সুব্রত কুমার দাস
২০১১ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মের ১৫০তম বর্ষ পার হয়েছে। আর ১৯৯৯ সালে কাজী নজরুল ইসলামের জন্মের ১০০ বছর পার হয়েছিল। এদের একজন বিশ্বকবি হিসেবে বন্দিত। আরেকজন আমাদের জাতীয় কবি নামে নন্দিত। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের এই দুই প্রধান পুরুষ ত্রিশ কোটি বাঙালির গর্ব যা মাঝে মাঝে ধূলায় লুণ্ঠিত
হয় কিছু বেহিসেবি ও স্বার্থান্বেষী মানুষের হঠকারী মূল্যায়নে যারা পূর্বাপর কিছু না ভেবেই তুলনা করে বসেন এই দুই বিপুল প্রতিভাধর ব্যক্তিকে। কিন্তু আমাদের সকলেরই জানা আছে যে রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুল দুজনেই তাঁদের নিজ নিজ আসনে মহীয়ান এবং বাংলা ভাষায় মহান সে-দুই লেখক ছিলেন পরস্পরের শ্রদ্ধা-ভালোবাসার পাত্র।
ধরা যাক, রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কার সময়ের কথা। সেটি ১৯১৩ সাল যখন কবির বয়স বায়ান্নো বছর। সে সময় কাজী নজরুল ইসলামের বয়স মাত্র চৌদ্দ। অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ যখন বিশ্বজয় করে বেড়াচ্ছেন, নজরুল তখন লেটো দলে গান করছেন বাংলার গ্রাম গঞ্জে। প্রকাশিত হয়নি একটি কবিতাও। এই বাস্তব সত্যকে অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। আবার নজরুল যখন ‘বিদ্রোহী’ কবিতা লেখেন সেটা ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাস। সে পর্যন্ত নজরুলের উপন্যাস বাঁধনহারা, গল্পগ্রন্থ ব্যথার দান এবং কিছু কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হলেও, ‘বিদ্রোহী’ দিয়েই শুরু হয় তাঁর দ্রোহী প্রকাশ। সে সময় রবীন্দ্রনাথ ছুটে বেড়াচ্ছেন ইউরোপ-আমেরিকার দেশে দেশে, বক্তৃতা করে বেড়াচ্ছেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে, বিশ্ব সংস্কৃতিকে কেন্দ্রিভূত করার চেষ্টা করছেন শান্তিনিকেতনের প্রকৃতিতে। পূর্বাপর না ভেবেই যদি আমরা সে দুই কীর্তিমানকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে ফেলি তাহলে তা কি ইতিহাসকে বিকৃত করা হয় না?
১৯২৭ সালে প্রকাশিত নজরুলের ‘বড়র পিরীতি বালির বাঁধ’ প্রবন্ধের দিকে চোখ ফেরালে আমরা দেখতে পাই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের জন্য বিদ্রোহী কবি নজরুলের কি অসীম শ্রদ্ধা। তিনি লিখেছেন ‘বিশ্বকবিকে আমি শুধু শ্রদ্ধায় নয়, পূজা করে এসেছি সকল হৃদয়-মন দিয়ে, যেমন করে ভক্ত তাঁর ইষ্ট দেবতাকে পূজা করে। ছেলেবেলা থেকে তাঁর ছবি সামনে রেখে গন্ধ ধূপ-ফুল-চন্দন দিয়ে সকাল-সন্ধ্যা বন্দনা করেছি’। নোবেল বিজয়ী বিশ্ব পরিব্রাজক রবীন্দ্রনাথের সাথে ১৯২১ সালে উদীয়মান শক্তির প্রতিভূ কাজী নজরুলের প্রথম দেখা থেকে শুরু করে ১৯৪১ সালে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর্যন্ত দুই দশকে এই দুই মহাজনের বহুবার সাক্ষাৎ ঘটেছে। বহু