সাঈদ চৌধুরী
গতকাল লন্ডন সময় বিকেল ৫টা ৩৯ মিনিটে ফেসবুক মেসেঞ্জারে শাকুর ভাই (খ্যাতিমান স্থপতি, তথ্যচিত্র নির্মাতা, চিত্রগ্রাহক ও নাট্যকার শাকুর মজিদ) লিখেন, আপনার খবর কি? ৬টা ৫৭ মিনিটে মেসেঞ্জার দেখতে গিয়ে সেটি চোখে পড়ে। আমি জানতে চাইলাম, শাকুর ভাই আপনি কি এখনো সজাগ আছেন? উত্তর দিলেন, জি আছি। ফোন দিলাম সরাসরি। সাম্প্রতিক কাজকর্ম ও লেখালেখি নিয়ে কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি একটি লিংক পাঠিয়ে দিলেন আমাকে। ঘুমানোর আগে মোবাইল থেকে দেখতে গিয়ে বিস্ময়ে অভিভূত হলাম।
ভোরবেলা থেকে একে একে দেখে চলেছি অবিশ্বাস্য সব রত্নভান্ডার! সাধারণত লেখক-সাহিত্যিক অগোছালো ধরনের হন। তিনি যে এতো গুছিয়ে চলা সুশৃঙ্খল মানুষ, তা আমার জানা ছিলনা। তার ওয়েব পোর্টালে গিয়ে আমি মুগ্ধ, বিহ্বল। সেখানে চমৎকার ভাবে সাজিয়ে রাখা আছে তার সৃষ্টি কর্মের বিভিন্ন দিক। জীবনের সকল অর্জন, প্রকাশিত বই, ফিল্ম (নন ফিকশন), নাটক (মঞ্চ এবং টিভি), ফটোগ্রাফি, ব্লগ, রিভিউ প্রভুতি। যেভাবে জীবন সাজিয়েছেন তার সবকিছু। বেড়ে ওঠার নিস্তরঙ্গ বর্ণনা। রঙিন শৈশবের ভেতর দিয়ে কঠিন ক্যাডেট কলেজ ও বুয়েট জীবন। আত্মজৈবনিক উপন্যাসের মত পৃথিবীর রূপ-গন্ধময় দৃশ্যপট, আলো-আঁধারির এক জাদুময় বর্ণনায় মনোগ্রাহী।
‘লন্ডনী কন্যা’র শাকুর মজিদ বিলেতে বেশ পরিচিত। তার নাটকটি শুধু সিলেট ও লন্ডনে নয়, দেশে-বিদেশে সাড়া জাগায়। বিশেষ করে আমাদের লন্ডনীদের মধ্যে এটি তুমুল আলোচনা-সমালোচানার সৃষ্টি করে। এই নাটকের সাফল্যের পর তিনি টেলিভিশন নাটকে মনোযোগ দেন এবং ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। মঞ্চনাটকেও দুর্দান্ত সাফল্য পেয়েছেন তিনি।
ব্যক্তিগত জীবনে সিলেটের বিয়ানী বাজার নিবাসী শাকুর মজিদ ঢাকায় বসবাস করেন। ডঃ হোসনে আরা জলির সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন ১৯৯৩ সালে। তাদের দুই পুত্র, ইশমাম ইনতিসার মজিদ ও ইবন ইবতেশাম মজিদ।
শাকুর মজিদ বহুমাত্রিক লেখক। ভ্রমণকাহিনি ও জীবনী সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য ২০১৭ সালে বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরষ্কার লাভ করেছেন। অনিন্দসব উপাদান, অবিশ্বাস্য সব শব্দ ও বুনন তার লেখাকে করে তুলেছে মহিমান্বিত। শব্দের পৃষ্ঠে শব্দ আর তার অপূর্ব ব্যবহারে প্রাণময় হয়েছে বিশাল সাহিত্য ভান্ডার। তার প্রতিটি নাটক কিংবা ভ্রমণ কাহিনী একটু ব্যতিক্রম, গল্পে একটু ভিন্ন রকম চমক থাকে। সৈয়দ মুজতবা আলীর পরে সিলেটে এমন শক্তিমান ভ্রমণকাহিনী লেখক আমার চোখে পড়েনি।
বাংলার সৌন্দর্যের বিমুগ্ধ লেখক শাকুর মজিদ। প্রতিটি লেখায় কিংবা তথ্যচিত্রের শরীরে ছড়িয়ে আছে এক প্রগাঢ় ভালোবাসা। আছে এক মুগ্ধকর জীবনবোধ। অপরূপ শব্দচয়ন এগুলোকে করে তোলেছে আরও আকর্ষণীয়। স্পর্ধিত নাট্যভাষার মূর্তায়ন ঘটাতে পেরেছেন শাকুর মজিদ। তার অনুভবের রসায়নটি এত অন্দরের নিভৃতের বিষয় যে, বাইরের সাধারণ্যের পক্ষে সহজে বুঝা দুরূহ। তাই তিনি স্থান করে আছেন অগ্রসর পাঠক ও দর্শকদের হৃদয়ে।
