জসিম মল্লিক
লেখক পরিচিতিঃজন্ম বরিশাল শহরে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেন। কলেজ জীবন থেকেই তাঁর লেখালেখির শুরু এবং দেশের বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক ও সাপ্তাহিক-এ নিয়মিত লিখছেন। ১৯৮৩ সালে তৎকালীন সাপ্তাহিক বিচিত্রায় কাজের মধ্য দিয়ে তার সাংবাদিকতার শুরু। দীর্ঘ প্রায় চল্লিশ বছরের সাংবাদিকতা ও লেখালেখির অভিজ্ঞতা।এ পর্যন্ত তার প্রায় পঁয়ত্রিশটির মতো গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।
১
মাঝে মাঝে মনে হয় কতকাল ধরে এই পৃথিবীতে বেঁচে আছি। পৃথিবীর পথ ধরে চলছি। চলতে চলতে কতজনকে আপন করেছি, কত আপনজন হারিয়েছি। আবার আপন করেছি। আবার হারিয়েছি। বুঝতে পারিনা পাওয়ার নাম জীবন না হারানোর! এই যোগ বিয়োগের হিসাব সহজে মেলে না। চলতে চলতে কিছু মানুষ হারায়, কিছু মানুষ থাকে। আসলে জীবনে কী থাকে! শেষ পর্যন্ত কিছুই কী থাকে! এভাবে দিন চলে যায়। কিছুতেই সময়ের রাশ টেনে ধরে রাখা যায় না। কখনও কখনও সময় অনড় পাথরের মতো চেপে বসে। মনে হয় স্থবির হয়ে আছে পৃথিবীর সবকিছু। কোনো গতি নেই, আবেগ নেই, ভালবাসা নেই, পাওয়া নেই। চোখ বুজলেই আজকাল একটা ঘোলা জলের স্রোত দেখতে পাই। একটা নদী। নদীটা খুব চওড়া নয়। দু’পাড়ে মাইল মাইল জুড়ে নির্জনতা আর গরান গাছ, বাবলা বন। একদিকে ভাঙা পাড়ের মাটির মধ্যে খাঁজে খাঁজে ইট। কোনও এক স্থাপত্যের ধ্বংসস্তুপ। পাখি ডাকছে। নৌকো চলেছে ধীরে, উজান ঠেলে। জোয়ারের জল তীরের ঘাসপাতা ডুবিয়ে ছলাৎ ছল শব্দে ভাঙছে। গোসাবার পর অই নির্জনতা আর নির্জনতা ছাড়া কিছু নেই। সে এক গহিন প্রাকৃত জগৎ। মায়ের সাথে ওই নদী দিয়ে কতবার গিয়েছি নৌকায়। আজকাল বারবার সেই নদীটার কথা মনে পড়ে। আর খুব স্নিগ্ধ হয়ে যায় মন। কে যেনো মলম মাখিয়ে দিয়ে যায় হৃদয়ের ছেঁড়া খোঁড়া ক্ষতস্থানে। মায়ার কাজল পরিয়ে দেয় চোখে।এখন মা নেই। নির্জন সেই নদী সারাদিন এলোচুলে পা ছড়িয়ে বসে মৃত্যুর গান গায়। চারদিকে নিস্তব্দ এক উপত্যকা, দু’ধারে কালো পাহাড়ের দেয়াল উঠে গেছে আকাশে। এই বিরলে শুধু মাঝে মাঝে দীর্ঘশ্বাসের মতো হু-হু বাতাস বয়ে যায়। অজস্র সাদা ছোট বড় নুড়ি পাথর চারদিকে অনড় হয়ে পড়ে আছে। খুব সাদা, নীরব, হিম, অসাড় সব পাথরের মাঝখান দিয়ে সেই্ নদী- উৎস নেই, মোহনা নেই। সারাদিন এখানে শুধু তার করুন গান, বিলাপের মতো। কিছু নেই, কেউ নেই। শুধু হাড়ের মতো সাদা পাথর পড়ে থাকে নিথর হয়ে উপত্যকা জুড়ে এক মুত্যুর সম্মোহন। এলোচুলে পা ছড়িয়ে বসে নদী অবিরল গান গেয়ে যায়। সেই নদী কী করে আস্তে আস্তে হয়ে গেলো মুত্যু নদী। এত সুন্দর একটি নিসর্গ দৃশ্যকে মুত্যুর রং মাখালো কে? চারদিকে হিম সাদা অনড় পাথড়, নির্জন উপত্যকা আর মোহনাহীন এক নদী সেই থেকে আমার সঙ্গে আছে।
২.