মাখামাখি, রাগ-বিরাগ ঘটেছে সন্দেহ নেই। আমাদের দুর্ভাগ্য সে সবের সাল-তারিখ সহ পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ রবীন্দ্রনাথ বা নজরুল কেউই লিখে রাখেননি। সমকালীন অন্য যে লেখকেরা বিবৃত করেছেন, সেগুলোর খন্ডিত বলেই হয়তো আমাদের ভাবনা বারবার খন্ডিত হয়ে যেতে চায়। অহেতু আমরা বিতর্কে যেতে চাই এই বলে যে, রবীন্দ্রনাথ বাংলাদেশের কবি নন। কিন্তু আমরা ভুলে যায় যে জন্মসূত্রে নজরুলও কিন্তু বর্তমান বাংলাদেশ সীমানার মানুষ নন। তাঁদের দু’জনেরই প্রধান পরিচয় তাঁরা বাংলা ভাষার কবি, তাঁরা বর্তমান বাংলাদেশ অঞ্চলে বারবার এসেছেন, জীবনের দীর্ঘ সময় এ মাটিতে কাটিয়েছেন, তাঁদের দু’জনের সাহিত্যই বাংলাদেশের প্রকৃতি ও মানুষ দিয়ে পরিপুষ্ট।
একথা সর্বজন স্বীকৃত ১৯২১ সালের কোন এক সময় রবীন্দ্রনাথের সাথে নজরুলের প্রথম সাক্ষাৎ ঘটে। বারবার দেখা-সাক্ষাতের ভেতর দিয়ে তাঁদের দুজনের সম্পর্ক ক্রমেই শ্রদ্ধা ও প্রীতির সম্পর্কিত রূপ নিয়েছিল। সে বছর রবীন্দ্রনাথের ৬০তম জন্মদিন পালন উপলক্ষে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ যে আয়োজন করেন, সেখানে মঞ্চে রবীন্দ্রনাথই নজরুলকে পাশে ডেকে বসিয়েছিলেন। মনে রাখতে হবে নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কিন্তু ততদিনেও প্রকাশিত হয়নি, যদিও অন্যান্য রচনাতে তাঁর প্রতিভার স্ফুরণ থেমে নেই। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের ব্যক্তিগত যোগাযোগ ও বিভিন্ন সময়ের আলাপন ইঙ্গিত পেয়েছে বহু জনের বহু লেখাতে। প্রভাতকুমার মুখোপাধায়ের রবীন্দ্রজীবনী, শান্তিপদ সিংহের নজরুল কথা, আজীজ আল আমানের নজরুল পরিক্রমা, গোপালচন্দ্র রায়ের রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল, প্রাণতোষ চট্টোপাধ্যায়ের কাজী নজরুল প্রভৃতি গ্রন্থগুলো এ বিষয়ে আমাদের ধারণা তৈরিতে সাহায্য করে।
১৯২২ সালের ১১ আগস্ট নজরুল প্রকাশ করেন অর্ধসাপ্তাহিক কাগজ ধূমকেতু। প্রথম সংখ্যাতে সেটি ছাপা হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের আশীর্বাণী নিয়ে। ধূমকেতু যে নজরুল নিজেই তা বোধকরি বুঝতে ভুল করেননি রবীন্দ্রনাথ। আর তাই নজরুলকে সম্বোধন করে আশীর্বাণীতে তিনি লিখলেন:
আয় চলে আয়, রে ধূমকেতু
আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু,
দুর্দ্দিনের এই দুর্গশিরে
উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন।
রবীন্দ্রনাথের সে-লেখা পত্রিকাটির প্রতিটি সংখ্যায় ছেপে গুরুকবি রবীন্দ্রনাথের প্রতি অনুজ কবি সম্পাদক নজরুল যে শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেছিলেন তা যেন আমরা ভুলে না যাই।