শাকুর মজিদ পেশায় একজন খ্যাতিমান স্থপতি। তার স্থাপত্য কর্মসমূহ দেখতে যেমন সুন্দর তার চেয়ে বেশি মনোরম। দুনিয়ার আধুনিক স্থাপত্য কর্ম নিয়ে অনেক পড়াশোনা ও গবেষণা করেন তিনি। নিজের কাজকে বোধগম্য করার তাগিদে শিল্পের স্বরূপ ও সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলেন। ফলে তার ডিজাইন ও স্থাপত্য-কর্ম আলাদা করে চেনা যায়। তার রচিত ‘ইসলামের স্থাপত্যধারা‘ পড়লে এক্ষেত্রে লেখকের গভীর অন্তর দৃষ্টি অনুভব করা যায়।
শাকুর মজিদ বলেন, আমি চেষ্টা করি আমাদের পরিবেশের সাথে এবং জলবায়ুর সাথে মিল রেখে স্থাপনাগুলো বানানোর। যত কম মেকানিক্যাল সাপোর্ট দেয়া যায় সেই চেষ্টাও থাকে। প্রাকৃতিক ভাবে আলো-বাতাস যেভাবে জায়গার ভেতরে ঢুকে, তা আনার চেষ্টা করি। খোলা ইটের ব্যবহার করে থাকি। প্লাস্টারটা পরিহার করতে চাই। পরিবেশ বান্ধব স্থাপনা যাতে নির্মাণ করতে পারি সেই চেষ্টাটা থাকে সব সময়।
শাকুর মজিদ একজন সফল ভ্রমণচিত্র নির্মাতা। তার ভ্রমণ কাহিনী অন্তর ছুয়েঁ যায়। মৃদু হাওয়ার মতো বয়ে যায় হৃদয় জুড়ে। ১৯৯৭ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত ভ্রমণের প্রথম ৫টি গ্রন্থের সংকলন নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে শাকুর মজিদের ‘ভ্রমণসমগ্র ১‘। ১৯৯৭ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাতে দু’সপ্তাহের ভ্রমণ ছিল ঘটা করে শাকুর মজিদের প্রথম কোন বিদেশ ভ্রমণ। তার প্রকাশ ঘটেছে ‘আমিরাতে তেরোরাত‘ গ্রন্থে। ২০০১ সালে পাঁচ সপ্তাহের জন্য আমেরিকা ভ্রমণ করে এসে লিখেন দ্বিতীয় ভ্রমণগ্রন্থ ‘আমেরিকা : কাছের মানুষ, দূরের মানুষ‘। ২০০৩ সালে চিলিতে এক স্থাপত্য সম্মেলনে যাওয়া উপলক্ষে দু’সপ্তাহ ইউরোপের তিন শহরে ঘুরে লিখেন ‘সক্রেটিসের বাড়ি‘ আর এক সপ্তাহ চিলি দেখে লিখেছিলেন ‘পাবলো নেরুদার দেশে‘। আর ২০০৪ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত ইংল্যান্ড আর স্কটল্যান্ডের কয়েকটি শহরের গল্প নিয়ে সাজিয়েছিলেন ‘নদীর নাম টে‘ ভ্রমণগ্রন্থটি । এই পাঁচটি ভ্রমণগ্রন্থ নতুন আঙ্গিকে একত্রিত হয়েছে ভ্রমণসমগ্রের প্রথম খণ্ডে।
২০০৬ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত ৪টি দেশ নিয়ে প্রকাশিত ৪টি বই সংকলিত হলো শাকুর মজিদের ‘ভ্রমণসমগ্র ২‘। ২০০৬ সালে চীনের সরকারি টেলিভিশন সিসিটিভির আমন্ত্রণে ভ্রমণচিত্র ধারণের জন্য ৬টি রাজ্য সফর করে ‘মিং রাজের দেশে‘ এবং ‘নাশিপাড়া লিজিয়াং‘ নামক দুইটি আলাদা ভ্রমণ গ্রন্থ লিখেছিলেন। ২০০৬-৭ সালে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে মালয়েশিয়া এবং সিংগাপুর সফর করে লিখেছিলেন একমলাটে দুই দেশের গল্প ‘মালয় থেকে সিংহপুরী‘। ২০০৮ সালে ভারতের আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে ৫দিন থেকে এসে লিখেছিলেন ‘কালাপানির গল্প‘। এই চারটে বই ভ্রমণসমগ্রের দ্বিতীয় খন্ডে একমলাটে ঝকঝকে রঙিন পাতায় সাজিয়ে পাঠকের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে।
