জসিম মল্লিক
লেখক পরিচিতিঃজন্ম বরিশাল শহরে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেন। কলেজ জীবন থেকেই তাঁর লেখালেখির শুরু এবং দেশের বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক ও সাপ্তাহিক-এ নিয়মিত লিখছেন। ১৯৮৩ সালে তৎকালীন সাপ্তাহিক বিচিত্রায় কাজের মধ্য দিয়ে তার সাংবাদিকতার শুরু। দীর্ঘ প্রায় চল্লিশ বছরের সাংবাদিকতা ও লেখালেখির অভিজ্ঞতা।এ পর্যন্ত তার প্রায় পঁয়ত্রিশটির মতো গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।
১
জেসমিন ঢাকার মেয়ে। মহাখালী হচ্ছে ওদের আদি নিবাস। একসময় এই এলাকার নাম ছিল ভোলা। অত্র এলাকার চারিদিকেই ওদের জ্ঞাতিগোষ্ঠিরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। বনানী চেয়ারম্যান বাড়ি, মহাখালী ওয়ার্লেসগেট থেকে গজনবী রোড, টিবি গেট এলাকা, গুলশান এক নম্বরে অবিস্থত ডিসিসি মার্কেট এলাকা, উত্তর ও দক্ষিন বাড্ডা, খিলক্ষেতে নিকুঞ্জ-দুই ও আশুলিয়া এলাকা এবং বারিধারার নিকটবর্তী সোলমাইদ এলাকায় আমার শশুরকুলের লোকজন বসবাস করে। আমিও মহাখালী বহু বছর বসবাস করেছি। দুএকজন মন্ত্রী মিনিষ্টার সবসময় থাকে এদের পরিবারে বা তাদের আত্মীয় স্বজনের মধ্যে। কিন্তু আজব ব্যাপার এঁদের তেমন গুরুত্ব নাই এই পরিবারের লোকদের কাছে। যাওয়া আসা বা পরিচয় দেওয়া নাই। আমার অবস্থাও তাই। পথ চলতে অনেকেই দুলাভাই বলে ডাক দেয় আমাকে। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি। এতো লোকজন যে ঠিকমতো চিনতে পারি না। মহাখালীর জামাই হিসাবে আমাকে যতটা চেনে, লেখক হিসাবে ততটা চেনে না। জেসমিন নিজেও জানতো না যে আমি লিখি। পরিচয় হওয়ার পর যখন শুনেছে আমি লেখালেখি করি খুবই অবাক হয়েছিল। জেসমিন ইডেন কলেজে পড়েছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছে। ক্যাম্পাসে আমরা একসাথে অনেক বছর কাটিয়েছি। বাংলা একাডেমি থেকে ইডেন কলেজ বা ঢাবি ক্যাম্পাস দূরে না। স্বাভাবিকভাবে বইমেলা নিয়ে জেসমিনের মনোভাব কি সেটা জানার ইচ্ছে আমার। আগে কখনো ব্যাপারটা নিয়ে কথা হয়নি। কোভিডের জন্য এবার বইমেলায় যেতে পারিনি। জেসমিনও মনে হয় আমার জন্য একটু দুঃখ পাচ্ছে। প্রতি বছর সব বাধা বিপত্তি পিছনে ফেলে বইমেলায় যাওয়া চাই। জেসমিন সেটা মেনেও নিয়েছে। এবার নিজে থেকেই বিরত থেকেছি। আমার নিজের বই প্রকাশিত হওয়ার পরও যাওয়া হয়নি। তাই কাজকর্মের পর আমাদের হাতে অনেক সময় থাকে। আমরা সিপিটুইন্টিফোর নিউজ চ্যানেল দেখি অবসরে। শনি রবিবার ইন্ডিয়ান আইডল দেখি। হঠাৎ একদিন কথা উঠল বইমেলা আর লেখালেখি নিয়ে। লেখকদের নিয়ে জেসমিন মজা করে সবসময়। আসলে টার্গেট আমি।
২
আমাদের এলাকায় একজন পাগলা কিসিমের লোক আছে। লোকটা চাইনীজ অরিজিন সম্ভবত। চাইনীজরা একটু আত্মকেন্দ্রিক হয়। নিজেরা ছাড়া অন্য কারো সাথে বন্ধুত্ব করে না। এই লোকটা দিনভর প্যান্ট শার্ট ইন করে, বাবড়ি চুলে ঘুরে বেড়ায়। কারো সাথে কথা বলে না। একলা একলা বিরবির করে কথা বলে। অনেকটা আমার মতো। যেখানে যাই সেখানেই তাকে দেখি। রাস্তায় হাঁটতে বের হলে দেখি, কফি শপে গেলে দেখি। মনে হয় লোকটার মধ্যে ভুতুরে কিছু আছে। একজন মানুষ কয়েকজন হয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে আছে। অনেক দ্রুত হাঁটে লোকটা। দশ বছর ধরে দেখছি। দুই হাতে কয়েকটা ব্যাগ থাকে সবসময়। তার মধ্যে কাগজ থাকে, বই থাকে, পত্রিকা থাকে। মাঝে মাঝে হারিয়ে যায়, আবার হঠাৎ উদয় হয়। জেসমিন আর আমি একসাথে বের হলে লোকটাকে দেখলেই বলবে ওই যে তোমার লেখক বন্ধু! প্রথম প্রথম রেগে যেতাম, এখন আমিও বলি, লেখক লোকটাকে দেখলাম আজকে। জেসমিন বুঝতে পারে কার কথা বলছি!