ভাষা দ্রুত প্রভাব বিস্তার করে। মানুষের কাছে মাতৃভাষার নৈকট্য মৌলিক। জাতীয়তাবাদের যত প্রকার উপাদান আছে তার মধ্যে ভাষা ভিত্তিক জাতীয়তা সবচেয়ে শক্তিশালী ও দৃঢ়। জাতীয়তাবাদের ক্ষেত্রে ধর্ম, ভৌগলিক অবস্থান, ইত্যাদি উপাদানসমূহ ভাষার কাছে গৌণ ভূমিকা পালন করে। ভাষাকে ভিত্তি করে যে জাতীয়তাবোধ তথা জাতীয়তাবাদ, তাকে ধারণ করেই মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের উদ্ভব ১৯৭১ এ।
১৯৪৭-এ ভারত ভাগের আগে, ভারত ও পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা কি হবে তা নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত ঘটে। অখন্ড ভারতবর্ষে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের নেতানেত্রী, শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিকসহ নানা স্তরের নেতৃবৃন্দ ও মনীষীগণ এ বিষয়ে তাদের মতামত ব্যক্ত করেন। এই তালিকায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মহাত্মা গান্ধী, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু, জিন্নাহ, আর নেহেরুও রয়েছেন। সেই সময় কেউ হিন্দি কেউবা উর্দু ভাষার পক্ষে মত প্রকাশ করেন। এ অবস্থায় হিন্দি আর উর্দু ভাষার পক্ষাবলম্বীদের মধ্যে লড়াই শুরু হয়। রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে এই বিতর্কে তখন ধর্মের প্রবেশ ঘটে। এই বিতর্কের প্রচারে বলা হতে থাকে হিন্দুদের ভাষা হিন্দি এবং মুসলমানদের ভাষা উর্দু।
বঙ্গ-ভঙ্গ আন্দোলনের ফলে ১৯১১ সালে ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লিতে স্থানান্তরিত করা হয়। ঐ বছরের (১৯১১) আদমশুমারি অনুযায়ী ভারতবর্ষের প্রায় ৫ কোটি মানুষের মুখের ভাষা ছিল বাংলা। ভাষাভিত্তিক জনগোষ্ঠির বিচারে বাঙ্গালীরা ছিল ভারতে বৃহত্তম। অন্যদিকে তখন হিন্দি ও উর্দুভাষী মিলে যে হিন্দুস্থানি ভাষা সে ভাষা ব্যবহারকারী মোট জনসংখ্যা ছিল চার কোটির কিছু বেশি।
অবশ্য ১৯৪১ সালের আদম শুমারি অনুযায়ী উর্দু ছাড়া একা হিন্দিই হয়ে উঠে ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভাষা। এর কারণ রাজধানী কোলকাতা থেকে দিল্লিতে স্থানান্তরিত হওয়া। দিল্লিতে রাজধানী স্থানান্তরিত হবার পর দিল্লির আশপাশের যে সমস্ত উপভাষা প্রচলিত ছিল তা বিলীন বা লুপ্ত হয়ে যায় এবং ঐসব ভাষাভাষীর লোকেরা হিন্দি ভাষা গ্রহণ করে। বিলীন হওয়া এসব ভাষার মধ্যে রয়েছে আওধী, ব্রজভাষা, কনৌজি, বুন্দেলি, মগহি, মৈথিলি, ভোজপুরিয়া, লাহন্দি, পাহাড়ি প্রভৃতি বিখ্যাত ভাষাসমূহ।
রাষ্ট্রভাষার ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার মর্যাদা ও নবসৃষ্টির গৌরবে ভারত বিভাগের পূর্বে পশ্চিমবংগে এমন রবও উঠেছে যে বাংলাই হবে ভারতের রাষ্ট্রভাষা। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ইতিহাস অনুসন্ধান করলে দেখা যায় যে, ভারতের রাষ্ট্রভাষাকে বাংলা করার পক্ষে জানা মতে প্রথম অভিমত প্রকাশ করেন একজন বিদেশী, যার নাম নাথ্যানিয়েল ব্রাসি হ্যালহেড। তিনি তার A GRAMMAR OF THE BENGAL LANGUAGE (1778) বইয়ের ভূমিকায় লিখেছিলেন, ‘ফার্সির বদলে বাংলাই হওয়া উচিত ভারতের
রাষ্ট্রভাষা’।