আমার মধ্যে ভাবাভাবির একটা বাতিক আছে। অনেকের কাছে যা অপ্রয়োজনীয় সেসব নিয়েও আমি ভাবি। আমার কথা কেউযে খুউব মন দিয়ে শোনে তা না, আমি খুউব বেশী মানুষের সাথে আমার কথা শেয়ার করি না। আমার কথা বলার বেশী মানুষ নেই। আমার কথা শোনার মানুষেরও অভাব। সেজন্য আমার মধ্যে কোনো অনুতাপ নেই। আমি এটা জেনে গেছি যে আমাকে বোঝার মতো মানুষ আমি কখনও পাবোনা। নানা ধরনের ভাবনা নিয়ে কখনও কখনও উদাসীন হই, বিমুগ্ধ হই। কখনও কখনও লিখি। এলেবেলে সে সব লেখা। আজকাল এমন হয়েছে যে লিখতে বসলেই পুরনো স্মৃতি ভেসে উঠে। আমি ছিলাম খুব সাধারন। কিন্তু আমার স্মৃতিগুলো ছিল অসাধারন। একবার আমার খুউব অসুখ হয়েছিল। জ্বরের ঘোরে প্রায়ই আমি অবচেতন হয়ে থাকি। এরকম এক ঘোরলাগা দুপুরে মা এসে আমার পাশে শুলেন। আমি মাকে বলছিলাম, ’মা, আমার মাঝে মাঝে মনে হয় আর জন্মে আমি লেবুগাছ ছিলাম। এই যে আমার হাত দেখছেন, পা দেখছেন এসব ছিল ডালপালা। আর কুনুই, কবজি, কন্ঠা, বুক পিঠ ছিল অজস্র কাঁটা। কান নাক হাতে, তেলো ছিল সবুজ সুগন্ধি পাতায় ছাওয়া। তখন আমার শরীর জুড়ে সাদা সুঘ্রাণ ফুল ফুটত। আর ফুল ঝরে গিয়ে কচি কচি সবুজ তাজা লেবু ফলত। আমি যখন লেবু গাছ ছিলাম তখন আপনি ছিলেন এত্তোটুকু ফুটফুটে একটা মেয়ে, আর রোজ গিয়ে লেবু ছিঁড়তেন আমার ডালপালা থেকে। আমার খুব দুঃখ ছিল যে আমার কোনো ঘর নেই, দালান নেই, শীতে গ্রীষ্মে বর্ষায় রোদে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয় এক জায়গায়, কোথাও যাওয়ার জো নেই। আর তখনই আপনাকে দেখে আমি মনে মনে ভাবতাম, এবার একদিন আমি মরে যাবো। তখন এই ফুটফুটে মেয়েটার বিয়ে হবে আর আমি ওর কোলে আসব ছেলে হয়ে।’ মা আমার কথা খুব মন দিয়ে শোনে আর তার চোখ ছল ছল করে। বলে, তোর মাথায় ঘুঘু ডাকছে আবার।হ্যাঁ আমার মাথায় মাঝে মাঝে ঘুঘু ডাকে। আমার সত্যি আজও কোনো ঘর নেই, দালান নেই। এসব নিয়ে আমি কখনও ভাবিওনি। মা বুঝতে পারতেন। আমাকে বৈষয়িক হতে বলতেন। একটা বাড়ির কথা বলতেন সবসময়। এটা মায়ের একটা অবসেশন ছিল। বলতেন একটা বাড়ি করবি জলপাই তলায়, পুরো চোদ্দ কাঠা জমির ঘেরওলা, ছ’টা আম, চারটে কাঁঠাল, একটা ডুমুর, সজনে, দশটা সুপুরি আর দশটা নারকোল গাছ লাগাবি, পিছনে থাকবে কলার ঝাড়। কুঞ্জলতা আমার বড় পছন্দ, বুঝলি! বেড়ার গায়ে গায়ে লতিয়ে দেব। তুই তো সিম খেতে ভালবাসিস- একটু সিমের মাচান করবি, গোয়ালঘরের চালের ওপর লকলকিয়ে উঠবে লাউডগা। তখন মায়ের সেসব কথাকে অর্থহীন মনে হয়েছিল। এখন আর তা মনে হয় না।
৩.
