিঙ্গন করে দাঁড়িয়ে ছিলেন,এগিয়ে এলেন অমৃতার তিন কন্যা, এই ঘটনায় তিনশতাধিক নিহত হয় এবং অমৃতা সিং বৃক্ষের জন্য ইতিহাসের প্রথম শহীদ হন।রাজা অভয় সিং ঘাবড়ে গিয়ে রাজপ্রাসাদ নির্মান বন্ধ করেন এবং ক্ষমা প্রার্থনা করেন।
আমরা ভুলিনি নর্মদা আন্দোলনের মেধা পাটেকর কে।
আমাদের ধমনিতে তাদেরই রক্ত, চট্রগ্রামের শিরীষতলায় শতবর্ষী বৃক্ষ বাঁচাতে মানুষের জাগরণের ধবল প্রহর আমাকে সেইসব প্রকৃতি পূজারীদের কথা মনে করিয়ে দিয়েছে।শেষ রক্ষা হবে কি হবেনা তা জানিনা তবে এটুকু জেনে ভালো লাগছে কেউ কেউ কথা বলছেন।হতে পারে কেউ পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনকারী,কেউ প্রকৃতি প্রেমি কিংবা বৃক্ষ পূজারী। যদি কোন বিশ্বাসের নামে গাছ বেঁচে থাকে থাকুক।
ছোট বেলার অভিজ্ঞতা।আমাদের বাজার থেকে মাইল দূরে শরৎ পুর গ্রামে প্রায় শতবর্ষী এক গাছের শাখা থেকে হঠাৎ ফোঁটা ফোঁটা সাদা জল পড়তে শুরু করলো যার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা কোনদিন খুঁজিনি।অতিউৎসাহী কেউ একজন বললো এই গাছের নিচে মহিলারা কৃষ্ণের পূজা দিত তাই এটা কৃষ্ণের গাভীর দুধ এবং সেই থেকে নাম হয়ে গেল কৃষ্ণতলা।এরপর অবশ্য আর এর পুনরাবৃত্তি হতে শুনিনি তবে কৃষ্ণের দোহাই দিয়ে হলেও গাছটি তো রক্ষা পেলে।একইরকম আমাদের বাজারে আরো দুটি শতবর্ষী বটতলা আছে আজো দাঁড়িয়ে একটি শারফিনের নামে আরেকটি কালির নামে।জ্ঞাত কিংবা অজ্ঞাত সে যেভাবেই হোক পরিবেশ,বন,বৃক্ষের প্রতি মায়ার কোন বিরুপ ফলনেই।
করোনা উত্তর পৃথিবীতে দয়াবান বৃক্ষ বাঁচাতে আমরা যেন আরো দায়িত্বশীল হই।
‘অন্ধ ভূমিগর্ভ হতে শুনেছিলে সূর্যের আহ্বান
প্রাণের প্রথম জাগরণে, তুমি বৃক্ষ, আদিপ্রাণ,’।
হিমাদ্রী রয়।