রবীন্দ্রনাথের জীবিত অবস্থায় তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে নজরুল লিখেছিলেন চারটি কবিতা। সেগুলো হলো: ‘কিশোর রবি’, ‘১৪০০ সাল’, ‘তীর্থপথিক’ এবং ‘অশ্রæপুষ্পাঞ্জলি’। ‘১৪০০ সাল’ হলো রবীন্দ্রনাথের ‘১৪০০ সাল’ কবিতার নজরুলীয় উত্তর। আর জ্যেষ্ঠ কবির মৃত্যুর পর শোক ভারাক্রান্ত নজরুল লিখেছিলেন পাঁচটি কবিতা। ১৯৪১ সালে যেদিন রবীন্দ্রনাথ প্রয়াত হন সেদিনই ‘রবিহারা’ কবিতাটি লেখেন নজরুল। সে কবিতাতে নজরুলের বেদনার প্রকাশ এমন:
বিদায়ের বেলা চুম্বন লয়ে যাও তব শ্রীচরণে,
যে লোকেই যাক, হতভাগ্য এ বাঙালীরে রেখো মনে।
যাঁরা নজরুলের পুরো সাহিত্যকর্ম পড়েছেন, তাঁরা জানেন কত জায়গাতে নজরুল রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন, বিশেষ করে গান থেকে উৎকলন করেছেন। নজরুলকে তো সমসাময়িক মানুষেরা ‘রবীন্দ্রসঙ্গীতের হাফেজ’ বলেই সম্বোধন করতেন।
বাংলা সাহিত্যের ক’জন কবির এমন দুর্ভাগ্য ঘটেছে যে কবিতা লেখার জন্য তাঁকে জেল খাটতে হবে? নজরুলের ঘটেছিল। ‘ধূমকেতু’ পত্রিকাতেই তিনি প্রকাশ করেন তাঁর কবিতা ‘আনন্দময়ীর আগমনে’। ১৯২২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত সে কবিতার নামকরণও কিন্তু ঘটেছে রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতার প্রথম লাইন দিয়ে। জেল হলো নজরুলের। জেলে বন্দী কবিকে অভিনন্দিত করতে রবীন্দ্রনাথ প্রকাশ করলেন বসন্ত গীতিনাটকটি। উৎসর্গ করলেন নজরুলকে। জেল সুপারের অপমান অত্যাচারের প্রতিবাদে ১৯২৩ সালের ১৪ এপ্রিল নজরুল অনশন শুরু করেন। উদ্বিগ্ন রবীন্দ্রনাথ টেলিগ্রাম পাঠালেন এরাব Give up hunger strike, our literature claims you. ’ যদিও সেটি নজরুলের হাতে পৌঁছায়নি জেল কর্তৃপক্ষ। অভিমান হয়েছিল নজরুলের যে রবীন্দ্রনাথ তাঁর খোঁজ নেননি। আর সে অভিমানের ফসলই তো ‘বড়র পিরীতি বালির বাঁধ’। অভিমানের বিষয়টি ভুল বোঝাবুঝিতে রূপ নেওয়াও অসম্ভব নয় যখন ১৯২৪ সালে মুসলমান নজরুল বিয়ে করতে মনস্থ করলেন হিন্দু ধর্মাবলম্বী প্রমীলাকে। তবে সে-সব অভিমান আর ভুল বোঝাবুঝি যে কেটে গিয়েছিল তারও নিদর্শন বর্তমান। ১৯২৮ সালে প্রকাশিত নিজের শ্রেষ্ঠ সাহিত্য কর্ম সঞ্চিতা রবীন্দ্রনাথকেই উৎসর্গ করেন কবি। অন্যদিকে ১৯৩৮ সালে রবীন্দ্রনাথ সম্পাদিত বাংলা কাব্য পরিচয় গ্রন্থে নজরুলের তিনটি কবিতা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল।
ইতিহাস বলে, পরবর্তীকালের সাহিত্যিকদের লেখাকে রবীন্দ্রনাথ অনুমোদন করতে দ্বিধান্বিত ছিলেন। তরুণ কবিদের জন্য তার সে দ্বিধার অন্যদের সাথে নজরুলের প্রতিও প্রসারিত ছিল কি না তা জানা যায় না। তবে উত্তরকালের সাহিত্যিকদের মধ্যে নজরুলকেই রবীন্দ্রনাথ সম্ভবত সবচেয়ে বেশি স্নেহপাশে বেঁধেছিলেন। আমাদের বামন দৃষ্টিতে মহীরুহসম সে দুই কালজীয় সাহিত্যিকের ব্যক্তিগত সম্পর্ক তাই হয়তো বারবার কলঙ্কিত হতে পড়তে চায়। সে কলঙ্ক লেপনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বা কাজী নজরুল ইসলামের কোন ক্ষতি না হলেও বাংলা ভাষায় পরবর্তী প্রজন্মের মানুষ হিসেবে আমাদের বৃদ্ধি যে রহিত হয় তা সুনিশ্চিত।