ডা.সুরাইয়া হেলেন।
রসুলপুর গ্রামের মিয়া সাব ভাবিয়া দেখিলেন,এই যে কয়েক বৎসর যাবৎ অনাবৃষ্টি,খরা,নয়তো অতিবৃষ্টি,বন্যা,ঝড়,জলোচ্ছ্বাস এরূপ প্রাকৃতিক দুর্যোগ তার গ্রামটিকে বিরান ভূমিতে পরিণত করিয়া তুলিতেছে,তাহার মূলে অনাচার-পাপাচার দায়ী।ইহাছাড়া পূর্বে গ্রামেগঞ্জে ম্যালেরিয়া,কলেরা,বসন্তে মানুষ মরিয়া সাফ হইতো!এখন সে স্থান দখল করিয়াছে ডেঙ্গু,এইডস নামক মারণব্যাধি!ডাক্তার-বৈদ্য কী করিবে?ঔষধের সাথে সাথে তদবিরেরও প্রয়োজন আছে।তাছাড়া ঘরে ঘরে রঙিন টি.ভি.,ডিস,ভি.সি.আর এসবের বদৌলতে বেলাজ বেহায়া নারীপুরুষ একযোগে আধা-নেংটা আওরতদের বেগানা পুরুষের সাথে উদ্দাম নাচ-গান সহ সিনেমা,নাটক উপভোগ করিতেছে!আল্লাহর গজব এই গ্রামে নামিয়া আসিবে নাতো কি বেহেশতের নহর বহিবে?
তিনি গ্রামের মুরুব্বীদের ডাকিয়া এক ওয়াজ-মাহফিলের আয়োজন করার কথা উত্থাপন করিলেন।হুজুর মোহাম্মদ আহাম্মদ আবদুল্লাহ কাশিমপুরী ইবনে মুক্তাদির-আল-ইমরান বড়ই নেকবখত,কামেল,আল্লাহর পেয়ারা বান্দা।যতবড় নাম,ততবড় কামেল!শোনা যায় তাঁর ১২টি পালা জ্বিন সবসময় তাঁর পাহারায় থাকে ।এর মাঝে সর্দার হলো,কীসমত জ্বীন!এই কীসমতের অসাধ্য কাজ এই পৃথিবীতে কিছুই নাই,তার অগম্যও দুনিয়ার কোন স্থান নাই!হুজুরকে রাজি করাইয়া এই গ্রামের নারী-পুরুষদের উদ্দেশ্যে ওয়াজ-নসিহত করাইতে পারলে ,তাহারা সঠিক পথে আদব-লেহাজের সাথে চলিলে ,এইসব গজব হইতে আল্লাহ নিস্তার দিতে পারেন।সকলেই মিয়ার বেটার সাথে একমত হইলেন।
আগামী শুক্রবার বাদ জুম্মা,মসজিদের সামনের ময়দানে শামিয়ানা টানাইয়া মাহফিলের স্থান নির্ধারন করা হইলো।সম্ভ্রান্ত নারী-পুরুষদের জন্য উচ্চস্থানে পর্দা টানাইয়া পৃথকভাবে বসিবার ব্যবস্থা করা হইলো।নিম্নবিত্তদের জন্য সামনে পাটি পাতিয়া স্ত্রী-পুরুষ একইস্থানে কিন্তু ডানদিকে পুরুষ ও বামদিকে স্ত্রীলোকদের স্থান নির্দেশ করা হইলো!১০মাইল দূরের মধুপুর মাদ্রাসায় লোক পাঠাইয়া হুজুরের অনুমতি আদায় করা হইয়াছে।
মাহফিলের দিন জুম্মার পর সারা গ্রাম ভাঙিয়া এমনকি পার্শ্ববর্তী গ্রাম হইতেও লোকজন আসিয়া,মানুষে মানুষে ময়দান পরিপূর্ণ হইয়া গেলো!একটা উৎসব উৎসব ভাব!অবস্থাপন্নরা পরিষ্কার পাজামা পাঞ্জাবি,আতর-টুপি আর তাহাদের নারীগণ শাড়ি-গয়নায় সাজিয়া-গুঁজিয়া মাহফিলে আসিলেন।গরিব দিন-মজুর শ্রেণীর পুরুষরাও লুঙ্গি-টুপি সহ সবচেয়ে ভালো জামা গায়ে উপস্থিত হইলো!নিম্নবিত্ত মহিলারাও তাহাদের তোলা শাড়িটি পরিয়া আসিল ।
মিয়া বাড়ির বান্ধা কামলা ও দাসী করিমের বাপ,করিমের মা ও হুজুরের মাহফিলে ওয়াজ শুনিয়া কিছু পূণ্য সঞ্চয়ের নিমিত্তে উপস্থিত হইয়াছে।করিমের মা তার একমাত্র তোলা বিবাহের লাল শাড়িটি পরিয়াই হাজির হইলো!তাহার অন্য শাড়ি টুটা-ফুটা,তেল-হলুদ-মরিচের দাগে ভরা।
হুজুর সুরমা চোখে,নূরানী চেহারায়,সুললিত কণ্ঠে কোরানের আয়াত তেলাওয়াত করিয়া,তার বাংলা তরজমা সহ ওয়াজ-নসিহত করিতেছেন।এক পর্যায়ে তিনি বলিলেন,‘যে সমস্ত পুরুষ বেহেশতে যাইবে,আল্লাহ তাহাদের খেদমতের জন্য ৭০জন অনিন্দ্য সুন্দরী হুর প্রদান করিবেন।’
মুখরা ও স্পষ্টভাষী বলিয়া করিমের মার বদনাম আছে!এই সময় সে উঠিয়া দাঁড়াইয়া হুজুরের দৃষ্টি আকর্ষণ পূর্বক জিজ্ঞাসা করিল,‘হুজুর,আমরা বেহেশতে গেলে মাইনে মাইয়্যা মানুষের লাইগা কী ব্যবস্থা?ঐহানে খেদমতের জন্যি আমরা কী পাইবো?’