আমাদের বিয়ের ৩১ বছর হয়েছে। এর মধ্যে জেসমিন কখনো বাংলা একাডেমির বইমেলায় যায়নি। তার আগে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি তখনও যেতে দেখিনি।-আচ্ছা তুমি কখনোই বইমেলায় যাওনি!-ইডেন কলেজে যখন পড়ি তখন একবার গিয়েছিলাম। কিন্তু ভিতরে ঢুকিনি। বাংলা একাডেমির গেটে কয়েকজন বন্ধু মিলে ফুচকা খেয়ে চলে এসেছি।টরন্টোতে আমরা ১৪ বছর ধরে বইমেলা করি। একবার শুধু জেসমিন গিয়েছিল। তাও অনেক রিকোয়েষ্ট করার পর। সেবার ঢাকা থেকে সেলিনা হোসেন, অটোয়া থেকে লুৎফর রহমান রিটন এবং আমার কয়েকজন প্রকাশক বন্ধু এসেছিলেন তাই গিয়েছিল।নিউইয়র্ক বইমেলায় যাই প্রতিবছর আমি। মাঝে মাঝে জেসমিনও যায়। কিন্তু একবারও বইমেলায় যায়নি। আমি মেলা নিয়ে ব্যস্ত থাকি আর সে শপিংএ ব্যস্ত থাকে নতুবা তার বোনদের সাথে সময় কাটায়।-তোমার একবারও নিউইয়র্ক বইমেলা দেখতে ইচ্ছা করে না!-আমি ঢাকায়ই বইমেলায় যাইনি কখনো! যেয়ে কি করব। আমি বইয়ের পাঠক না, সাহিত্যের আলোচনাও এনজয় করি না।
৩
তোমার লাইফে এ পর্যন্ত কয়টা বই পড়ছো!-পড়েছি তিন চারটা।-কি কি বই মনে আছে!-কলেজে থাকতে পড়েছি। একটার নাম মনে আছে, মেমসাহেব।-আমার কোনো বই পড়েছো!-না। তোমার বই পড়ার কি আছে।-আমার কয়টা বই বের হয়েছে এ পর্যন্ত তা জান!-হবে পনোরো বিশটা।-না। প্রায় চল্লিশটা।-এতো বই কে লিখতে বলেছে!-আচ্ছা তুমি মঈনুল আহসান সাবেরর কোনো বই পড়েছো!-তার একটা বই অনেক খানি পড়েছিলাম।-নাম কি বইয়ের!-পথের দাবী বা এই ধরণের নাম ছিল।-ধুর কি বলো। পথের দাবী তো শরৎচন্দ্রের। সাবের ভাইয়ের বইটা ছিল পাথর সময়।-হ্যাঁ ওইটাই। তুমি দিছিলা।-হুমায়ূন বা মিলন পড়েছো?-না। তাদের নাটকে দেখেছি। হুমায়ূন আহমেদের সকাল সন্ধ্যা প্রথম দেখি।-এটা হুমায়ূন আহমেদের নাটক না।-ওহ সরি এইসব দিন রাত্রি।-লুৎফর রহমান রিটনের কোনো ছড়া পড়ছ!জেসমিন হেসে ফেলল।-হাসলা যে।-রিটন ভাই আমাকে ক্যাম্পাসে দেখলেই মজার মজার কথা বলত ওইটা মনে করে হাসলাম।-আচ্ছা তুমি আনিসুল হকের মা বইটা পড়েছো! বাসায় আছে বইটা। একশটা এডিশন হয়েছে।-তুমি না একটা বই লিখছ ’আমার মা’! ওইটাইতো পড়িনাই। মা কখন পড়ব!-মারুফুল ইসলামের অনেক কবিতার বই আমার বাসায়। তুমি কি দেখেছো কখনো বইগুলো।-হ্যাঁ। তোমার সেলফ পরিষ্কার করতে যেয়ে দেখি অনেক বই। মারুফের বই, আসিফ নজরুল, ইরাজ আহমেদের বই।-কোনোটা উল্টে দেখেছো।-আরে ওরাতো আমার বন্ধু। ওদের বই কষ্ট করে পড়তে হবে নাকি!-শীর্ষেন্দু পড়েছো! আমার এতো প্রিয়।-তুমি না একবার গেছিলা কোলকাতায় শীর্ষেন্দুর বাড়িতে! আমাকে রাঙ্গুলিতে রেখে একলাই গেছো। -পৃথিবীতে এতো ভাল ভাল বই লেখা হয়েছে! তোমার পড়তে ইচ্ছে করে না!-আমার সমস্যা হচ্ছে পড়তে বসলেই ঘুম পায়, আর কয়েক পৃষ্ঠা পড়ার পর ভুলে যাই আগে কি পড়েছি। তাছাড়া এতো বিজি থাকি। কখন বই পড়ব। তুমি পড়ো, অর্ক পড়ে, অরিত্রি পড়ে তাতেই হবে। সবাইকে বই পড়তে হবে এমন কোনো কথা নাই। -আমার ফেসবুকের কোনো পোষ্ট পড়েছো!-তুমি তো আমার ফ্রেন্ড লিষ্টেই নাই। তুমি মাঝে মাঝে সাবের ভাইয়ের পোষ্ট পড়ে শোনাও মজা পাই।
৪
একটা গল্প বলে শেষ করছি। গল্পটা আগেও করেছি। ১৯৯৩ সাল। একুশের গ্রন্থমেলায় আমার প্রথম উপন্যাস বের হয়েছে। নাম আলোর গভীরে। একদিন বিচিত্রা অফিসে গল্প হচ্ছিল। জেসমিনও ছিল আড্ডায়। সাবের ভাই বলল, জেসমিন তুমি জসিমের প্রথম বইটা পড়েছো! জেসমিন বলল, সাবের ভাই আমি রবীন্দ্রনাথ নজরুলই পড়িনি, ওর বই কখন পড়ব!