হিমাদ্রী রয় সঞ্জীব।
আমাদের জীবন দুটি। একটি নিত্য রথ টানার মত থেমে থেমে চলে। আরেক ভার্চ্যুয়াল জীবন। সবকিছু টিপটপ, সুখি গৃহকোণের ডিসপ্লে, দিবসে ঘেরা। কোন দিবসে জাতীয়তাবাদ জাগে, কোনটায় কর্তব্য, কোনটায় ভালবাসা আর কোনটায় আহারে-বাহারে। সেখানে আমাদের প্রোফাইল গুলোও ঝকঝকে তকতকে স্টার জলশার সিরিয়েলের মতো। আমিও কিন্তু এর বাইরে নই। আজ বরং পুশ স্টার্টার জীবন অর্থাৎ দৈনন্দিন বাস্তবিকের যাপিত জীবনের কথা বলি।
এই জীবনে সুখ গুলি তাকে তাকে সাজানো থাকে না, ভার্চ্যুয়ালের মত। সুখ কি আর আপনি উদয় হয়? খেটে খুটে তৈরি করতে হয়, বাগানের মত রোদে পুড়ে জলে ভিজে।এই বাগানের কথাই ধরি, আমি নিজে মাটি কেটেই দায় মুক্তি এর পর চারা রোপণ, সময় -সময় নিড়ানি দিয়ে গাছের গোড়ায় ম্যেনুর দেয়া, আগাছা পরিস্কার করা যাতে গাছেরা বাড়তে পারে। গাছ গুলি ও এবার আমাদের নিরাশ করেনি, বউয়ের পরিচর্যায় লাউ,ঝিঙে, শশা, সিম, কুমড়া বেশ লতিয়ে উঠেছে। স্ট্রবেরি গাছে ছয়টি ফল এসেছে,বউ তা পেড়ে ধুয়ে প্লেটে সাজিয়ে রেখে বললো, বিবাহবার্ষিকী’তে তার যত্নের উপহার। মুখে পুরতেই টের পেলাম বেজায় টক, বউ জানতে চাইলো How is it বললাম খুব মিষ্টি। বাজার থেকে আসলে টক কে টক আর মিষ্টি কে বলতে সমস্যা হয় না, সেটা আমি বলি। Anniversary স্ট্রবেরি কে টক বলে দাম্পত্যকে খাদের কাছে দাঁড় করানো বুদ্ধিমানের কাজ নয়।
১৭ বছরের বিবাহিত জীবনে ঠুকাঠুকির কিচ্ছা যেমন আছে,সুখের হিস্যাও আছে যেটা সবার জীবনেই থাকে শুধু ফেইসবুকের জীবন ছাড়া। ভার্চ্যুয়াল জীবনে ঐদিন অনেকেই ছুটি থাকে, সুখি গৃহকোণের কিছু গল্প আর কিছু ছবি পোস্ট করার পর, শ পাঁচেক লাইক আর দু’শ কমেন্টস পড়তে পড়তে হঠাৎ খেয়াল হয় আরো একটি দিন চলে গেলো জীবন থেকে। বিবাহিত জীবনের স্মরণ কালের ইতিহাসে যতদুর মনে পড়ে, শহরের বাইরে না থাকলে দুজনেই কোনদিন কাজে ছুটি নেইনি। অনেকবার হয়েছে এমন ম্যানেজার একগুচ্ছ ফুল হাতে দিয়ে জানতে চেয়েছে কাল বিবাহবার্ষিকীতে বন্ধ চাই কিনা? বলতাম বিবাহিত জীবনটা কে জেলের কয়েদির মত দেখতে চাইনা। স্পেশাল ঐদিন ডালের বদলে মাংস দেয়া হবে। আমাদের বিবাহিত জীবন লম্বা ঝুলের মতো কখনো মাছের দেখা মিলে কখনো সব্জিতেই চলে অভিযোগ নেই; ম্যানেজার হাসতো।