শাকুর মজিদ ও তাদের পঞ্চপর্যটক দলের ৪টি সফরের ৪টি ভ্রমণ গ্রন্থের সংকলন ‘ভ্রমণসমগ্র ৩‘। ২০০৭ সালে ভিয়েতনাম সফর নিয়ে লেখা ‘হো চি মিনের দেশে‘, ২০১০ সালে শ্রীলঙ্কা ভ্রমণ নিয়ে লেখা ‘সিংহল সমুদ্র থেকে‘, ২০০৯ সালে তুরস্কের ইস্তাম্বুল সফর করে লেখা ‘সুলতানের শহর‘ ও একই সাথে মিশরের কায়রো, লুক্সর ও আসওয়ান সফর নিয়ে লেখা ‘ফেরাউনের গ্রাম‘ বইগুলো। নতুন করে এই চারটে বই ভ্রমণসমগ্রের তৃতীয় খন্ডে একত্রিত হয়েছে।
২০১১ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত কয়েকটি দেশ সফর নিয়ে প্রকাশিত ৪টি বই সংকলিত হয়েছে শাকুর মজিদের ‘ভ্রমণসমগ্র ৪‘। ২০১১ সালের এপ্রিল মাসে তিন সপ্তাহে পূর্ব ইউরোপের কয়েকটি দেশ এক সাথে সফর করেন শাকুর মজিদ ও তার পঞ্চ পর্যটক দল। সুইডেনের স্টকহোম নিয়ে বই হয় ‘নোবেলের শহর‘, পোলান্ড নিয়ে বই লিখেন ‘লেস ওয়ালেসার দেশে‘, প্রাগ ও সালসবুর্গ দুই শহরের ভ্রমণকাহিনী ছাপা হয়েছে ‘প্রাগের ঠাকুরোভা, মোজার্টের লবনপুর‘ গ্রন্থে। ২০১৪ সালে নেপালের পোখরা, কাঠমান্ডু ও অন্যান্য অঞ্চল ঘুরে লিখেন ‘অন্নপূর্ণায়‘। নতুন করে এই চারটে বই ভ্রমণসমগ্রের চতুর্থ খন্ডে এক মলাটে সংযুক্ত হয়েছে।
এক সময়ের হুমায়ূন ভক্ত অতি সাধারণ পাঠক, নতুন ঢাকায় আসা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্র শাকুর মজিদ সাংবাদিকের ভান ধরে হুমায়ূন আহমেদের কাছে গিয়েছিলেন মূলত তাঁকে আরো বেশি করে জানতে, ১৯৮৬ সালে। সেই থেকে সূচনা হয় সম্পর্কের। এর পরে মাঝে মাঝে তাঁদের মধ্যে দেখা সাক্ষাৎ হতো, কিন্তু অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ে ওঠে নাই। এর প্রায় দুই যুগ পরে, ২০০৮ সালে শাকুর মজিদের লেখা একটি বই পড়ে হুমায়ূন আহমেদ তাঁকে বাসায় দাওয়াত দিলে সূচনা হয় আরেক পর্বের। অত্যন্ত ঘনিষ্টদের তালিকায় প্রায় অপরিহার্য হয়ে ওঠেন শাকুর মজিদ এবং এই ঘনিষ্টতা অব্যাহত থাকে ২০১২ সালে হুমায়ুন আহমেদের মৃত্যুর আগে পর্যন্ত।
হুমায়ূন আহমদের স্মৃতিকথা লিখতে গিয়ে শাকুর মজিদ তার নিজেরও একসাথে বেড়ে ওঠার কাহিনী শুনিয়েছেন। এ নিয়ে প্রথমা থেকে প্রকাশিত ‘হুমায়ূন আহমেদ, যে ছিলো এক মুগ্ধকর‘ এবং অন্যপ্রকাশ থেকে ‘নুহাশপল্লীর এইসব দিনরাত্রি‘ নামে দুটো বই ছাপা হয়। হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুপরবর্তি নানা সময়ের যে ঘটনাগুলো বিভিন্ন পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল তা নিয়ে গ্রন্থকুটির বের করেছিল ‘অভিনেতা হুমায়ূন ও অন্যান্য‘। মূলত এই তিনটি বই পাঠকদেরকে এক মলাটে দেয়ার জন্য প্রকাশ হলো শাকুর মজিদের ‘হুমায়ূননামা ট্রিলজি‘।