হুজুর বিস্ময়ে হতবাক হইয়া বলিলেন,‘বেহেশতে কাহারো খেদমত লাগিবে না!সেখানে অনন্ত সুখ।যাহা চাইবে তাহা সাথে সাথে আপনিই হাজির হইবে!পবিত্র নারীরা সেখানে তাঁহাদের স্বামীদের ফিরিয়া পাইবেন।’
করিমের মা ততৎক্ষনাৎ সভয়ে বলিয়া উঠিল,‘বাপরে বাপ,আবার করিমের বাপ!’
উপরোক্ত কৌতুকখানি সবারই জানা।পরের অংশটি বলার জন্য এই লেখাটির অবতারনা করিতেছি।
করিমের মার কথা শেষ হইতে না হইতেই করিমের বাপ মারমুখী হইয়া তেড়িয়া আসিল!হুজুরকে স্বাক্ষী রাখিয়া বলিতে লাগিলো,‘দেখলেন হুজুর, কত বড় বদ মাইয়্যালোক লইয়া সংসার করতাছি!অর চোখ কু,মনেও কু।বেহেশতে অর পরপুরুষ পাওয়ার ইচ্ছা!হাবিয়া দোযখেও এই বেডির জাগা হইবো না!’
মাহফিলে একটা ভীষন গোলযোগ শুরু হইয়া গেল!হুজুর সবাইকে শান্ত হওয়ার আহ্বান জানাইলেন।কে শোনে কার কথা!এর মাঝেই করিমের মা বলিতে লাগিলো,‘যেই বেহেশতে করিমের বাপ থাকবো,হেই বেহেশত আর বেহেশত থাকবো না!হাবিয়া দোযখ থাইকাও খারাপ হইয়া যাইবো!এই বেডা দুইন্যাত ঐ আমার সংসার দোযখ বানাইয়া রাখছে!আর গোঁদের ওফরে বিষ ফোঁড়ার মত বেহেশতে তো এই বেডার লগে আরও থাকবো আমার ৭০ হুর সতীন মাগী!বেহেশতে যদি চাইলেই সব পাওয়া যায় তো আমার আর করিমের বাপের কী দরকার?আর বেডাইনের ঐ ৭০ হুরের দরকারটা কী?’
মিয়া সাব সহ সম্মানিত মুরুব্বিরা করিমের মার স্পর্ধায় স্তম্ভিত হইয়া গেলেন!তাহাকে তখুনি মাহফিল হইতে বাহির করিতে স্বেচ্ছাসেবিরা অগ্রসর হইলো।মিয়া সাবের বেগম পর্দার আড়ালে মুচকি হাসিয়া,তাহার পুত্রবধূদের বলিলেন,‘করিমের মা কথা তো মিথ্যা বলে নাই!তোমরা কী বল?’বধূগণ মনে মনে করিমের মাকে সমর্থন করিলেও এক্ষনে মাথা নত করিয়া নিরুত্তর রহিল!দেয়ালেরও কান আছে।
প্রবল বাকবিতণ্ডার মধ্যে মাহফিল আর জমিলো না!হুজুর সহ কেহই করিমের মার প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারিলেন না!করিমের মা ও বাপ দুজনই মিয়া বাড়ির চাকরিটি হারাইলো!তাহাদের একঘরে করা হইলো!বেগম সাহেবা কিছুই করিতে পারিলেন না!শত হইলেও জ্বিন পালা হুজুরের বিধান!
বলাবাহুল্য এ যাবৎকাল করিমের মার সংসারে ১টি মাত্র দোযখের উপস্থিতি ছিলো!এই ঘটনার পর তাহার জীর্ণ-দীর্ণ কুটিরে হাবিয়া দোযখ সহ আরও সাত সাতটি দোযখ নামিয়া আসিল!