সেটা ছিল এক ভোরবেলা। শীতের তখন শুরু। একটা প্রকান্ড পোড়ো মাঠ আর ঢেউ ঢেউ টিলার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। নীল আলোয় মাখামাখি আকাশ, লুটোপুটি অঢেল নরম রোদ। মহুর্তের মধ্যে আমি গলে যাই, মিশে যাই চারধারের সাথে। সেই যে স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম সে থেকে আজও সেইখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে আছি যেনো। যেনো কোনোদিনই পুরোপুরি ফিরে আসতে পারিনি। হঠাৎ হঠাৎ মনে পড়ে, মনে হয়, একটা বিশাল শালগাছের ছায়ায় আমি দাঁড়িয়ে, চারদিকে ঢাউস ঘুড়ির মতো বড় বড় পাতা খসে পড়ছে শীতের বাতাসে, আর আলোর পুকুর থেকে উঠে আসছে পৃথিবীর টিলার ঢেউ, আর অকাজের পোড়ো মাঠ চিত হয়ে শুয়ে আছে নিশ্চিন্তে। ছলাত ছলাত শব্দে মাঝি যখন নৌকো চালিয়ে যেতো আমি নৌকোর গুলুইর সামনে গিয়ে বসে থাকতাম। দিগন্ত বিস্তৃত ধু ধু মাঠ ঘাট পানিতে ডুবে যেতো। তার উপর বড় বড় ঢেউ উঠত। মনে হতো যেনো মাহাসাগর। নৌকোর পাশ কেটে সরাত করে চলে যেতো ঢোরা সাপ। মা ভয় পেতেন, বলতেন ভিতরে আয় পরে যাবি। কিন্ত আমি ভয় পেতাম না। আমি খুউব ভালো সাঁতার কাটতে জানতাম। নদী আমার বড় আপন। এখনও আমি মাঝে মাঝে স্বপ্ন দেখি একটা খুব বড় নদী, তার এপার ওপার দেখা যায়না। তার একধারে একটা বিরাট বালিয়াড়ি, আর একটা স্টিমার বাঁধার জেটি। সেখানে কেউ নেই। বালির ওপর একটা কেবল সাপের খোলস পড়ে আছে। মা মারা যাওয়ার পর থেকে এই স্বপ্ন দেখি আমি। এক দিন ঘুমের মধ্যে ওই স্বপ্ন দেখে জেগে উঠি। আবার ঘুমোই, আবার সেই স্বপ্ন। বারবার স্বপ্নটা দেখে আর ঘুম হয় না। শুধু উঁচু বালিয়াড়ি, ধু ধু বালি গড়িয়ে নেমে গেছে, বলির শেষে দূর থেকে একটা কালো জেটি দেখা যায়। তারপর জল। খুব অথৈ জল, অনন্ত জল, প্রকান্ড নদীটা, তার ওপর কালো আকাশ ঝুঁকে আছে..।