হুমায়ূন আহমেদ ৪০ বছরের বেশি সময় ধরে লেখালেখি, নাট্যনির্দেশনা ও চলচ্চিত্র নির্মাণে ব্যাপৃত ছিলেন। এর মধ্যে প্রায় ৩২ বছর ধরে শাকুর মজিদ তাঁর সঙ্গে মিশেছেন। একটা পর্যায়ে মজিদ ছিলেন মূলত হুমায়ূন আহমেদের ব্যক্তিজীবনের অন্তরঙ্গ অনুরাগী আর কৌতূহলী পর্যবেক্ষক। তাঁর একান্ত নিজস্ব অনুভূতিগুলোই এই বইতে প্রকাশ পেয়েছে। বড় মাপের কোনো মানুষের কথা বলতে গিয়ে তাঁদের কাছের মানুষেরা প্রায়শই অতিশয়োক্তি করে তাঁদের রচনাকে ভারাক্রান্ত করেন, সাধারণ পর্যায় থেকে তুলে তাঁকে মহামানবের স্তরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। শাকুর মজিদ এ ক্ষেত্রে পরিমিতি বোধের প্রকাশ ঘটিয়েছেন। এ বই কেবল স্মৃতিকথাই নয়, এর মধ্যে একজন সাধারণ লেখকের অসাধারণ হয়ে ওঠা এবং তাঁর বিবর্তনের পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে।
শাকুর মজিদ নিজেই বলেছেন, প্রায় ৩২ বছর ধরে হুমায়ূন আহমেদকে আমি চিনি। কিন্তু তাঁর কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ হয় ২০০৮ সালের গোড়ার দিকে। তাঁকে নিয়ে দীর্ঘ স্মৃতিচারণ করেছি আমার বই ‘হুমায়ূন আহমেদ : যে ছিল এক মুগ্ধকর’-এ। এ বইটি কেবলমাত্র নুহাশপল্লীকে ঘিরে আমার ব্যক্তিগত কিছু অনুভূতির প্রকাশ। নিজের অনুভূতি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে নুহাশপল্লীর গাছপালা, ভাস্কর্য, নানা রকমের স্থাপনা এবং সে সবকে কেন্দ্র করে হুমায়ূন আহমেদের যাপিত জীবন নুহাশপল্লীতে কেমন ছিল, সেটি প্রকাশের চেষ্টা করেছি।
বহুমুখি প্রতিভার অধিকারী শাকুর মজিদ সিলেটের এক প্রত্যন্ত গ্রামে জন্ম নিয়েও কেবল নিজ মেধাগুণে দেশসেরা দুই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশুনা করে জীবনে আজ সু-প্রতিষ্ঠিত। ১৯৭৮ সালে গ্রাম ছেড়ে সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছিলেন ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজে। সেখানে তাঁর প্রথম বছরটি ছিলো আধাসামরিক এই আবাসিক শিক্ষায়তনে সহপাঠি ও পরিবেশের সাথে অভিযোজিত হবার সময়। এ নিয়ে লিখেছেন ক্লাস সেভেন ১৯৭৮। অষ্টম থেকে দ্বাদশ শ্রেণীর ঘটনাপুঞ্জ এসেছে ক্যাডেটের ডায়েরিতে। ১৯৮৪ সালে উচ্চমাধ্যমিক শেষে ভর্তি হন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে। স্থাপত্যে পড়াশুনার সময় দেশের বিরূপ রাজনৈতিক পরিবেশেও অর্থ উপার্জনের জন্য টিউশনির পাশাপাশি বেছে নেন সংবাদপত্রে লেখালেখি আর আলোকচিত্রণের পেশা। এই সংগ্রামী জীবনের কথা তিনি লিখেছিলেন তাঁর বুয়েটকাল গ্রন্থে।
শাকুর মজিদ আজ দেশের নামকরা স্থপতি, বহু পরস্কারে ভূষিত লেখক, নাট্যকার, আলোকচিত্রী ও চলচ্চিত্র নির্মাতা। এটুকু হবার পেছনে তাঁর ছাত্র জীবনের যে ভূমিকা ছিলো তা নিয়ে যে তিনটি গ্রন্থ লিখেছিলেন তারই সংকলন এই ছাত্রকাল ট্রিলজি। যেকোন সৎ-সংগ্রামী-স্বপ্নবাজ তরুণ এই ত্রয়ীগ্রন্থ পড়ে জীবনকে নতুনভাবে গড়তে পারেন।