পাকিস্তান সৃষ্টির পর রাষ্ট্রভাষা বিষয়ে র্পূব জের ধরে নবলব্ধ পাকিস্তানের জনক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ ঢাকায় এসে ঘোষণা করেন। ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা’। কার্যত: সেই দিনেই পাকিস্তানের মৃত্যু ঘণ্টা বেজে যায়। আর এ ঘণ্টাটি বাজান স্বয়ং পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ।
তার সেই ঘোষণার প্রতিবাদে তৎকালীন পাকিস্তানের শতকরা ৫৬ শতাংশ মানুষের (যাদের মাতৃভাষা বাংলা) ছাত্র প্রতিনিধিরা জিন্নাহর সাথে দেখা করেন এবং এই ঘোষণা থেকে সরে আসার অনুরোধ জানান। তখন কোন যুক্তিই তিনি গ্রাহ্য করেননি। বরং তিনি বলেন, ‘পাকিস্তানের অখ-তার স্বার্থে দরকার হলে তোমাদের মাতৃভাষাকে পাল্টে ফেলতে হবে’।
বলতে গেলে ভাষা বদলে ফেলার এই হুমকির মধ্য দিয়েই মূলত: ভাষাভিত্তিক বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের জন্ম। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এরই পথ ধরে ৫২এর ভাষা আন্দোলন, ৫৪এর যুক্তফ্রন্ট গঠন, ৬২এর শিক্ষানীতি আন্দোলন, ৬৬এর ৬ দফা প্রনয়ন, ৬৯এর গণআন্দোলন, ৭০-এর সাধারণ নির্বাচন এবং সবশেষে ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ এবং ১৬ ডিসেম্বর ৭১’এ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পনের মধ্য দিয়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্ম।
উল্লেখিত বছরসমূহে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের যে ঐক্য, সংগ্রাম, ত্যাগ, আর শৌর্য দেখা গিয়েছিল তার তুলনা সমসাময়িক বিশ্বে নেই বললেই চলে। আর এ কারণেই বাংলার ত্রিশ লক্ষ লোক মুক্তিযুদ্ধে জীবন দিতে কুণ্ঠাবোধ করেননি।
ধারাবাহিক এই ইস্পাত কঠিন সংগ্রামের নেতৃত্ব দেন মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
প্রকৃতপক্ষে বাঙ্গালীকে যে বাঙ্গালী বলা হয়, তা তার ভাষার কারণেই, অন্য কোন কারণে নয়। এ মতবাদ আমরা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে পাই।
বাংলা ভাষার কারণেই আমরা ধর্ম নিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদী হলাম, স্বাধীন দেশ পেলাম, তারপর ক্রমান্বয়ে বাংলা ভাষা আন্দোলনের ঐতিহাসিক ভূমিকাকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে পালনের অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করলাম। এ সবই তো আমাদের জাতিস্বত্তার মৌলিক অর্জন।
বাঙ্গালী বিরোধী লর্ড কার্জন ১৯০৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় যাওয়ার পথে ট্রেনে বসে সেসময় তৎকালীন ভারত সচিবকে একটি চিঠি লিখেন। তিনি চিঠিটি শুরু করেন এভাবে, ‘বাঙ্গালীরা নিজেদেরকে একটি জাতি হিসেবে ভাবতে পছন্দ করে এবং যারা এমন একটি ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখে…..’। এই স্বপ্ন দেখাকে ইংরেজরা নানাভাবে বাধা দেয়ার চেষ্টা করেছিল।
স্বপ্নের আকাঙ্খিত প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশে রাজনৈতিক হত্যাকা-, রাজনৈতিক প্রতিবন্ধকতা, প্রশাসনিক অদূরদর্শীতা, অর্থনৈতিক দূর্বলতার কারণে এখন পর্যন্ত বাংলাভাষা বাংলাদেশে যথাযথ স্থানে পৌঁছাতে পারেনি।