আজও ব্যাতিক্রম ছিলোনা, করোনার কারণে কোলাহল বারন তাই ছুটিতে বাইরে যাওয়ার কোন প্ল্যান ছিলো না। আস্তে আস্তে চাকা ঘুরছে অর্থনীতির, বউও জয়েন করেছে কাজে। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই প্রথম কাজ হলো ব্যাকইয়ার্ডে বাগানে ঢু-মারা। বউ মগ্ন গাছের চারপাশ নিরানিতে, সবুজ লতানো লাউয়ের ডগা যেন জড়াতে চাইছে তার কানের লতি পরম সোহাগে।পাশেই দোলনায় দুলছে আমাদের ১৭ বছরের চাষাবাদের একমাত্র ফসল,আমার রেড ওয়াইনের আঙুরফল আমাদের জশ।
বাগানে পানি ঢালা শেষে বউ আমাদের বাপ-ব্যাটা কে প্রাতরাশের টেবিল সাজিয়ে ঠোঁট ডুবানো ভালোবাসা দিয়ে অতঃপর কাজে যাত্রা। কিন্তু যেতে যেতে মনে করিয়ে দিয়ে গেলো হানি আমি আমাদের দিবস পাব্লিক করতে চাইনা। বললাম ডোন্টওয়ারি আমি কখনই বলবো না যে কতরাত দাঁত ব্রাশ না করে ঘুমিয়ে পড়েছি,ঘুম থেকে তুলে,ঘুম ঘুম চোখে ব্রাশ করতে বাধ্য করেছে বউ। ১৭ বছর পর আজো মাঝে মাঝে তা করি বদভ্যাস এ জন্যে নয়। মাঝরাতে বউয়ের চেঁচামেচি বেশ এনজয় করি। এই চেঁচামেচি কবে যে ভালোবাসা হয়ে উঠেছে বুঝতেই পারিনি।
এমন অনেক হয়েছে অশান্তি চরমে উঠেছে তাতে কি, এই দেশে যেমন হয়, মরতা কই ওর, ভরতা কই ওর। এই যেমন কদিন আগে কালো লোকটি মারা গেলো দায়ী রাষ্ট্র কিন্তু ভোগান্তি হলো ষ্টোর মালিকদের। আমার রাগ যত ঐ সিরামিক আর কাঁচের বাসনের উপর, যত বেশি শব্দ তত শান্তি। সে ক্ষেত্রে বউয়ের রাগ প্রশমনের ধারা ভিন্ন। সে ঘরে মোবাইল রেখে ঘন্টা তিনেকের জন্য উধাও,কখনো তারও বেশী। যত বেশি হাঁটবে তত রাগ তরল হতে থাকবে।
তবে ভালোবাসা টা কোথায়? প্রেম কি যাচিলে মিলে,জাগাতে হয় তবেই পরশ লাগে দিলে। “বাইরে থাকুক মধুর মূর্তি , সুধামুখের হাস্য, তরল চোখে সরল দৃষ্টি— করব না তার ভাষ্য। মুখের মধ্যে যে টুকু পাই যে হাসি আর যে কথটাই, যে কলা আর যে ছলনাই তাই নে রে মন তাই নে”। জীবন সংগ্রাম,মান-অভিমান চলমান, এর ভিতর থেকেই ভালবাসার নির্জাস টকু খুঁজে নিতে হয়। যাত্রীর সরগোল, হকারদের হাঁকাহাঁকি, প্যেসেঞ্জারের সাথে টিকিট চেকারের কথা কাটাকাটি এড়িয়ে, হাওরার রেলগাড়ির সেই অন্ধ গায়কের মধুর গান কানে আসে যেভাবে “কি অত বিচার করা, অবিচারের ভয় করে যে, কি অত হিসাব করা বেহিসাবের ভুল ধরে যে, ও আমার মন যমুনার অঙ্গে অঙ্গে ভব তরঙ্গে কতই খেলা,বধু কি তীরে বসেই মধুর হেসে দেখবে শুধু সারাবেলা”।