শাকুর মজিদ বলেন, আত্মজৈবনিক এই বইটি আমার আগের ‘ক্লাস সেভেন ১৯৭৮’ ও ‘ক্যাডেটের ডায়েরি’র সিক্যুয়াল। ১৯৮৬ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনার বর্ণনার পাশাপাশি সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অবস্থার বিবরণ লিখেছি। সেই সময়ে রাজধানীতে অভিবাসিত হয়ে নাগরিক পরিবেশে অভিযোজিত হওয়ার কাহিনী শোনাতে শোনাতে আমি আসলে একটা কালকে ধরে তুলেছি এ বইয়ে।
১৯৭৮ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের ৬টি বছর আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় ছিলো । সে সময়টা ছিলো আমার কুসুম ফোটার সোনালী দিনগুলি। ক্যাডেট কলেজের পরিবেশ, শিক্ষা, বন্ধুদের সাহচর্য্, শিক্ষকদের দিকনির্দেশনা আমাকে একজন ভিন্ন মানুষ রূপে গড়ে তোলে। সেই ক্যাডেট কলেজে পড়ার সময় প্রায় প্রতিদিনি আমার নোটবুকে অত্যন্ত গোপনে কিছু না কিছু লিখে রাখতাম এবং অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে তা লুকিয়েও রাখতাম, কাউকেই ছুতে দিতামনা আমার গোপন ডায়েরিটি।
কলেজ থেকে বেরিয়ে যাবার ৩০ বছর পর, আজ স্বেচ্ছায় এ নোটবুকটি প্রকাশ করতে ইচ্ছা হল। এর আগে কলেজের ১৯৭৮-৭৯ সালের এক বছরের ডায়েরিকে আত্মজৈবনিক উপাখ্যানাকারে প্রকাশ করেছিলাম ২০০৮ সালে, নাম ছিলো ক্লাস সেভেন ১৯৭৮ । এবার তাঁর বাদবাকি অংশ নিরেট ডায়েরির আকারেই ছাপিয়ে দিলাম। সঙ্গে যুক্ত করলাম সে সময়ে আমার সহপাঠি ও শিক্ষকদের ছবিও । কলেজ ক্যাম্পাসের কিছু ছবি পরবর্তি সময়ে তোলা অপরিবর্তিত অবয়বেরই। কিশোর বয়েসে আমি ঠকে ঠকে যা যা শিখেছিলাম, তা থেকে কোন একজনের জন্যও যদি এটা কোন উপকার নিয়ে আসে, আমি মনে করবো আমার সকল গোপন কথা ফাঁশ করে দেয়া স্বার্থক।
খ্যাতিমান স্থপতি, ভ্রমণচিত্র নির্মাতা, লেখক ও নাট্যকার শাকুর মজিদের ওয়েব পোর্টালে গিয়ে অন্তর বিস্ময়ে জেগে উঠল। জগৎ ও জীবন সম্বন্ধে লেখকের গভীর বোধ, জীবনকে দেখার ভঙ্গি এবং অনুভব করার স্বতন্ত্র মানসিকতা তার লেখায় ও নাটকে প্রকাশ পেয়েছে। তার অসাধারণ শিল্পসৃষ্টির যোগ্যতা অনুভব করতে হলে বুকের ভেতরের চোখ দিয়ে দেখতে হবে। শাকুর মজিদের কোন কবিতা আমার চোখে পড়েনি। কিন্তু তার লেখায় অনেক উপমা, অনেক উৎপ্রেক্ষা, অসংখ্য কাব্যিকতার সংলাপ বিদ্যমান। তার ভ্রমণ কাহিনীতে ব্যবহৃত চমৎকার শব্দপ্রয়োগ আমাকে মুগ্ধ করেছে। এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছে তাকে।