বর্তমানে বাংলাদেশ অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে স্থিতিশীল ও ভবিষ্যত গঠনে দক্ষতার পরিচয় দিয়ে চলছে। এ অবস্থায় বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে জাতির তরুণ- শিশু-কিশোরদের মধ্যে মনন ও মেধার পরিপূর্ণ বিকাশের মাধ্যমে এবং ভবিষ্যৎ আন্তর্জাতিক ও বাণিজ্যিক প্রয়োজনীয় উপযোগী শিক্ষানীতি প্রনয়নের মধ্য দিয়ে বাংলাকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব। শিক্ষানীতিতে বাংলাদেশের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরাটা জরুরী। প্রাথমিক আর মাধ্যমিক স্তরে এবং মাদ্রাসাসমূহে বাংলা ও বিজ্ঞান শিক্ষার আধুনিকায়ন, দেশের সব মাধ্যমের শিক্ষার পাঠ্যক্রম সমমান ভুক্ত করা, সর্বোপরি দ্রুত পরিবর্তনশীল আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থাও নিশ্চিত করতে হবে।
দেশের বিশেষত: ঢাকা বা জেলা শহরের খ্যাতিমান ইংরেজী স্কুলসমূহে যে সমস্ত শিক্ষার্থী পাঠ গ্রহণ করে তাদের মধ্যে ইংরেজী সংস্কৃতি চর্চার প্রবনতা লক্ষ্য করা যায়। এই প্রবনতাকে নিরুৎসাহিত করা আশু প্রয়োজন। তাদের অর্জিত শিক্ষা, মেধা ও মনন কিভাবে দেশীয় তথা বাংলা সংস্কৃতি বিকাশে প্রয়োগ করা যায় তাও ভাবা দরকার।
বিশ্বায়নের এই যুগে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার এবং অর্থনৈতিক অগ্রগতির কারণে বিশ্বের কয়েকটি ভাষা বিশেষ করে ইংরেজী, ফ্রেঞ্চ, স্প্যানিশ, চীনা, আরবী ইত্যাদি তাদের গুরুত্ব বাড়িয়ে নিয়েছে। এই কাতারে বাংলা ভাষাকে কিভাবে তুলে আনা যায় তার পন্থা খোঁজা দরকার।
প্রতিবেশি হিন্দী ভাষা ও সংস্কৃতি বিভিন্ন মাধ্যমে ও বেশে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির উপর একটি নেতিবাচক প্রভাব বিস্তারের অবতারনা করছে। বিষয়টি ভাবনার।
স্বদেশে, প্রবাসে কিংবা অভিবাসী জীবনে বাংলা ভাষাকে সমুন্নত রাখার সর্বোত্তম উপায় মনে হয় বাংলা ভাষার গৌরবে গৌরবান্বিত হওয়া এবং ভাষাটিকে মায়ের মতোই ভালোবাসা। তাহলেই প্রতিকূল পরিবেশেও টিকে থাকবে বাংলা ভাষা।
পরিশেষে একটি প্রস্তাবনা রেখে লেখাটি শেষ করছি।
বৃটিশ বিরোধী ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে অখ- ভারতে ‘রাষ্টভাষা-মাতৃভাষা’ বিষয়টি রাজনীতিতে নানাভাবে উঠে আসে। বিশেষতঃ ১৯০৫ সনের বঙ্গভঙ্গ ও তৎপরবর্তী সময়ে। যার যৎসামান্য আলোকপাত এখানে করা হয়েছে।
বর্তমানে ২১শে ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষা দিবস জাতিসংঘ কতৃক স্বীকৃত আন্তর্জাতিক
মাতৃভাষা দিবস। দিবসটির তাৎপর্য ও গুরুত্ব তদুপরি সাতচল্লিশ পূর্ববর্তী ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাস যেখানে জড়িত রয়েছে সেই বিবেচনায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার দিনটি ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার সরকারী ছুটির দিন ঘোষণা করতে পারেন। নিদেনপক্ষে পশ্চিম বংগ প্রাদেশিক সরকার এর প্রয়োজনীয়তা উপলদ্ধি করে আশু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে উৎসাহী হবেন, এমনটি আশা করা যায়।
Disclaimer:
The editorial team is not responsible for the content of the writing.