শাকুর মজিদ গল্প, নাটক, ভ্রমণ কাহিনি লিখেছেন অনেক। নাটকের সকল শাখায় তার বিচরণ। কুড়ি বছর বয়সে সিলেট বেতারে তাঁর লেখা নাটক ‘যে যাহা করোরে বান্দা আপনার লাগিয়া’ প্রথম প্রচার হয় । লন্ডনী কইন্যা, নাইওরী, বৈরাতী, করিমুন নেছা, চেরাগ সহ বেশ কয়েকটি টেলিভিশন নাটক ও টেলিফিল্ম রচনা করে সাড়া জাগিয়েছেন তিনি। দেশ-বিদেশের ভ্রমণচিত্র নিয়ে তিন শতাধিক প্রামাণ্যচিত্র বানিয়েছেন। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ৪২, বেশীর ভাগই ভ্রমণকাহিনি, স্মৃতিচারণ ও আত্মজৈবনিক গ্রন্থ।
শাকুর মজিদের বন্ধু তরিকুল লাভলু লিখেছেন, আপন এই গুণপনা জীবনের নানা পর্যায়ে স্থপতি হিসেবে তাঁকে যেমন প্রতিষ্ঠিত করেছে, তেমনি এনে দিয়েছে সফল নাট্যকার, নাটক ও প্রামান্য চিত্র নির্মাতা, গবেষক, লেখক ও অনুসন্ধিৎসু একজন বিশ্ব পর্যটকের খ্যাতি। এনে দিয়েছে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের অনন্য সব মুল্যবান পুরষ্কার আর স্বীকৃতি। ওর লেখা ‘মহাজনের নাও’ কাব্য-নাটকটি নাট্যকলার উচ্চতর শিক্ষায় অবশ্যপাঠ্য পাণ্ডলিপি হিসেবে বিবেচনা করা যায়। “ভাটির পুরুষ” প্রামাণ্য চিত্রটি বানাবার আগে টানা প্রায় আট বছর ধরে সাধক ও বাউল শাহ আব্দুল করিমের বাসায় যাওয়া আসা করেছে সে। সুনামগঞ্জ থেকে নৌকায় হাওরের মধ্যে দিয়ে প্রায় ঘণ্টা খানেকের পথ। ‘উজান ঢল’ গ্রামে করিম সাহেবের সেই বাড়িতে ২০০৮ সালের জুন মাসে শাকুরের সাথে আমি নিজে একবার গিয়েছিলাম। সময় ও কষ্টসাধ্য সে যাত্রায় বুঝেছি, প্রচণ্ড উদ্দ্যম আর নিষ্ঠা না থাকলে শুধু একটা প্রামাণ্য চিত্র বানাবার পরিকল্পনা মাথায় নিয়ে বছরে তিনবার তাও আবার আট বছর ধরে এ পথে আসা যাওয়া করে এই কষ্টসাধ্য কাজ কিছুতেই করা সম্ভব না। দীর্ঘ এই সময়ে প্রামান্য চিত্র ধারনের পাশাপাশি করিম সাহেবের জীবন, কর্ম, দর্শন এবং রচিত গান সমুহ নিয়ে যে গভীর গবেষণা কর্মটি সম্পন্ন করেছে তারই ফলশ্রুতিতে রচনা করেছে ইতোমধ্যে বিখ্যাত মঞ্চ নাটক ‘মহাজনের নাও’। পুরো নাটকটির সংলাপ রচিত হয়েছে গীত কবিতার ‘পয়ার’ ছন্দে। বাংলা নাটকের প্রাচীন ঐতিহ্য ও ছন্দকলার উপর শাকুরের দখল ও মুন্সিয়ানা এই নাটকের পরতে পরতে সুস্পষ্ট।
তরিকুল আরো লিখেছেন, সুবচন নাট্য সংসদ ‘মাহাজনের নাও’ নাটকটি প্রথম মঞ্চে আনে ১৮ জুন ২০১০ সালে। শিল্পকলার এক্সপেরিমেন্টাল হলে। ইতোমধ্যে দলটি বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রনালয়ের তত্ত্বাবধানে দক্ষিন কোরিয়ায় দুটি প্রদর্শনী ছাড়াও দেশের বাইরে ত্রিপুরা, জলপাইগুড়ি, আসাম, কলকাতা এবং ঢাকার বাইরে কুমিল্লা, চাদপুর, রাজশাহী, সিলেট, সাভার, বিয়ানীবাজার, বরিশাল নিয়ে ৭৫টি প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে। কুড়িয়েছে দর্শকের অকুণ্ঠ প্রশংসা। .. নিজ কাজের প্রতি এই অনুরক্তি এবং আপন বিভা প্রচার ও প্রকাশে শাকুরের আকুলতা, প্রজ্ঞা, পারঙ্গমতা, প্রত্যুৎপন্নমতিতা, কর্মচঞ্চলতা, সদাপ্রাঞ্জলতা এবং বৈচিত্রতা প্রায় ঐশ্বরিক। নিজের গুনাবলি দিয়ে তো বটেই, অন্যকে দিয়েও আপন জীবন বর্ণাঢ্য করে তুলবার বিরল নৈপুণ্য করায়ত্ত্ব করেছে সে!
পঞ্চ-পর্যটক প্রসঙ্গে তরিকুল লাভলু লিখেন, আমাদের পঞ্চ-পর্যটক দলের কনিষ্ঠতম সদস্য হলো শাকুর। কিন্তু কর্মে, নির্মাণে আর ভ্রমণ উপস্থাপনে তাঁর ভুমিকা এবং শৈল্পিক দক্ষতা বলা যায় একক। ২০০১ সালে মায়ানমার দিয়ে শুরু। তারপর থেকে এ পর্যন্ত আমরা এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা, উত্তর ও দক্ষিন আমেরিকার প্রায় ৩৭টি দেশের ৬৭টি শহর ভ্রমণ করেছি। এসব ভ্রমণ পরিকল্পনা ও আয়োজনে আমাদের শ্রমঘন্টার প্রায় সমপরিমান শ্রম ব্যয় করতে হয়েছে প্রতিবার যাত্রার প্রারম্ভে তাঁর অংশগ্রহণকে নিশ্চিত করার পেছনে। আজ পাসপোর্ট দিতে ভুলে যায় তো কাল বাহানা শুরু করে এবার যেতে পারবে না, ঝামেলা চলছে। অথবা বলবে ‘আমার বাজেট সাকুল্যে ২০০ ডলার, প্লেন ভাড়া সহ। পোষালে আমাকে নেয়া হোক, না পোষালে নেই!’ অবশ্য পঞ্চ-পর্যটকের যে কারো এসব গড়িমসি সামলিয়ে নিমরাজি কাউকে রাজি করাবার জন্য বন্ধু আরিফের জানা আছে প্রায় জাদুকরী বিদ্যা। এতো টানাহেঁচড়ার পর যে যাত্রা, ভ্রমণ অন্তে সেই শাকুরই আবার এসব উপজীব্য করে নির্মাণ করেছে ৩০০টির মত ভ্রমণচিত্র। ‘পৃথিবীর পথে পথে’ অথবা ‘ভুবন ভ্রমিয়া শেষে’ শিরোনামে সিরিজ আকারে সেসবের অধিকাংশ প্রচারিত হয়েছে সরকারী ও বিভিন্ন বেসরকারী টিভি চ্যানেলে। ভ্রমণ কাহিনী হিসেবে প্রকাশ করেছে আঁটটি বই। এর মধ্যে এক ‘অষ্ট ভ্রমণ’ গ্রন্থেই আছে আঁটটি কাহিনী। লিখেছে কিম্বা লিখছে অহর্নিশ; আর প্রায় প্রতি সপ্তাহে বা মাসে তা প্রকাশিতও হচ্ছে নানা পত্র পত্রিকায়।
শাকুর মজিদ উৎকৃষ্ট চিত্তের লেখক ও নাট্যকার। লেখায় তিনি বাংলার মেঠো প্রকৃতিতে খুঁজে উপাদানগুলো নিপুণভাবে প্রয়োগ করেছেন। এ ক্ষেত্রে সর্বত্র তিনি আলাদা মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। এ পর্যন্ত ৪২টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।